Friday, February 21, 2014

শহীদের রক্তের দামে কেনা বাংলা ভাষা

“তপুকে এভাবে ফিরে পাবো ভাবি নি... আমি, তপু ও রাহাত...”। জহির রায়হানের একুশের গল্পের দু’টি বাক্যের কথা বললাম। প্রথম বাক্যটি সম্ভবত গল্পের প্রথম বাক্য। আর পরের বাক্যটি বেশ কয়েকবার গল্পে এসেছে। আমরা সবাই জানি, একুশের গল্প আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত। ৯ম-১০ম শ্রেণিতে “হাজার বছর ধরে’ পড়ে যতটা বিরক্ত হয়েছিলাম উচ্চ মাধ্যমিকে ‘একুশের গল্প’ পড়ে ততটাই বিমুগ্ধ হয়েছি। সম্ভবত এটি আমার জীবনের পড়া শ্রেষ্ঠ গল্পগুলোর একটি। ৫২ এবং ৭১ আমাদের ইতিহাসের সবচাইতে বড় দু’টি ঘটনা। এ ঘটনাদ্বয়ের বদৌলতে আজকের বাংলাদেশ, আজকের বাংলা ভাষা, আজকের বাংলাদেশের বাংলা ভাষা। ইতিহাস ও বর্তমান বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে দেখতে পাই আমাদের ৫২, ৭১ এর চেয়ে অধিক সফল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি লাভ করে। ভাষা শহীদদের রক্তের পুরোটাই সফল। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের রক্তের পুরোটা আমরা এখনো সফল করতে সক্ষম হই নি। স্বাধীনতা বিরোধী অপরাধীদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করতে পারি নি। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও অসভ্যতামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারি নি। কিন্তু মাতৃভাষার আন্দোলনে আমরা পুরোটাই সফল। আমাদের এই ভাষা এতটাই সফল যে ভাষার প্রতি আগ্রাসনের নানান অপচেষ্টা কখনোই মুখ তুলে দাঁড়াতে পারে না। তবে ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল না। মাতৃভাষায় লিখতে পড়তে পারার অধিকার আদায়ও এর অন্যতম লক্ষ্য। সে প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বাংলা ব্যতীত অন্য ভাষাভাষীদের জন্য মাতৃভাষায় লেখাপড়া করার সুযোগ আমরা স্থায়ীভাবে সৃষ্টি করতে সক্ষম হই নি। প্রচেষ্টা চলছে।

260a417956c4773fc5a95003e060d470

বছর দুই-তিনেক আগে কোনো একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের এক প্রতিবেদনে ভয়াবহ কিছু বিষয় দেখেছিলাম। প্রতিবেদনে বিচ্ছিন্নভাবে রাস্তাঘাটে বিভিন্ন বয়সী মানুষকে একুশে ফেব্রুয়ারী সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। বেশ ক’জন বাঙালীর উত্তর ছিল ভয়াবহ। একুশে ফেব্রুয়ারী নাকি আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম। আরেকজনের উত্তর ছিল “শহীদ মিনারে আমরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে ফুল দিতে যাই”। ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ দু’টি ভিন্ন ঘটনা। এ তথ্য বয়ঃপ্রাপ্ত বাংলাদেশিদের অজানা থাকাটা লজ্জাজনক। বর্তমানে একুশে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এতই নাম করেছে যে ঐদিনটি যে আমাদের শহীদ দিবস তা অনেকেই চট করে বলতে ব্যর্থ হন। আমার কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারী প্রথমে শহীদ দিবস পরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

March_to_Shaheed_Minar_on_21_February_1953_at_Dhaka_University

চায়না এবং সৌদি আরবে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল বিগত কয়েক বছরে। একজন চাইনিজ বা সৌদি নাগরিক আমাকে দেখলে খুব সহজেই ধরতে পারবেন যে আমি তাদের কাছে বিদেশি। কিন্তু দেখা মাত্র তারা কথা বলা শুরু করবেন নিজের ভাষায়। অনেকে মনে করতে পারেন যে ইংরেজি না জানায় তারা নিজেদের ভাষায় কথা শুরু করে কিন্তু এ ধারণা সব সময় সঠিক নয়। ইংরেজি পারলেও নিজের ভাষাতেই তারা কথা শুরু করে। তার ভাষা না জানার অপারগতা প্রকাশ করলেই শুধুমাত্র তারা ইংরেজি বলে। আর তাদের মাঝে যারা ইংরেজি জানে না তাদের এ নিয়ে কোনো লজ্জা নেই। দুইজন চাইনিজ, দুইজন আরব এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবওয়েতে দু’জন সাদা চামড়ার আমেরিকান নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষায় কথা বলেন। আমি নিজের কানে শুনেছি। আর নিজের দেশে একটু অভিজাত রেঁস্তোরায় গেলে ওয়েটারের কাছে শুনতে হয়, “স্যার, ওয়ার্ডার প্লেস করবেন?” “হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ স্যার?” এই লজ্জা কোথায় রাখি? দু’জন বাঙালী নিজেদের মধ্যে অন্য ভাষা কেন ব্যবহার করবে? ওয়েটারের কি দোষ। তার মালিকের নির্দেশ।“ ইংরেজি বলবি। স্ট্যান্ডার্ড বাড়বে। পাবলিক হাই ফাই ভাববো”। বাদামি চামড়ার বাঙালী খাওয়ার দোকানে গেলে ফুটুং ফাটুং ইংরেজিতে “ফুড অর্ডার” করে। খাওয়া শেষে ওয়েটারও বলে “স্যার ‘ফুড’ কেমন ছিল?” খাদ্য, খাবার শব্দগুলো নিশ্চয়ই তখন লজ্জা পায়। ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসন, সে কি ভোলা দায়?

shahid-minar3

আজ একুশে ফেব্রুয়ারী। শহীদ দিবস। ১৯৫২ সালের এই দিনে আবদুস সালাম, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমান প্রমুখ ভাষা সৈনিক শাহাদাত বরণ করেন। তারা আমাদের ভাষা শহীদ। ভাষা সৈনিক গাজীউল হক, আবদুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ হলেন ভাষা সৈনিক যারা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাদের মাঝে ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন এখন পর্যন্ত বেঁচে আছেন। একটা সময় আসবে যখন আর কোনো ভাষা সৈনিক জীবিত থাকবেন না। আসুন, জীবদ্দশায় তাদের প্রাপ্য সম্মান দিই। নিজের ভাষায় শুদ্ধ করে কথা বলি। নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় ভিনদেশি ভাষা পরিহার করি। নিজের ভাষার ওপরে বড় করে ইংরেজি লিখে রাখা কোনো গৌরবও নয়, কৃতিত্বও নয়।

 

ছবি কৃতজ্ঞতা: বিভিন্ন ওয়েবপেইজ

No comments:

Post a Comment