সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবন শুরু করেছি। সব মিলিয়ে দু'সপ্তাহের মতো ক্লাস হয়েছে। পরিচালক ম্যাডাম যথারীতি ক্লাস নিচ্ছিলেন। হঠাৎ করে একজন শিক্ষক এসে জানালেন নিউমার্কেটের দিক থেকে গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সম্ভবত বিডিআরে গোলাগুলি হচ্ছে। মূহুর্তে ক্লাসজুড়ে গুঞ্জন শুরু হলো। এক সহপাঠী দাঁড়িয়ে ম্যাডামের কাছে জানতে চাইলো বিডিআরে 'ফ্রেন্ডলি ফায়ার' হচ্ছে কিনা! এ ধারণা সে কোথায় পেয়েছিল আজও জানতে পারি নি। একটু পরে শুনলাম বিডিআর জওয়ানরা নাকি বিদ্রোহ করেছে। শিক্ষকরা মিলে আলোচনা করে আমাদের ছুটি দিয়ে দিলেন। সদ্য সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল শেষ হয়েছে। মনে অজানা আতঙ্ক। রাস্তাঘাটে নানান উড়ো খবর পাচ্ছি। কেউ বলছে কোন জেনারেলকে নাকি মেরে ফেলা হয়েছে। পাবলিক এত তথ্য কোথায় পাচ্ছে জানা নেই। যেকোনো সময় সামরিক বাহিনী মাঠে নামবে। ক্যু হওয়ার আশঙ্কা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউ মার্কেট হয়ে আমাকে বাড়ি ফিরতে হয়। ঝুঁকি এড়াতে শাহবাগ দিয়ে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ব্যবহার করি না। হুড়োহুড়ি করে কোনোমতে একটা বাসে উঠলাম। তিল ধারণের জায়গা নেই সেখানে। চারুকলার সামনে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ বাছবিচার না করেই বাসে উঠতে চাইছে। জানের মায়ায় সবাই অস্থির তখন। কেউ উঠতে পারলো, কেউ পারলো না। অতঃপর বাসে করে কারওয়ান বাজার মোড়ে নেমে গেলাম। সেখানে রিকশা,বাস কিছু না পেয়ে দ্রুত পা চালিয়ে রাসেল স্কয়ারের দিকে এগিয়ে চললাম। একটু একটু বালু ঝড়ের মতোও হচ্ছিল। সবাই তাড়াহুড়ো করছে। সকলের উদ্দেশ্য নিরাপদে ঘরে ফেরা। দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। বাসায় ফিরে দেখলাম ইতিমধ্যে টিভি ছেড়ে খবর দেখছে সবাই। বাংলাদেশের সবগুলো চ্যানেলে তখন একই খবর। বিডিআর বিদ্রোহ। টিভির পর্দায় বিডিআর সদর দফতরের ২ নং গেটের সামনের চিত্র সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে। মুখে রুমাল ও গামছা বাঁধা বিডিআর সৈনিকরা অসংগঠিতভাবে অস্ত্র উঁচিয়ে অবস্থান নিয়েছে। আশে পাশের উঁচু ভবনের ছাদ থেকেও চিত্র গ্রহণ করা হচ্ছে। আতঙ্কের মাঝে সময় গড়াতে থাকলো। একসময় দেখলাম সাংবাদিকরা গেটের সামনে মুখঢাকা জওয়ানদের সাক্ষাতকার নিচ্ছেন। বিদ্রোহী জওয়ানরা তাদের ওপর অফিসার কর্তৃক শোষণ-নিপীড়নের অভিযোগ করছে। তাদের দাবি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের তারা অফিসার হিসেবে চান না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হওয়া তরুণরা তাদের অফিসার হবেন। অপারেশন চাল-ডাল নিয়ে তারা অভিযোগ করছে। সকলের সহানুভূতি তখন জওয়ানদের প্রতি। সদ্য বিদায়ী সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি লানত করতে লাগলো সকলে। সামরিক বাহিনী ও সামরিক কর্মকর্তাদের প্রতি সাধারণ মানুষ ও সুশীল সমাজের সে কি ঘৃণা তখন!
