Saturday, March 8, 2014

আমার শহুরে ছেলেবেলা

আমার জীবনে কোনো গ্রাম ছিল না। আমার বিদ্যালয়ের পেছন দিয়ে কোনো নদী কুলু কুলু ধ্বণি তুলে বয়ে যেত না। আমি আপাদমস্তক শহুরে লোক। শহুরে মানে একদম মেট্রোপলিটন সিটির বাসিন্দা। গ্রামের পথ ধরে বিদ্যালয়ে যাওয়া, গ্রীষ্মের দুপুরে পুকুরে দাপাদাপি করা, আম-কাঁঠালের ছুটিতে মামাবাড়ি যাওয়ার সুযোগ আমার জীবনে ছিল না। “ছায়া সুবিবিড়, শান্তির নীড়, আমাদের গ্রামগুলি”- এটি বাংলা দ্বিতীয়পত্র বইয়ের রচনা অংশের ‘পল্লী উন্নয়ন’ শীর্ষক রচনাতেই দেখে এসেছি। বাস্তবে অবলোকন করার খুব বেশি সুযোগ হয় নি। নিজের দাদা বাড়িতে গিয়েছি মাত্র একবার। গ্রামের ঠিকানা আর বৈশিষ্ট্য নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে একটু ঘাবড়ে যেতে হয়। ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারি না। ঐ যে বললাম, আমি আপাদমস্তক ঢাকা শরের বাসিন্দা। আমার বাল্যকাল কেটেছে আজিমপুর চায়না বিল্ডিং এর গলিতে। খালি পায়ে গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে বিদ্যালয়ে গমন করিনি। এলাকার বিদ্যালয়ের বেলি কেডস পরে গিয়েছি। যাত্রাপথে শালিক-চড়ুই, বাঁশঝাড় পার হতে হয় নি। বরং রিকশা, টেম্পু, বেবি ট্যাক্সির ভেঁপুর শব্দ শুনতে শুনতে নর্দমার ধার দিয়ে ফুটপাত দিয়ে চলতে হয়েছে। ধানক্ষেতের আইল ধরে পথ চলতে পারি নি কিন্তু মেট্রোপলিটন সিটির সুসজ্জিত ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ধানক্ষেতের সেই চালের বস্তা আমি দেখেছি। আমার শরীরে তাই মাটির গন্ধ নেই। ধোঁয়ার গন্ধে ভরপুর। এই ধোঁয়া গাড়ির ধোঁয়া, এই ধোঁয়া কল-কারখানার ধোঁয়া।

[caption id="attachment_2242" align="aligncenter" width="600"]Dhaka. Source: http://internsanonymous.co.uk/category/charity/ Dhaka. Source: http://internsanonymous.co.uk/category/charity/[/caption]

বিশাল মাঠে জাম্বুরা দিয়ে গ্রাম্য বালকের মতো কাঁদায় হুটোপুটি খেয়ে ফুটবল খেলার সৌভাগ্য ছিল না। চিকন গলিতে টেপ টেনিস দিয়ে ক্রিকেট খেলার সুযোগ ছিল। প্রতি দুই পর পর সেই বলখানা ড্রেনে গিয়ে পড়তো। তাতে আমাদের কোনো সমস্যা হতো না। মাটিতে জোরে আছাড় মারলেই ড্রেনের কালোপানিসিক্ত ওসাকা টেপমারা বলখানা সুন্দর লাল হয়ে যেত। গ্রামের বালকের মতো লুঙ্গি পরে আমরা খেলতাম না। আমাদের পরণে থাকতে ঢাকা কলেজের উল্টাদিকের ফুটপাতের হাফপ্যান্ট। পায়ে থাকতো লাইটিং কেডস। গলিতে ক্রিকেট খেলতে খেলতে এক সময় আবিষ্কার করলাম আমরা কেউ ডানে-বাঁয়ে ছক্কা হাঁকাতে পারি না। ছক্কা-চার সব সামনের দিকেই মারতে পারি। কারণ, আমাদের গলিতে যে ডানে-বাঁয়ে কোনো জায়গা ছিল না, ছিল শুধু ড্রেন। যেদিন ক্রিকেট খেলা হতো না সেদিন হয়তো লুকোচুরি খেলা হতো। বনে-বাঁদাড়ে লুকোবার সুযোগ ছিল না। আমরা লুকাতাম উচ্চতল ভবনের সানশেডে, গ্যারেজে বা বাড়ির দারোয়ানের ঘরের চিপাতে। এভাবে লুকোচুরি আর ক্রিকেট খেলতে খেলতে আবিষ্কার করলাম আমরা হাডুডু, কাবাডি, সাতচারা খেলি না। আমরা খেলি বোম বাস্টিং। যেদিন ব্যাটয়ালা ছেলেটা আসে না সেদিন আমরা ব্যাটের অভাবে খেলা বন্ধ রাখি না। টেপ টেনিস দিয়ে বোম বাস্টিং খেলি। যার হাতে বল থাকে সে গায়ের জোরে অন্যের দিকে তা ছুঁড়ে মারে। হাতে-পায়ে-পিঠে বল লেগে গা জ্বলে যায়, লাল হয়ে যায় শরীর। নৃশংস, নিষ্ঠুর এই খেলা চলতে থাকে ঠিক মাগরিবের আযান পর্যন্ত। মাগরিবের আযান আমাদের সূর্যাস্ত আইনের কথা মনে করিয়ে দিত। বাসায় ফিরে চাপকলের পানিতে হাতমুখ ধুয়ে আমরা হারিকেনের আলোতে পড়তে বসতাম না। আমাদের ছিল প্লাস্টিকের কল আর পড়ার জন্য ছিল টিউবলাইট। মাথার কাছে দাঁড়িয়ে গ্রাম্য কিশোরের মতো মাকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে হতো না। বৈদ্যুতিক পাখাটা মাথার ওপর ঘটাং ঘটাং করে ঘুরতো। বেশি গরম পড়লে স্ট্যান্ড ফ্যানটাও ছাড়া হতো। বইখাতা সব উড়ে যেত তখন। একটু পরে শুরু হতো লোডশেডিং। না, হারিকেন লাগতো না তখনো। মোমবাতির দিনও ফুরিয়ে এসেছিল তখন। স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে কেনা ন্যাশনাল চার্জার লাইটে চলতো পড়াশুনা। না, গ্রামীণ বালকের মতো ৮ টায় আমাদের জীবনে নিশুতি রাত নামতো না। খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়তাম না আমরা। মেট্রোপলিটন শহরের খাস বাসিন্দা হিসেবে ভাত খাওয়া হতো রাত ১১ টায়। ৯টা থেকে শুরু হতো ম্যাকগাইভার, রোবোকপ বা রবিনহুড দেখা। শুতে শুতে বাজতো সেই সাড়ে ১১ টা। ভোরবেলা মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙত না আমার। আমার ঘুম ভাঙাতো ঢাকা শহরের কাকেরা।

(চলবে)

ছবি কৃতজ্ঞতা: risingbd

No comments:

Post a Comment