শীতকালে যেসব রোগ কিংবা দুর্ঘটনা বেশী হয়ঃ
১) সর্দি-কাশি, শ্বাস-তন্ত্রের রোগ ।
২) কিছু চর্মরোগ ।
৩) অগ্নিকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনা ।
সর্দি-কাশি ও শ্বাস-তন্ত্রের রোগঃ
এ বিষয়ে আমরা সবাই মোটামুটি কিছু ধারনা রাখি। তারপরেও কিছুটা আলোচনা করতে যাচ্ছি, কারো কারো জন্য হয়তো উপকারী কোন তথ্য থাকতে পারে।
ঠান্ডা একটি এলার্জিক উপদান হিসেবে কাজ করে। ফলে মাস্ট সেল নামের কোষ ভেঙ্গে হিস্টামিন বের হয়ে আসে, যার প্রভাবে আমাদের নাক দিয়ে সর্দি পড়ে, হাঁচি আসে, চোখ দিয়ে পানি পড়ে, কাশিও হতে পারে। এটা তাৎক্ষণিক এবং সাময়িক। অর্থাৎ ঠান্ডা বাতাসে বেশীক্ষণ চলাফেরা করলে, কিংবা মোটর সাইকেলে চড়লে কিছুক্ষণের মধ্যেই হবে এবং স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে এলে ঠিক হয়ে যাবে।
অন্যদিকে শীতকালে বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকে। এই শুষ্ক আবহাওয়ায় আমাদের নাক এবং শ্বাসতন্ত্রের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। দীর্ঘ সময় ঠান্ডা অবহাওয়ায় থাকলে শীতের কারণেও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে পারে। শ্বাসতন্ত্রের সিলিয়ারি মুভমেন্ট কমে গেলে চামড়ায় থাকা জীবাণুরা সহজেই নাক বেয়ে ভিতরে চলে যাবে এবং ইনফেকশন করবে।
শীতকাল শেষে অনেক দেশেই বাতাসে পরাগরেণু উড়ে বেড়ায়। এই পরাগরেণুর কারণে এলার্জিক জ্বর (Hay Fever) হতে পারে। এসময় এজমা রোগীদের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। আবার কিছু কিছু ভাইরাস রোগের প্রকোপ শীতকালে কিংবা শীতের শেষে বসন্তের শুরুতে দেখা দেয় (পক্স রোগের বাংলা নাম বসন্ত মনে হয় একারণেই হয়েছে) । ফুসফুসে ব্যাক্টেরিয়া জনিত ইনফেকশন হয়ে নিউমোনিয়া হতে পারে এবং আরো মারাত্মক কিছুও । যাইহোক, বেশ কয়েকটি জানা এবং অজানা কারণে শীতকালে আমাদের শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশন বেড়ে যায় ।
শীতকালে করনীয়ঃ
১) করনীয় মোটামুটি আমরা সবাই জানি, যেমনঃ ঠান্ডা অবহাওয়ায় বেশীক্ষণ বাইরে থাকতে হলে প্রয়োজনীয় পোষাক নিয়ে বের হওয়া; বাথরুম এবং অন্যান্য ব্যাবহার্য পানি গরম করে ব্যাবহার করা।
২) শীতকালে আগুন জ্বেলে কিংবা চুলার আগুনে হাত-পা গরম করতে গিয়ে কিংবা গরম পানি নাড়া-চাড়া করতে গিয়ে দূর্ঘটনার কথা মাথায় রেখে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
৩) ধূলা-বালি, ধোয়াঁ পরিহারঃ ঢাকা শহরের নাকাল করা যানজটে এটা বেশ কঠিন একটা কাজ। বেশ কিছু রোগের জীবাণু সরাসরি ধূলায় ভর করে ফুসফুসে ঢুকে; ধূলাবালি-ধোঁয়া থেকে সরাসরিও অনেক রোগ হয়। যারা ধূলা কিংবা ধোঁয়ায় ভরা রাস্তা দিয়ে বেশীক্ষণ চলাচল করেন, তারা মাস্ক ব্যাবহার করে সুফল পেতে পারেন। ঢাকায় কাপড়ের যেসব মাস্ক পাওয়া যায় সেগুলো ব্যাবহার করলে একসাথে কয়েকটা কিনে বাসায় রাখতে হবে। একটা মাস্ক একদিন ব্যাবহার করে ধুয়ে ফেলতে হবে। মাস্কটাই যদি নোংরা থাকে তাহলে সুরক্ষার চেয়ে ঝুকি আরো বেশী।
নিজের সর্দি-কাশি হলে, কিংবা আশে-পাশে কেউ ঘনঘন হাঁচি-কাশি দিলে মাস্ক ব্যাবহার করা যেতে পারে।