বিকেলে অকুস্থলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তাদের আগমন। জনপ্রতিনিধিরা ঘর্মাক্ত অবস্থায় হাত-মাইকে জওয়ানদের অস্ত্র সমর্পন করার আহ্বান জানাচ্ছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জরুরি ভাষণ তখন চ্যানেলে চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সাধারণ মানুষকে আহ্বান জানালেন এলাকা ছেড়ে চলে যেতে। মাইকিং হলো। সকলে আশঙ্কা করতে লাগলো সেনা কমান্ডোরা হয়তো পিলখানায় আক্রমণ চালাবে। এভাবে রাত পার হয়ে গেল। পরদিন একই পরিস্থিতি। মিডিয়ার মাধ্যমে বিডিআর জওয়ানরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনার আহ্বান জানালো। তাদের একটি প্রতিনিধি দল অবশেষে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের বৈঠক করলো। কিছু শর্ত মানলেই কেবল তারা অস্ত্র সমর্পন করবে। শর্তগুলো মধ্যে ছিল বিদ্রোহের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতে হবে, অস্ত্র তারা সমর্পন করবে পুলিশের কাছে কিন্তু কোনোভাবেই সেনাবাহিনী সেখানে থাকতে পারবে না ইত্যাদি। এরপর ধাপে ধাপে বিডিআর কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের ছাড়া হলো। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও সৈনিকরা উল্লেখ করেনি যে ৫৭ জন কর্মকর্তাকে তারা হত্যা করেছে নির্মমভাবে। তখন পর্যন্ত তাদের প্রতিই জনসমর্থন ছিল। অস্ত্র সমর্পণ করার পর যখন পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা ভেতরে প্রবেশ করলো তখন থলের বেড়াল বের হলো। প্রতিদিন উদ্ধার হতে থাকলো নিহত কর্মকর্তাদের লাশ। বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক ও তার স্ত্রীর মৃতদেহ পাওয়া গেল ক’দিন পরে। বিদ্রোহের নামে সেখানে ঘটে যাওয়া নারকীয় হত্যাকাণ্ড ধীরে ধীরে উন্মোচিত হলো।
দিনটি ছিল ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯। আজও ২৫ ফেব্রুয়ারি। তবে ২০১৪ সাল। আমাদের রাইফেলস বাহিনীর ওপর কালিমা লেপনের ৫ম বার্ষিকী। আমাদের গর্বের বাহিনীটিকে ধ্বংস প্রচেষ্টার ৫ম বার্ষিকী। আমাদের রাইফেলস কর্মকর্তাদের দুনিয়া থেকে বিদায় নেবার ৫ম বার্ষিকী। তাদের পরিবারগুলোর স্বামীহারা, পিতাহারা হবার ৫ম বার্ষিকী। দীর্ঘদিন এ ন্যাক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের বিচার পরিচালিত হয়েছে। রায়ও হয়েছে। এখনো বিচার প্রক্রিয়া উচ্চ আদালতে চলমান। শুধুমাত্র অসন্তোষের কারণে বিডিআর জওয়ানরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা বিশ্বাস করা অসম্ভব। কর্মকর্তারা তাদের অধীনস্ত সদস্যদের পরিশ্রম করায় কিন্তু তাদের মাঝে অদ্ভুত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সম্পর্কও থাকে সমান্তরালভাবে। কোনো সৈনিক তার অফিসারকে এভাবে হত্যা করতে পারে না। আমরা দেখেছি সেনা কর্মকর্তাদের মৃত্যুর পর সাধারণ সৈনিকদের চোখের জল ফেলতে। একজন কর্মকর্তা প্রথমে সৈনিক পরে কর্মকর্তা। আমাদের রাইফেলস বাহিনী, আমাদের