সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবন শুরু করেছি। সব মিলিয়ে দু'সপ্তাহের মতো ক্লাস হয়েছে। পরিচালক ম্যাডাম যথারীতি ক্লাস নিচ্ছিলেন। হঠাৎ করে একজন শিক্ষক এসে জানালেন নিউমার্কেটের দিক থেকে গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সম্ভবত বিডিআরে গোলাগুলি হচ্ছে। মূহুর্তে ক্লাসজুড়ে গুঞ্জন শুরু হলো। এক সহপাঠী দাঁড়িয়ে ম্যাডামের কাছে জানতে চাইলো বিডিআরে 'ফ্রেন্ডলি ফায়ার' হচ্ছে কিনা! এ ধারণা সে কোথায় পেয়েছিল আজও জানতে পারি নি। একটু পরে শুনলাম বিডিআর জওয়ানরা নাকি বিদ্রোহ করেছে। শিক্ষকরা মিলে আলোচনা করে আমাদের ছুটি দিয়ে দিলেন। সদ্য সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল শেষ হয়েছে। মনে অজানা আতঙ্ক। রাস্তাঘাটে নানান উড়ো খবর পাচ্ছি। কেউ বলছে কোন জেনারেলকে নাকি মেরে ফেলা হয়েছে। পাবলিক এত তথ্য কোথায় পাচ্ছে জানা নেই। যেকোনো সময় সামরিক বাহিনী মাঠে নামবে। ক্যু হওয়ার আশঙ্কা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউ মার্কেট হয়ে আমাকে বাড়ি ফিরতে হয়। ঝুঁকি এড়াতে শাহবাগ দিয়ে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ব্যবহার করি না। হুড়োহুড়ি করে কোনোমতে একটা বাসে উঠলাম। তিল ধারণের জায়গা নেই সেখানে। চারুকলার সামনে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ বাছবিচার না করেই বাসে উঠতে চাইছে। জানের মায়ায় সবাই অস্থির তখন। কেউ উঠতে পারলো, কেউ পারলো না। অতঃপর বাসে করে কারওয়ান বাজার মোড়ে নেমে গেলাম। সেখানে রিকশা,বাস কিছু না পেয়ে দ্রুত পা চালিয়ে রাসেল স্কয়ারের দিকে এগিয়ে চললাম। একটু একটু বালু ঝড়ের মতোও হচ্ছিল। সবাই তাড়াহুড়ো করছে। সকলের উদ্দেশ্য নিরাপদে ঘরে ফেরা। দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। বাসায় ফিরে দেখলাম ইতিমধ্যে টিভি ছেড়ে খবর দেখছে সবাই। বাংলাদেশের সবগুলো চ্যানেলে তখন একই খবর। বিডিআর বিদ্রোহ। টিভির পর্দায় বিডিআর সদর দফতরের ২ নং গেটের সামনের চিত্র সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে। মুখে রুমাল ও গামছা বাঁধা বিডিআর সৈনিকরা অসংগঠিতভাবে অস্ত্র উঁচিয়ে অবস্থান নিয়েছে। আশে পাশের উঁচু ভবনের ছাদ থেকেও চিত্র গ্রহণ করা হচ্ছে। আতঙ্কের মাঝে সময় গড়াতে থাকলো। একসময় দেখলাম সাংবাদিকরা গেটের সামনে মুখঢাকা জওয়ানদের সাক্ষাতকার নিচ্ছেন। বিদ্রোহী জওয়ানরা তাদের ওপর অফিসার কর্তৃক শোষণ-নিপীড়নের অভিযোগ করছে। তাদের দাবি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের তারা অফিসার হিসেবে চান না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হওয়া তরুণরা তাদের অফিসার হবেন। অপারেশন চাল-ডাল নিয়ে তারা অভিযোগ করছে। সকলের সহানুভূতি তখন জওয়ানদের প্রতি। সদ্য বিদায়ী সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি লানত করতে লাগলো সকলে। সামরিক বাহিনী ও সামরিক কর্মকর্তাদের প্রতি সাধারণ মানুষ ও সুশীল সমাজের সে কি ঘৃণা তখন!