Disposable mask ব্যাবহার করলে অবশ্য ধুয়া-ধুয়ি করতে হবে না। তবে মোট খরচ একটু বেশী পরে যাবে।
৪) বেশী শুস্ক দেশে বাসায়/অফিসে Humidifier ব্যাবহার করে বাতাসের প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা তৈরী করা হয়। আমাদের দেশে এটার খুব একটা প্রচলন নেই। থাকলে মনে হয় ভালোই হত। (iFeri এধরনের প্রডাক্ট বাজারজাত করার কথা চিন্তা করতে পারে।)
৫) চিকিৎসাঃ সাধারণ সর্দি-কাশিতে চিকিৎসকের চিকিৎসার চেয়ে পরিচর্যার গুরুত্ব বেশী। আমরা নিজেরাই যেগুলো করতে পারিঃ
- অল্প গরম পানি (সাথে লবণ বা আদা মিশানো যেতে পারে) দিয়ে গড়গড়া (কুলি) করা।
- গরম পানির বাষ্পে শ্বাস নেয়া।
- আদা, তুলশী পাতার রস পান করা।
-গরম পানি কিংবা গরম পানীয় (লেবু চা, আদা-চিনি মিশিয়ে গরম পানি) পান করা।
-সর্দির জন্য আমরা নিজেরাই এন্টি-হিস্টামিন কিনে খেয়ে থাকি। সাধারণত (অজানা বড় কোন রোগ না থাকলে) এইসব ঔষধে বড় কোন সমস্যা নেই। কোন এন্টি-হিস্টামিন কার জন্য ভালো/প্রযোজ্য, সেটা অন্তত একবার কোন চিকিৎসকের সাথে আলাপ করে নিলে ভালো।
-এন্টি-বায়োটিকঃ ডাক্তারের কাছে যাবার সময়ের অভাব কিংবা এ জাতীয় ঝামেলার কথা ভেবে আমরা নিজেরা অনেকে এন্টিবায়টিক কিনে খেয়ে ফেলি। ঔষধের দোকানীরা, গ্রাম চিকিৎসকেরাও এন্টি-বায়োটিকের অত্যধিক এবং অপ্র্যোজনীয় ব্যাবহার করে থাকেন। সাধারণ সর্দি-কাশিতে এন্টি-বায়োটিক কোন সুফল দেয় না, বরং দামী এইসব ঔষধ কিছুক্ষেত্রে পাশ্বপ্রতিক্রিয়া করতে পারে। অল্প সর্দি-কাশি সাধারণতঃ ১ সপ্তাহের কম থাকলে এন্টি-বায়োটিক দেয়া হয় না। কেউ যদি মনে করেন এন্টি-বায়োটিক খাবার মত কিছু হইয়েছে, ডাক্তার দেখিয়ে খাওয়াটাই ভালো। অন্ততপক্ষে বন্ধুবান্ধব কেউ ডাক্তার থাকলে ফোনে হলেও জিজ্ঞেস করে নিতে পারেন। (ডাক্তারি মতে অবশ্য ফোনকলে চিকিৎসা উৎসাহিত করা হয় না।)।
-ভিটামিন-সিঃ সর্দি-কাশি সহ আরো কিছু রোগ প্রতিরোধে ভিটামিন-সি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ঔষধছাড়াও কমলা-জাতীয় ফলে ভিটামিন-সি পাওয়া যায়। তবে অল্প খেলেই চলবে। ভিটামিন-সি বেশী খেলে বড় কোন বিপদ নেই; তবে মাত্রাতিরিক্ত খেতে থাকলে দাঁতের ক্ষতি করতে পারে। এসিড-জাতীয় সব খাবারই (আমাদের পানীয় কোলাগুলো বেশী ক্ষতিকারক) বেশী খেলে দাঁত ক্ষয় হয়।
ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকাঃ কয়েক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য টীকা পাওয়া যায়। অনেক দেশের হাসপাতালে কাজ করতে গেলে এগুলো নেয়া বাধ্যতামূলক। এছাড়া ঝুকিপূর্ণ মানুষের জন্যও এটা নেয়া উচিৎ। সাধারণ মানুষও এটা নিতে পারেন। (দেশের নামী-দামী হাসপাতালগুলোতে এটা পাওয়া যাবার কথা।)
চিকেন পক্সের টিকাঃ শিশু কিংবা যাদের এখনো চিকেন পক্স হয়নি, কিংবা কোন কারণে যাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তারা এই টিকা নিতে পারেন।
৬) হাঁচি-কাশি আসলে (মাস্ক না থাকলে) রুমাল ব্যাবহার করা উচিৎ। রুমাল বের করার সময় না পেলে হাতের কনুই-এর ভাঁজে হাঁচি দিলে সেটা আশে-পাশের লোকদের মধ্যে ছড়াবে না। (হাতের তালুতে হাঁচি দেয়া উচিৎ নয়। কারণ একটু পরেই এই হাত দিয়ে কারো সাথে হাত মিলাবেন, কিংবা বাচ্চাকে আদর করবেন।)