আমাদের গর্ব ছিল। বাহিনীটি ধ্বংস হয়ে গেল। তার নাম বদলে গেল। পরিবর্তন ঘটলো তার পোশাকের। ধারণা করা হয় এ ঘটনার পেছনে বহির্বিশ্বের গোয়েন্দা সংস্থার হাত রয়েছে। নিজ বাহিনীর একজন সিপাহি তার কর্মকর্তার বুকে নিছক অসন্তোষের বশে ছুরি ধরতে পারে না। এর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে বলেই শোনা যায়। এর সত্যতা হয়তো মিলবে কিয়ামতের সময়, হাশরের ময়দানে। ইতিহাসে এরকম ঘটনা আর যেন না ঘটে সে কামনাই রইলো।
ছবি কৃতজ্ঞতা: আমারব্লগ
Tuesday, February 25, 2014
বিডিআর বিদ্রোহ: এখনো কাঁদায়
Labels:
২৫ ফেব্রুয়ারি,
অধ্যায়,
কলঙ্ক,
জওয়ান,
পিলখানা,
বর্ডার গার্ড,
বিডিআর,
বিডিআর বিদ্রোহ,
বিদ্রোহ,
সেনাবাহিনী
Friday, February 21, 2014
শহীদের রক্তের দামে কেনা বাংলা ভাষা
“তপুকে এভাবে ফিরে পাবো ভাবি নি... আমি, তপু ও রাহাত...”। জহির রায়হানের একুশের গল্পের দু’টি বাক্যের কথা বললাম। প্রথম বাক্যটি সম্ভবত গল্পের প্রথম বাক্য। আর পরের বাক্যটি বেশ কয়েকবার গল্পে এসেছে। আমরা সবাই জানি, একুশের গল্প আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত। ৯ম-১০ম শ্রেণিতে “হাজার বছর ধরে’ পড়ে যতটা বিরক্ত হয়েছিলাম উচ্চ মাধ্যমিকে ‘একুশের গল্প’ পড়ে ততটাই বিমুগ্ধ হয়েছি। সম্ভবত এটি আমার জীবনের পড়া শ্রেষ্ঠ গল্পগুলোর একটি। ৫২ এবং ৭১ আমাদের ইতিহাসের সবচাইতে বড় দু’টি ঘটনা। এ ঘটনাদ্বয়ের বদৌলতে আজকের বাংলাদেশ, আজকের বাংলা ভাষা, আজকের বাংলাদেশের বাংলা ভাষা। ইতিহাস ও বর্তমান বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে দেখতে পাই আমাদের ৫২, ৭১ এর চেয়ে অধিক সফল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি লাভ করে। ভাষা শহীদদের রক্তের পুরোটাই সফল। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের রক্তের পুরোটা আমরা এখনো সফল করতে সক্ষম হই নি। স্বাধীনতা বিরোধী অপরাধীদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করতে পারি নি। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও অসভ্যতামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারি নি। কিন্তু মাতৃভাষার আন্দোলনে আমরা পুরোটাই সফল। আমাদের এই ভাষা এতটাই সফল যে ভাষার প্রতি আগ্রাসনের নানান অপচেষ্টা কখনোই মুখ তুলে দাঁড়াতে পারে না। তবে ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল না। মাতৃভাষায় লিখতে পড়তে পারার অধিকার আদায়ও এর অন্যতম লক্ষ্য। সে প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বাংলা ব্যতীত অন্য ভাষাভাষীদের জন্য মাতৃভাষায় লেখাপড়া করার সুযোগ আমরা স্থায়ীভাবে সৃষ্টি করতে সক্ষম হই নি। প্রচেষ্টা চলছে।