বিকেলে অকুস্থলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তাদের আগমন। জনপ্রতিনিধিরা ঘর্মাক্ত অবস্থায় হাত-মাইকে জওয়ানদের অস্ত্র সমর্পন করার আহ্বান জানাচ্ছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জরুরি ভাষণ তখন চ্যানেলে চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সাধারণ মানুষকে আহ্বান জানালেন এলাকা ছেড়ে চলে যেতে। মাইকিং হলো। সকলে আশঙ্কা করতে লাগলো সেনা কমান্ডোরা হয়তো পিলখানায় আক্রমণ চালাবে। এভাবে রাত পার হয়ে গেল। পরদিন একই পরিস্থিতি। মিডিয়ার মাধ্যমে বিডিআর জওয়ানরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনার আহ্বান জানালো। তাদের একটি প্রতিনিধি দল অবশেষে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের বৈঠক করলো। কিছু শর্ত মানলেই কেবল তারা অস্ত্র সমর্পন করবে। শর্তগুলো মধ্যে ছিল বিদ্রোহের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতে হবে, অস্ত্র তারা সমর্পন করবে পুলিশের কাছে কিন্তু কোনোভাবেই সেনাবাহিনী সেখানে থাকতে পারবে না ইত্যাদি। এরপর ধাপে ধাপে বিডিআর কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের ছাড়া হলো। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও সৈনিকরা উল্লেখ করেনি যে ৫৭ জন কর্মকর্তাকে তারা হত্যা করেছে নির্মমভাবে। তখন পর্যন্ত তাদের প্রতিই জনসমর্থন ছিল। অস্ত্র সমর্পণ করার পর যখন পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা ভেতরে প্রবেশ করলো তখন থলের বেড়াল বের হলো। প্রতিদিন উদ্ধার হতে থাকলো নিহত কর্মকর্তাদের লাশ। বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক ও তার স্ত্রীর মৃতদেহ পাওয়া গেল ক’দিন পরে। বিদ্রোহের নামে সেখানে ঘটে যাওয়া নারকীয় হত্যাকাণ্ড ধীরে ধীরে উন্মোচিত হলো।
দিনটি ছিল ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯। আজও ২৫ ফেব্রুয়ারি। তবে ২০১৪ সাল। আমাদের রাইফেলস বাহিনীর ওপর কালিমা লেপনের ৫ম বার্ষিকী। আমাদের গর্বের বাহিনীটিকে ধ্বংস প্রচেষ্টার ৫ম বার্ষিকী। আমাদের রাইফেলস কর্মকর্তাদের দুনিয়া থেকে বিদায় নেবার ৫ম বার্ষিকী। তাদের পরিবারগুলোর স্বামীহারা, পিতাহারা হবার ৫ম বার্ষিকী। দীর্ঘদিন এ ন্যাক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের বিচার পরিচালিত হয়েছে। রায়ও হয়েছে। এখনো বিচার প্রক্রিয়া উচ্চ আদালতে চলমান। শুধুমাত্র অসন্তোষের কারণে বিডিআর জওয়ানরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা বিশ্বাস করা অসম্ভব। কর্মকর্তারা তাদের অধীনস্ত সদস্যদের পরিশ্রম করায় কিন্তু তাদের মাঝে অদ্ভুত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সম্পর্কও থাকে সমান্তরালভাবে। কোনো সৈনিক তার অফিসারকে এভাবে হত্যা করতে পারে না। আমরা দেখেছি সেনা কর্মকর্তাদের মৃত্যুর পর সাধারণ সৈনিকদের চোখের জল ফেলতে। একজন কর্মকর্তা প্রথমে সৈনিক পরে কর্মকর্তা। আমাদের রাইফেলস বাহিনী, আমাদের আমাদের গর্ব ছিল। বাহিনীটি ধ্বংস হয়ে গেল। তার নাম বদলে গেল। পরিবর্তন ঘটলো তার পোশাকের। ধারণা করা হয় এ ঘটনার পেছনে বহির্বিশ্বের গোয়েন্দা সংস্থার হাত রয়েছে। নিজ বাহিনীর একজন সিপাহি তার কর্মকর্তার বুকে নিছক অসন্তোষের বশে ছুরি ধরতে পারে না। এর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে বলেই শোনা যায়। এর সত্যতা হয়তো মিলবে কিয়ামতের সময়, হাশরের ময়দানে। ইতিহাসে এরকম ঘটনা আর যেন না ঘটে সে কামনাই রইলো।
ছবি কৃতজ্ঞতা: আমারব্লগ
No comments:
Post a Comment