Sunday, December 30, 2012
ওয়াটার ফলস এর ছোট গল্প [এক]
গত তিন দিন আকাশের অবিরাম ক্রন্দন দেখে কে বলবে এখন অক্টোবরের পোস্ট মনসুন পিরিয়ড চলছে? ৭২ ঘন্টা ধরে ভানলাল দা'র জুমে আমরা দু'জন আঁটকা পরে আছি। প্রতিদিনই ভাবি আজকে হয়ত মেঘ কেঁটে যাবে আর আমরা নীচে নেমে প্রয়োজনীয় ডাটা গুলো কালেক্ট করতে পারব। কিন্তু প্রকৃতি আমাদের এই ইচ্ছার সাথে তিন দিন ধরে একমত হতে পারছে না। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। শুধু খাই দাই ঘুমাই। প্রতিদিন পালা করে একজন ৩০০মিটার নিচে নেমে ঝিঁড়ি থেকে খাবার পানি নিয়ে আসি। সারভাইভাল টেকনিকে দিয়াশলাই/লাইটার ছাড়া সারাদিন ধরে আগুন জ্বালানো প্র্যাকটিস করি। কষ্ট সবচেয়ে বেশী হয় রাতের বেলা। ঝুম বৃষ্টির মধ্যেই বাধ্য হয়ে সারা শরীরে পলিথিন পেঁচিয়ে মাচায় কোন রকমে রাত কাটাতে হচ্ছে। জুম ঘর ভর্তি নতুন কাঁটা ধান। ধানের সাথে সাথে হাজার রকমের পোকা ফ্রী। পোকার কামড়ে অতিষ্ঠ হওয়ার চাইতে বৃষ্টির ছাঁট গায়ে লাগানো আমাদের জন্য বেশী আরামদায়ক ছিল।
আজকে সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। রাতের ঘন কালো মেঘ গুলো এখন থোকা থোকা হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমরা তাড়াতাড়ি মাম এর ৫ লিটার এর বোতল, কম্পাস, স্টপ ওয়াচ,রশি, জিপিএস আর হাবিজাবি নিয়ে নীচে নামা শুরু করলাম। আজকে যেভাবেই হোক ডাটা সংগ্রহ করতেই হবে। বাংলাদেশের ওয়াটার ফল গুলোকে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত করতে ডি-ওয়ে এক্সপেডিটর্স এর "হান্ট ওয়াটার ফল" নামে একটা প্রজেক্ট আছে। বিভিন্ন ঋতুতে ওয়াটার ফল গুলোর ফ্লো, এক্টিভ সোর্স, চারপাশের ভূ-প্রাকৃতিক গঠন ইত্যাদি হাবিজাবি ডাটা সংগ্রহ করতে হান্ট ওয়াটার ফল প্রজেক্টের এক্সটেন্ডেড এক্সপিডিশনে বাকলাই এসেছি আমি আর মাইনুল ভাই। জুমের রাস্তা দিয়ে নামতে নামতে এক সময় রাস্তা শেষ হয়ে গেল। এরপর ঝুড়া মাটির লম্বা একটা ঢাল শুরু হয়ে গেছে। কয়েকদিনের ঝুম বৃষ্টিতে সব কাঁদা হয়ে আছে। সাবধানে নামা শুরু করতেই দেখি মাটি ধসে যাচ্ছে। মাইনুল ভাই ব্যাগ থেকে ১০০ফিট রশি বের করে গাছের সাথে বেঁধে দিল। এত ভারি একটা রশি ক্যারি করতে দেখে মনে মনে আবারও স্বীকার করলাম-মাইনুল ভাই আসলে মানুষ না। আস্ত একটা অমানুষ!
রশি ধরে রেপেলিং করে একজন একজন করে নিচে নামা শুরু করলাম। ১০০ফিট শেষ হতেই দেখি বাকলাই ফলস এর স্ট্রীম আরও প্রায় ৫-৭ফিট নীচে। এখানে পাহাড়ে ধসে পুরা নম্বর ডিগ্রি হয়ে আছে। পাথরে বাড়ি খাইলে খাইলাম, যা আছে কপালে চিন্তা করে ঝিড়ির উপর দিলাম লাফ। মাইনুল ভাই নামতেই আমরা ঝিড়ি ধরে উপর দিকে এগুতে লাগলাম। ১০ মিনিট ও গেল না, কোথা থেকে যেন এক ঝাঁক কালো মেঘ পুরো আকাশ ঢেকে ফেলল। শুরু হল অঝোরে বৃষ্টি। ধীরে ধীরে ঝিঁড়ির পানি বাড়তে লাগল। শান্ত হয়ে বয়ে চলা প্রসবন এখন উত্তাল হয়ে চাপা গর্জন শুরু করল। মাইনুল ভাই এর অভিজ্ঞ চোখে মুহুর্তেই অবস্থার ভয়াবহতা ধরা পরল। "তাড়াতাড়ি উপরে উঠ। যে কোন সময় ঢল নামতে পারে। একটা ধাক্কা খাইলে আর তাল রাখা যাবে না". দু'জন আবার দৌড়ে উপরে উঠা শুরু করলাম। রশি ধরে এইবার জুমারিং করার সময় কাঁডায় পা দেবে যাচ্ছে। হাঁটু পর্যন্ত কাঁদা থেকে পা টেনে টেনে উপরে উঠতে অনেক কষ্ট হচ্ছিলো আমার। কুকুরের মত হাঁফাতে হাঁফাতে দু'জন যখন মাঁচায় ফিরে আসতেই ভোজবাজীর মত বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল। রাগ, কষ্ট, দুঃখ আর হতাশা নিয়ে বাক্লাই এর দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বিস্ময়ে বিমূঢ হওয়া যাকে বলে। বাকলাই এর এই রকম পাগলা ভয়ানক চেহারা দেখব আশা করি নাই কখনো। আর তার গর্জন এর কথা আর নাই বা বলি। আমার লেখা বা ছবি কোন টাই সেই হুংকার কে রিপ্রেজেন্ট করতে পারবে না।
এক্সপিডিসনঃ সর্বোচ্চ ঝর্নার খোঁজে [২০১০]
বাকলাই ফলস
বাকলাই, বান্দরবান।
Labels:
Travel
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
হিংসা হচ্ছে ভাই, ভীষণ হিংসা হচ্ছে - কবে যে এইসবের জন্য জীবন থেকে ছুটি পাবো ?
ReplyDelete"সারভাইভাল টেকনিকে দিয়াশলাই/লাইটার ছাড়া সারাদিন ধরে আগুন জ্বালানো প্র্যাকটিস করি।" - শেষতক আগুন কি জ্বালাতে পেরেছেন? Discovery channel থেকে ওটাকে আমাদের রিয়ালিটি তে নিয়ে আসতে পারলে কিন্তু দারুন ব্যাপার হয়।
ইচ্ছা থাকলেই কিন্তু উপায় হয়। :)
ReplyDeleteঅনেক কষ্টের পর একবার আগুন জ্বালাতে পেরেছিলাম। পরে অবশ্য বেশ কয়েকবার এভাবে আগুন জ্বালাতে হয়েছে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে :) ব্যাপার টা আসলেই কিন্তু দারুন।