বছর দুই-তিনেক আগে কোনো একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের এক প্রতিবেদনে ভয়াবহ কিছু বিষয় দেখেছিলাম। প্রতিবেদনে বিচ্ছিন্নভাবে রাস্তাঘাটে বিভিন্ন বয়সী মানুষকে একুশে ফেব্রুয়ারী সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। বেশ ক’জন বাঙালীর উত্তর ছিল ভয়াবহ। একুশে ফেব্রুয়ারী নাকি আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম। আরেকজনের উত্তর ছিল “শহীদ মিনারে আমরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে ফুল দিতে যাই”। ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ দু’টি ভিন্ন ঘটনা। এ তথ্য বয়ঃপ্রাপ্ত বাংলাদেশিদের অজানা থাকাটা লজ্জাজনক। বর্তমানে একুশে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এতই নাম করেছে যে ঐদিনটি যে আমাদের শহীদ দিবস তা অনেকেই চট করে বলতে ব্যর্থ হন। আমার কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারী প্রথমে শহীদ দিবস পরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
চায়না এবং সৌদি আরবে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল বিগত কয়েক বছরে। একজন চাইনিজ বা সৌদি নাগরিক আমাকে দেখলে খুব সহজেই ধরতে পারবেন যে আমি তাদের কাছে বিদেশি। কিন্তু দেখা মাত্র তারা কথা বলা শুরু করবেন নিজের ভাষায়। অনেকে মনে করতে পারেন যে ইংরেজি না জানায় তারা নিজেদের ভাষায় কথা শুরু করে কিন্তু এ ধারণা সব সময় সঠিক নয়। ইংরেজি পারলেও নিজের ভাষাতেই তারা কথা শুরু করে। তার ভাষা না জানার অপারগতা প্রকাশ করলেই শুধুমাত্র তারা ইংরেজি বলে। আর তাদের মাঝে যারা ইংরেজি জানে না তাদের এ নিয়ে কোনো লজ্জা নেই। দুইজন চাইনিজ, দুইজন আরব এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবওয়েতে দু’জন সাদা চামড়ার আমেরিকান নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষায় কথা বলেন। আমি নিজের কানে শুনেছি। আর নিজের দেশে একটু অভিজাত রেঁস্তোরায় গেলে ওয়েটারের কাছে শুনতে হয়, “স্যার, ওয়ার্ডার প্লেস করবেন?” “হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ স্যার?” এই লজ্জা কোথায় রাখি? দু’জন বাঙালী নিজেদের মধ্যে অন্য ভাষা কেন ব্যবহার করবে? ওয়েটারের কি দোষ। তার মালিকের নির্দেশ।“ ইংরেজি বলবি। স্ট্যান্ডার্ড বাড়বে। পাবলিক হাই ফাই ভাববো”। বাদামি চামড়ার বাঙালী খাওয়ার দোকানে গেলে ফুটুং ফাটুং ইংরেজিতে “ফুড অর্ডার” করে। খাওয়া শেষে ওয়েটারও বলে “স্যার ‘ফুড’ কেমন ছিল?” খাদ্য, খাবার শব্দগুলো নিশ্চয়ই তখন লজ্জা পায়। ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসন, সে কি ভোলা দায়?
আজ একুশে ফেব্রুয়ারী। শহীদ দিবস। ১৯৫২ সালের এই দিনে আবদুস সালাম, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমান প্রমুখ ভাষা সৈনিক শাহাদাত বরণ করেন। তারা আমাদের ভাষা শহীদ। ভাষা সৈনিক গাজীউল হক, আবদুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ হলেন ভাষা সৈনিক যারা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাদের মাঝে ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন এখন পর্যন্ত বেঁচে আছেন। একটা সময় আসবে যখন আর কোনো ভাষা সৈনিক জীবিত থাকবেন না। আসুন, জীবদ্দশায় তাদের প্রাপ্য সম্মান দিই। নিজের ভাষায় শুদ্ধ করে কথা বলি। নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় ভিনদেশি ভাষা পরিহার করি। নিজের ভাষার ওপরে বড় করে ইংরেজি লিখে রাখা কোনো গৌরবও নয়, কৃতিত্বও নয়।