সর্বরোগের মহৌষধঃ
-খাদ্যাভ্যাসঃ এটা মেনে চলা কঠিন। তবুও, আমাদের দৈন্যন্দিন খাবারে কিছু ফম-ফলাদি কিংবা সালাদ জাতীয় খাবার রাখলে শরীর অনেক প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং এন্টি-অক্সিডেন্ট পায়; এগুলো রোগপ্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে।
-হাত ধোয়াঃ প্রচলিত ধারণা হচ্ছে শুধু খাবার আগে এবং টয়লেটের পর হাত ধোয়া। কিন্তু বাইরে থেকে ঘরে ফিরে হাত ধুয়ে নিলে হাত ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মত জীবাণুও পরিস্কার করে ফেলা সম্ভব। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে অনেক রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচা যায়।
- ধুমপান পরিহারঃ এটা করা আরো একটি কঠিন কাজ। ধুমপানে শুধু শ্বাসতন্ত্রেরই নয়, ক্যান্সারসহ আরো অনেক রোগের হার বেড়ে যায়।
যেসব লক্ষণ দেখলে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিতঃ
১) সর্দি-কাশির সাথে উচ্চজ্বর।
২) কফ (sputum)-এর মধ্যে বাজে গন্ধ পাওয়া গেলে।
৩) কফের সাথে রক্ত আসলে।
৪) শ্বাসকষ্ট, বুকব্যথা হলে।
৫) মাথা ব্যথা থাকলে।
৬) ৭ দিনের বেশী সর্দি-কাশি থাকলে।
—————-
যারা ধৈর্য্য ধরে এতটুকু পড়ে ফেলেছেন, তাদেরকে একটা অনুরোধ।
এবার বাংলাদেশে খুবই শীত পড়েছে। যাদের পক্ষে সম্ভব, আশেপাশের (কিংবা সম্ভব হলে উত্তরাঞ্চলের) গরীব মানুষদেরকে কিছু শীতের কাপড় দিয়ে সাহায্য করা উচিৎ। আমাদের এক-একজনের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাই হয়তো কয়েকটি মানুষের দুর্ভোগ কমাতে পারে, কিংবা হয়ত বাঁচাতে পারে দু-একটি মানব জীবন।
-সাদ হাবিব । এমবিবিএস, পিএইচডি।
ভিজিটিং প্রফেসর, নিউরোসার্জারী, টোকিও মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল ইউনিভার্সিটি।
আমার সরদি লেগেই থাকে...বিসেসজ্ঞ ডাক্তার দেখাইছি।কিন্তু কোন উপকার হচ্ছে না। টেস্ট ও করায়ছি সব নরমাল।
ReplyDeleteMr.Al,
ReplyDeleteশারীরিক যেকোন সমস্যার পেছনে বিভিন্ন রোগ থাকতে পারে।
আমরা ডাক্তাররা প্রথমে বেশী হয় (common diseases) এমন রোগের কথা মাথায় রেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাই।
অনেক টেস্টই ব্যায়বহুল। ফলে কিছু টেস্ট করার পর আস্তে আস্তে uncommon disease গুলোর দিকে আগানো হয়।
আবার কয়েকটা টেস্টের মাধ্যমেই কিন্তু সব সময় সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না।
আপনার সর্দির লক্ষণ এবং টেস্টের ব্যাপারে না দেখে মন্তব্য করা যাবে না।
সব রোগ যে নিরাময়যোগ্য-তা কিন্তু নয়। অনেক সময় রোগ কন্ট্রোলে রাখতে হয়।
আবার হয়ত ক্ষেত্রবিশেষে এমনিতেও অনেক অসুখ সেড়ে যায়।
সম্ভব হলে অন্য কোন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন।
নাক-কান-গলা-তে আমার একজন শিক্ষককে বেশ যত্নবান ডাক্তার হিসেবে মনে করি, আপনি চাইলে তাঁকে দেখাতে পারেনঃ
(প্রফেসর খবিরউদ্দিন। ২০০৮ সাল পর্যন্ত উনার সম্পর্কে আমার কাছে যা তথ্য আছেঃ অধ্যাপক, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ। চেম্বারঃ ইবনে সিনা, জিগাতলা বিডিআর গেইটের কাছে)