“গায়ের রঙের ভিত্তিতে কোনো নাগরিককে বৈষম্যের ফাঁদে ফেলা যাবে না”- এ আন্দোলন বহুদিনের। কিন্তু এই আন্দোলন পূর্ণতা পায় ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসির লিংকন স্কয়ারে সিভিল রাইট অ্যাক্টিভিস্ট মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের আই হ্যাভ আ ড্রিম বক্তৃতার মধ্য দিয়ে। এই বক্তৃতাটি ছিল আফ্রিকা-আমেরিকান নাগরিকদের “March on Washington for Job & Freedom” নামক সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লং মার্চ ও সমাবেশের একটি অংশ। আমেরিকার সামাজিক অধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত এটি সবচেয়ে বড় সমাবেশ। লাখ লাখ মানুষ সেদিন এ লং মার্চে যোগ দিয়ে সমর্থন যুগিয়েছিল। শুধু কালোরা নয়, লং মার্চে বর্ণবাদবিরোধী হাজার হাজার সাদা মানুষও ছিল সেদিন। মার্টিন লুথার কিং এর কালজয়ী এ বক্তৃতা শোনার জন্য বাস, ট্রেন, উড়োজাহাজ ও গাড়িতে করে লক্ষ লক্ষ মানুষ ওয়াশিংটন ডিসির ওয়াশিংটন মনুমেন্ট থেকে লিংকন মেমোরিয়াল স্কয়ার চত্বর পর্যন্ত সমবেত হয়। ঐ দিনটি ছিল আব্রাহাম লিংকনের “Emancipation Proclamation” এ সই করার শতবর্ষ পূর্তির দিন। এই প্রোক্লেমেশনে সই করার মধ্য দিয়ে ১৮৬৩ সালে হাজার হাজার নিগ্রো দাস মুক্তি লাভ করে।

মার্টিন লুথার কিং তার বক্তব্যের শুরুতেই আব্রাহাম লিংকনের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা জানান। লুথার কিং এর বক্তৃতার মূল বিষয় ছিল আমেরিকাতে বর্ণবাদের পতন। শতবর্ষ আগে বর্ণবাদ থেকে মুক্তির চুক্তি সাক্ষরিত হলেও আমেরিকার মাটিতে বর্ণবাদ বহাল তবিয়তেই বিরাজমান ছিল। কাগজে-কলমে ততদিনে সাদা-কালো বৈষম্যের বিরুদ্ধে অনেক আইনই ছিল, কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন ছিল না। বিশেষ করে আমেরিকার দক্ষিণের স্টেটগুলোতে কালোদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হতো। তাদেরকে সমাজে নিচু চোখে দেখা হতো। উত্তরের স্টেটগুলোতে বর্ণবৈষম্য অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক কম ছিল। লুথার কিং দক্ষিণের স্টেট জর্জিয়ার অধিবাসী ছিলেন। তাই বর্ণবাদের ভয়াল রূপ তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন একদম কাছ থেকেই। ২৮ আগস্টের বক্তৃতায় তিনি এসব কথাই বলেন। তিনি তার স্বপ্নের কথা জানান যে একদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাটি বর্ণবাদের কলঙ্কমুক্ত হবে। কালো ও অন্যান্য বর্ণের অধিকারী জনগোষ্ঠী সমাজে প্রাপ্য মর্যাদা পাবে। গায়ের রঙের ভিত্তিতে কাউকে যাচাই করা হবে না বরং সব নাগরিককে তার চরিত্রের ভিত্তিতে যাচাই করা হবে। মার্টিন লুথারের এই বক্তৃতা শুধুমাত্র কালোদের অধিকার আদায়ের ভাষণ ছিল না, বরং সকল বর্ণ, ধর্ম, গোত্রের মানুষের মাঝে সৌহার্দ্য স্থাপনের জন্য সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তনের স্বপক্ষে ছিল তার অবস্থান। তিনি চেয়েছিলেন আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্য সাউথ ক্যারোলাইনা, অ্যালাবামা, লুজিয়ানা, জর্জিয়া, মিসিসিপিতে বর্ণ-সন্ত্রাস নিপাত যাক। বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ঘন্টা বাজুক নিউ ইউর্কের পাহাড় থেকে, কলোরাডোর তুষারশুভ্র পর্বতচূড়া থেকে এমনকি জর্জিয়ার পাথরের পাহাড় হয়ে মুক্তির সেই ঘন্টাধ্বনি ছড়িয়ে পড়ুক মিসিসিপি ও টেনেসির পর্বতমালায়।

মার্টিন লিথার কিং জুনিয়র তার জীবদ্দশায় বর্ণ বৈষম্যের পতন দেখে যেতে পারেন নি। ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল টেনেসিতে তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হন। কিন্তু আজ তার স্বপ্নের আমেরিকা প্রতিষ্ঠিত। ২০০৯ সালে তার আমেরিকার হোয়াইট হাউজে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কালো মানুষ প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রবেশ করেন। আজ বেঁচে থাকলে তিনি হয়তো দেখে যেতে পারতেন তার ভাষণটি ১৯ শতকের সেরা ভাষন হিসেবে ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে গিয়েছে।
আজ ২০১৩ সালের ২৮ আগস্ট। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের কালজয়ী I Have A Dream ভাষণটির অর্ধশত বার্ষিকী পূর্ণ হলো আজ। এই মহান বক্তৃতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আজ দেশে দেশে মার্টিন লুথার কিং এর স্মরণে অনুষ্ঠিত হচ্ছে নানা আয়োজন। লুথার কিং দেখিয়ে গিয়েছেন কীভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজ থেকে বৈষম্যের জীবাণু দূর করা সম্ভব। তার সেই কালজয়ী ভাষনের কারণেই হয়তো আজ আমেরিকার কালো, হিস্প্যানিক কিংবা অন্য বর্ণের অধিকারিরা নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমাতে পারে। লুথার কিং এর আত্মার শান্তি হোক।
পাঠক, যারা আমেরিকার বর্ণ বৈষম্যের আন্দোলন নিয়ে আরো জানতে আগ্রহী তারা ১৯৮৮ সালে নির্মিত Mississippi Burning ছবিটি দেখতে পারেন। জেন হেকম্যান ও উইলিয়াম ড্যাফো অভিনীত এই ছবিতে দেখানো হয়েছে ৬০ এর দশকেও যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে কী ধরণের বর্ণ বৈষম্য ছিল। আইনের ফাঁক গলে কীভাবে সাদারা কালোদের নির্যাতন করতো। দক্ষিণের রাজ্য মিসিসিপিতে বর্ণ-বৈষম্য ও বর্ণ-সন্ত্রাস দূর করতে ফেডারেল সরকারকে কতটা বেগ পেতে হয়েছিল তাও দেখানো হয়েছে চলচ্চিত্রটিতে।
পৃথিবীর সব দেশে বর্ণবাদ নিপাত যাক সে প্রত্যাশা রইলো।
মার্টিন লুথার কিং এর ১৭ মিনিটের সেই ভাষণটির লিংক নিচে দেয়া হলো।
I HAVE A DREAM
পাল্টে দেবার স্বপ্ন আমার এখনো গেল না !
ReplyDeleteপাল্টে দেয়ার স্বপ্ন সবাই দেখতে পারে না। যারা পারে তাদের ওপরেই জাতির ভরসা।
ReplyDelete