ছবি কৃতজ্ঞতা: বিভিন্ন ওয়েবপেইজ
বছর দুই-তিনেক আগে কোনো একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের এক প্রতিবেদনে ভয়াবহ কিছু বিষয় দেখেছিলাম। প্রতিবেদনে বিচ্ছিন্নভাবে রাস্তাঘাটে বিভিন্ন বয়সী মানুষকে একুশে ফেব্রুয়ারী সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। বেশ ক’জন বাঙালীর উত্তর ছিল ভয়াবহ। একুশে ফেব্রুয়ারী নাকি আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম। আরেকজনের উত্তর ছিল “শহীদ মিনারে আমরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে ফুল দিতে যাই”। ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ দু’টি ভিন্ন ঘটনা। এ তথ্য বয়ঃপ্রাপ্ত বাংলাদেশিদের অজানা থাকাটা লজ্জাজনক। বর্তমানে একুশে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এতই নাম করেছে যে ঐদিনটি যে আমাদের শহীদ দিবস তা অনেকেই চট করে বলতে ব্যর্থ হন। আমার কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারী প্রথমে শহীদ দিবস পরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
চায়না এবং সৌদি আরবে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল বিগত কয়েক বছরে। একজন চাইনিজ বা সৌদি নাগরিক আমাকে দেখলে খুব সহজেই ধরতে পারবেন যে আমি তাদের কাছে বিদেশি। কিন্তু দেখা মাত্র তারা কথা বলা শুরু করবেন নিজের ভাষায়। অনেকে মনে করতে পারেন যে ইংরেজি না জানায় তারা নিজেদের ভাষায় কথা শুরু করে কিন্তু এ ধারণা সব সময় সঠিক নয়। ইংরেজি পারলেও নিজের ভাষাতেই তারা কথা শুরু করে। তার ভাষা না জানার অপারগতা প্রকাশ করলেই শুধুমাত্র তারা ইংরেজি বলে। আর তাদের মাঝে যারা ইংরেজি জানে না তাদের এ নিয়ে কোনো লজ্জা নেই। দুইজন চাইনিজ, দুইজন আরব এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবওয়েতে দু’জন সাদা চামড়ার আমেরিকান নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষায় কথা বলেন। আমি নিজের কানে শুনেছি। আর নিজের দেশে একটু অভিজাত রেঁস্তোরায় গেলে ওয়েটারের কাছে শুনতে হয়, “স্যার, ওয়ার্ডার প্লেস করবেন?” “হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ স্যার?” এই লজ্জা কোথায় রাখি? দু’জন বাঙালী নিজেদের মধ্যে অন্য ভাষা কেন ব্যবহার করবে? ওয়েটারের কি দোষ। তার মালিকের নির্দেশ।“ ইংরেজি বলবি। স্ট্যান্ডার্ড বাড়বে। পাবলিক হাই ফাই ভাববো”। বাদামি চামড়ার বাঙালী খাওয়ার দোকানে গেলে ফুটুং ফাটুং ইংরেজিতে “ফুড অর্ডার” করে। খাওয়া শেষে ওয়েটারও বলে “স্যার ‘ফুড’ কেমন ছিল?” খাদ্য, খাবার শব্দগুলো নিশ্চয়ই তখন লজ্জা পায়। ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসন, সে কি ভোলা দায়?
আজ একুশে ফেব্রুয়ারী। শহীদ দিবস। ১৯৫২ সালের এই দিনে আবদুস সালাম, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমান প্রমুখ ভাষা সৈনিক শাহাদাত বরণ করেন। তারা আমাদের ভাষা শহীদ। ভাষা সৈনিক গাজীউল হক, আবদুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ হলেন ভাষা সৈনিক যারা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাদের মাঝে ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন এখন পর্যন্ত বেঁচে আছেন। একটা সময় আসবে যখন আর কোনো ভাষা সৈনিক জীবিত থাকবেন না। আসুন, জীবদ্দশায় তাদের প্রাপ্য সম্মান দিই। নিজের ভাষায় শুদ্ধ করে কথা বলি। নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় ভিনদেশি ভাষা পরিহার করি। নিজের ভাষার ওপরে বড় করে ইংরেজি লিখে রাখা কোনো গৌরবও নয়, কৃতিত্বও নয়।
ছবি কৃতজ্ঞতা: বিভিন্ন ওয়েবপেইজ
Labels:
১৯৫২,
একুশে,
একুশে ফেব্রুয়ারী,
দায়শোধ,
বায়ান্ন,
বাংলা,
ভাষা আন্দোলন,
ভাষা শহীদ,
ভাষা সৈনিক
Friday, February 14, 2014
উৎসবমুখর ফেব্রুয়ারী আর উৎসবপ্রিয় আমরা
আসলেই উৎসবের মাস ফেব্রুয়ারী। সহনীয় শীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ভাষার এ মাসটি। পহেলা ফেব্রুয়ারী থেকেই একুশে বইমেলার মাধ্যমে শুরু হয় উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। বইমেলাকে ঘিরে চারিদিকে সাজ সাজ রব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা জুড়ে উৎসবের আমেজ। সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রাণের আড্ডা জমে ওঠে টিএসসিতে। দিন যত যেতে থাকে, উৎসবের আমেজ যেন ততই বৃদ্ধি পায়। ১৩ই ফেব্রুয়ারীতে থাকে বসন্তের উদ্বোধন। প্রতি বছরই বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পহেলা বসন্ত উদযাপিত হচ্ছে। বর্তমানে বসন্ত বরণের উৎসব প্রায় পহেলা বৈশাখের মতো। পার্থক্য একটাই। এদিন সরকারি ছুটি থাকে না। বইমেলা আর বসন্ত বরণ একাকার হয়ে মহোৎসবে পরিণত হয়। পহেলা ফাল্গুনের পরের দিন আবার ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসা দিবসের কোনো বঙ্গীয় সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ভিত্তি না থাকলেও এর কলেবরই সর্বাধিক। হাজারো তরুণ-তরুণী অপেক্ষা করে থাকে দিনটির জন্য। আর ২১শে ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দিনটি একই সাথে শোক ও আনন্দের। শোক শহীদদের জন্যে, আর আনন্দ নিজের ভাষায় কথা বলার স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে।
মানুষের জীবন এখনে ব্যস্ততার কোনো শেষ নেই। এর মাঝে রয়েছে হাজারো নাগরিক দুর্ভোগ। তাই উৎসবের কোনো উপলক্ষই বাঙালী ছাড়তে রাজি নয়। উৎসব মানেই প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানো। বসন্ত, ভ্যালেনটাইন, শহীদ দিবস- প্রেমের জন্য বাদ পড়ে না কোনোদিনই। ১৩ ফেব্রুয়ারী হলুদ পোশাকে, ১৪ ফেব্রুয়ারী লাল পোশাকে আর ২১ ফেব্রুয়ারীতে সাদা কালো পোশাকে প্রেমলীলা অনুষ্ঠিত হয়। গান-বাজনা, প্রাণ-মোজো-এয়ারটেল, ফুল-লতা-পাতা আর সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া দেয়ার ব্যবসাটা বেশ ভালোই চলে এ মাসে। সাথে বাঁশ আর প্যান্ডেল তো রয়েছেই। নগরের উৎসবের ছোঁয়া নগরের চেয়ে ফেসবুকে কম পড়ে না। হোম পেইজের নিউজ ফিডে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত উৎসব। লাল-হলুদের ছবিতে ভরপুর। নানান ঢঙে, নানান পোজে, নানান ভঙ্গিমায় ছবি। বন্ধুদের সাথে, বিশেষজনের সাথে, আত্মীয়ের সাথে। লাইক-কমেন্টের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে সব। বাস্তব আর ডিজিটাল জীবনে উৎসবের ঢেউ বয়ে চলছে।
বাঙালী আমোদপ্রিয় জাতি। যেকোনো ছুঁতোয় চমৎকারভাবে সাজিয়ে ফেলতে পারে চারপাশ। বর্ণিল সাজে সজ্জিত হয়ে আনন্দ, হৈচৈ শুরু করে দিতে পারে। কোনো কাল বা সময়ে তারা আটকা পড়ে না। লালন, হাসন থেকে শুরু করে মুন্নি-শীলা সবই তারা শ্রবণ করে। মীলা নাচলেও তারা আমোদ পায়, আবদুল কুদ্দুস বয়াতীকেও তারা ভালো পায়। নগরে উৎসবের হাওয়া লাগে। রঙিন পোশাকে ফেব্রুয়ারী জুড়ে চলে রিকশায় চড়ে নগর ভ্রমণ। যানজট কিংবা যানবাহনের অপ্রতুলতা তাদের আনন্দকে বিন্দুমাত্র ম্লান করতে পারে না। পাঞ্জাবী পরা পুরুষ আর শাড়ি পরা নারী হাতে নোকিয়া ১৬০০ কিংবা গ্যালাক্সি এস থ্রি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মহানগরীর বুকে। ঘুরে বেড়ায় রাজপথ দিয়ে, বিশ্রাম নেয় ছায়াঘেরা সুশীতল ধানমন্ডি লেক বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে। মোজো-ফ্রুটো-এয়ারটেলের ভালোবাসা বিক্রির কনসার্টে মাইলস, সোলসের সাথে চলে নীলা-শীলাদের নর্তন-কুর্দন। আনন্দে মাতে যুবক-যুবতী। সঙ্গীতের তালে তালে চলে বসন্ত আর ভালোবাসাকে বরণ করা। মাসজুড়ে চলা বইমেলাকে কেন্দ্র করে চলে সুশীল ভালোবাসা। লম্বা চুল আর জট ধরা দাঁড়িতে পাঞ্জাবী পরা সুশীল পুরুষ আটসাঁট শাড়ির সুশীল নারীর সাথে গদ্য সমালোচনায় মেতে ওঠে। একুশ ও বাঙালী চেতনা নিয়ে বয়সের ভারে নুহ্য বুদ্ধজীবী “কল-রেডী” লেখা মাইক্রোফোনের সামনে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে ফেলেন। চারুকলাসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগের ছেলেমেয়েরা রাস্তা আর দেয়ালজুড়ে তৈরি করে মনোরম সব নকশা। ফেব্রুয়ারী যেন প্রস্তুতি আর পরিণতি ১৪ এপ্রিল। মাঝে রয়েছে স্বাধীনতার মার্চ। পিঠাময় শীতল জানুয়ারী শেষে ফেব্রুয়ারী উৎসব মার্চ হয়ে এপ্রিলে গড়ায়। ১২ মাসে ১৩ পার্বণের আমরা নাভিশ্বাস ওঠা জীবনে এক চিলতে আনন্দের খোঁজে ছুটে চলি বছরজুড়ে। কখনো গুম হই, কখনো খুন, তবুও আনন্দ-উল্লাস থেমে থাকে না। আনন্দ-উৎসব ছাড়া যে বাঁচা দুষ্কর।
মানুষের জীবন এখনে ব্যস্ততার কোনো শেষ নেই। এর মাঝে রয়েছে হাজারো নাগরিক দুর্ভোগ। তাই উৎসবের কোনো উপলক্ষই বাঙালী ছাড়তে রাজি নয়। উৎসব মানেই প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানো। বসন্ত, ভ্যালেনটাইন, শহীদ দিবস- প্রেমের জন্য বাদ পড়ে না কোনোদিনই। ১৩ ফেব্রুয়ারী হলুদ পোশাকে, ১৪ ফেব্রুয়ারী লাল পোশাকে আর ২১ ফেব্রুয়ারীতে সাদা কালো পোশাকে প্রেমলীলা অনুষ্ঠিত হয়। গান-বাজনা, প্রাণ-মোজো-এয়ারটেল, ফুল-লতা-পাতা আর সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া দেয়ার ব্যবসাটা বেশ ভালোই চলে এ মাসে। সাথে বাঁশ আর প্যান্ডেল তো রয়েছেই। নগরের উৎসবের ছোঁয়া নগরের চেয়ে ফেসবুকে কম পড়ে না। হোম পেইজের নিউজ ফিডে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত উৎসব। লাল-হলুদের ছবিতে ভরপুর। নানান ঢঙে, নানান পোজে, নানান ভঙ্গিমায় ছবি। বন্ধুদের সাথে, বিশেষজনের সাথে, আত্মীয়ের সাথে। লাইক-কমেন্টের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে সব। বাস্তব আর ডিজিটাল জীবনে উৎসবের ঢেউ বয়ে চলছে।
বাঙালী আমোদপ্রিয় জাতি। যেকোনো ছুঁতোয় চমৎকারভাবে সাজিয়ে ফেলতে পারে চারপাশ। বর্ণিল সাজে সজ্জিত হয়ে আনন্দ, হৈচৈ শুরু করে দিতে পারে। কোনো কাল বা সময়ে তারা আটকা পড়ে না। লালন, হাসন থেকে শুরু করে মুন্নি-শীলা সবই তারা শ্রবণ করে। মীলা নাচলেও তারা আমোদ পায়, আবদুল কুদ্দুস বয়াতীকেও তারা ভালো পায়। নগরে উৎসবের হাওয়া লাগে। রঙিন পোশাকে ফেব্রুয়ারী জুড়ে চলে রিকশায় চড়ে নগর ভ্রমণ। যানজট কিংবা যানবাহনের অপ্রতুলতা তাদের আনন্দকে বিন্দুমাত্র ম্লান করতে পারে না। পাঞ্জাবী পরা পুরুষ আর শাড়ি পরা নারী হাতে নোকিয়া ১৬০০ কিংবা গ্যালাক্সি এস থ্রি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মহানগরীর বুকে। ঘুরে বেড়ায় রাজপথ দিয়ে, বিশ্রাম নেয় ছায়াঘেরা সুশীতল ধানমন্ডি লেক বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে। মোজো-ফ্রুটো-এয়ারটেলের ভালোবাসা বিক্রির কনসার্টে মাইলস, সোলসের সাথে চলে নীলা-শীলাদের নর্তন-কুর্দন। আনন্দে মাতে যুবক-যুবতী। সঙ্গীতের তালে তালে চলে বসন্ত আর ভালোবাসাকে বরণ করা। মাসজুড়ে চলা বইমেলাকে কেন্দ্র করে চলে সুশীল ভালোবাসা। লম্বা চুল আর জট ধরা দাঁড়িতে পাঞ্জাবী পরা সুশীল পুরুষ আটসাঁট শাড়ির সুশীল নারীর সাথে গদ্য সমালোচনায় মেতে ওঠে। একুশ ও বাঙালী চেতনা নিয়ে বয়সের ভারে নুহ্য বুদ্ধজীবী “কল-রেডী” লেখা মাইক্রোফোনের সামনে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে ফেলেন। চারুকলাসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগের ছেলেমেয়েরা রাস্তা আর দেয়ালজুড়ে তৈরি করে মনোরম সব নকশা। ফেব্রুয়ারী যেন প্রস্তুতি আর পরিণতি ১৪ এপ্রিল। মাঝে রয়েছে স্বাধীনতার মার্চ। পিঠাময় শীতল জানুয়ারী শেষে ফেব্রুয়ারী উৎসব মার্চ হয়ে এপ্রিলে গড়ায়। ১২ মাসে ১৩ পার্বণের আমরা নাভিশ্বাস ওঠা জীবনে এক চিলতে আনন্দের খোঁজে ছুটে চলি বছরজুড়ে। কখনো গুম হই, কখনো খুন, তবুও আনন্দ-উল্লাস থেমে থাকে না। আনন্দ-উৎসব ছাড়া যে বাঁচা দুষ্কর।
Labels:
উৎসব,
একুশে,
পহেলা ফাল্গুন,
ফেব্রুয়ারী মাস,
বইমেলা,
বসন্ত বরণ,
ভালোবাসা দিবস
Subscribe to:
Posts (Atom)