Wednesday, December 26, 2012

ট্রেকিং এর হাবিজাবিঃ গিয়ার্স [এক]

আমরা যখনই ট্রেকিং বা ক্যাম্পিং ট্রিপ এর জন্য কোন প্ল্যান করি তখন একটা প্রশ্নই খুব জ্বালাতন করে। কি নিব আর কি নিব না? ভাবতে ভাবতে সময় চলে যায় আর প্যাকিং এর সময় তাড়াহুড়া করায় দেখা যায় প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই নিয়ে আসতে ভুলে গেছি বা এত বেশী জিনিস নিয়ে আসায় হাঁটাতেই জান বেরিয়ে যাচ্ছে। তাই প্ল্যানিং এর সময় ট্রেকিং-ক্যাম্পিং গিয়ার অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। বিভিন্ন ট্রেইল, আবহাওয়া, জিওগ্রাফির জন্য বিভিন্ন ধরনের গিয়ার দরকার হয়। এক জায়গার জন্য যা অপরিহার্য আরেক জায়গায় সেটাই হয়ে যায় মাথার বোঝা। যেমনঃ হিমালয়ে গেলে আপনাকে ডাউন জ্যাকেট নিতেই হবে, কিন্তু লাউয়াছড়ায় ডাউন নিয়ে যাওয়া টা হবে বোকামী। তাই গিয়ার গুলো খুব চিন্তা আর সাবধানতার সাথে প্যাকিং করতে হয়।আগেই বলেছি গিয়ার এর সেট আপ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তার পরেও সব জায়গার জন্য একটা বেসিক গিয়ার সেট থাকেই।

292069_10150746663495094_6426655_n

নেভিগেশনের জন্য ম্যাপ, জিপিএস, থাকার শেল্টার (তাঁবু/টার্প/হ্যামক), আরামদায়ক জামা-কাপড়, শান্তিমত ঘুমের জন্য স্লিপিং গিয়ার, মেডিকেশন, টয়লেট্রিজ, রান্নার জন্য কুকিং সেট, সারভাইভাল কিট আর এই সব কিছু আরামসে ক্যারি করার জন্য একটা ভালো মানের ব্যাকপ্যাক।

যত কম ততই বেশী

“He who would travel happily must travel light”- Antoine de Saint-Exupery

ট্রেকিং শুরু করার সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে একটা হালকা ব্যাকপ্যাক। ব্যাকপ্যাক যত হালকা হবে ট্রেকিং জন্য এনার্জী ততই কম দরকার হবে। সেই কম এনার্জীর ঘাটতি মেটাতে তাই আমাদের খাবার ও কম লাগবে। এর মানে হচ্ছে আরও হালকা ব্যাকপ্যাক। হালকা ওজনের ব্যাকপ্যাক ক্যারি করলে শরীরের উপর চাপ ও খুব কম পরে আর মানসিক ভাবে চাঙা থাকা যায়- ট্রেকিং এ যা খুবই প্রয়োজনীয়।

 শেল্টারঃ

কোন ট্রেকিং ট্রিপ প্ল্যান করার সময় সব চেয়ে প্রথমে যেই জিনিস টা গুরুত্বপূর্ন তা হল একটি আরামদায়ক শেল্টার বা থাকার জায়গা নিশ্চিত করা। শেল্টার আসলে ডিপেন্ড করে কোন জায়গায় ট্রেকিং এ যাচ্ছি তার উপর। সেখানের আবহাওয়া কেমন, কতটুকু আরাম দরকার আর টেরেইন টা কেমন এই সব এর উপর ভিত্তি করেই আমাদের প্ল্যান টা করতে হয়। কিছু কিছু জায়গায় আমরা ট্রেকার্স হাট বা স্থানীয়দের বাসায় থেকে এই শেল্টার এর বাড়তি ওজনের ঝামেলা এড়িয়ে যেতে পারি। আবার কিছু জায়গায় ইমার্জেন্সি ক্যাম্প করা লাগতে পারে। খোলা ট্রেকিং এর সময় খোলা আকাশের নীচে ঘুমানো কখনোই কোন অপশন হতে পারে না।

ট্রেকিং এ গেলে আমরা মোটামোটি তিন ধরনের শেল্টার এর কথা চিন্তা করে প্ল্যান করতে পারিঃ

ক. তাঁবু

খ. টার্প

গ. হ্যামক

 টেন্টঃ

পোকা-মাঁকড় এর কাঁমড়, মশা-মাছির উৎপাত, বন্য জীব-জন্তু, বৃষ্টি-বাদল এর দিনে আরামদায়ক আর নিরাপদে ঘুমানোর জন্য একটা তাঁবু খুবই প্রয়োজনীয়। আজকাল আমাদের দেশেই বিভিন্ন ধরনের তাঁবু পাওয়া যাচ্ছে। ট্রেকিং ও ক্যাম্পিং এর জনপ্রিয়তার সাথে সাথে আমাদের অপশন ও বাড়ছে। টেন্ট এর দাম যেহেতু একটু বেশী তাই ওয়ান টাইম ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে টেন্ট কেনার সময় আমাদের বেসিক কিছু জিনিস এর দিকে লক্ষ্য রাখতেই হবে।

জায়গাঃ

টেন্ট এর সাইজ খুবই গুরুত্বপূর্ন। টেন্ট এর ভিতরে আপনাকে আরাম করে ঘুমানোর সাথে সাথে আপনার ব্যাকপ্যাক ও অন্যান্য গিয়ার গুলো নিরাপদে রাখতে হবে। তাই টেন্ট কেনার আগেই প্ল্যান করুন, আপনি কিভাবে টেন্ট ব্যবহার করবেন। একাই ঘুরে বেড়াবেন নাকি গ্রুপ এ ঘুরবেন? সেটার উপর ডিপেন্ড করে আপনি সিঙ্গেল টেন্ট কিনবেন না কি টু-পারসন টেন্ট নাকি ফোর-পারসন টেন্ট। টেন্ট এর ভিতর আপনি যেন আরামে বসতে পারেন, ছাদের যেন আপনার মাথা লেগে না যায়। আবার, খেয়াল রাখবেন টেন্ট টা যেন এতই ছোট না হয় যাতে ঘুমের সময় একটু কাঁত হলেই কনডেনসেশনের জন্য ঘেমে থাকা দেয়ালে আপনার শরীর লেগে ভিজে না যায়। কিছু কিছু টেন্ট এ আলাদা বারান্দা বা করিডোর এর ব্যবস্থা থাকে, যেন ঐ জায়গায়  ব্যাকপ্যাক ও অন্যান্য জিনিস পত্র রাখা যায়।

 ওজনঃ

টেন্ট এর ওজন খুবই গুরুত্বপূর্ন। টেন্ট যতই হালকা হবে তার দাম ও তত বেশী হবে। আবার হালকা হলেই যে টেন্ট ভাল মানের হবে সেটা মনে করার কোন কারন ই নাই। টেন্ট এর ম্যাটেরিয়াল, পোল, ভেন্টিলেশন, ফ্লোর, পেগ, ফ্লাই বা কভার শীট এর উপর নির্ভর করে টেন্ট এর ওজন। সব দিক বিবেচনা করে মান আর দামের মধ্যে সমন্বয় করে আমাদের টেন্ট কেনা উচিৎ। আমাদের দেশে এখন যে সব টেন্ট পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর ওজন সাধারনত এক থেকে পাঁচ কেজির মত হয়।

এই ক্ষেত্রে আমার সাজেশন হল, দুইজন মিলে একটি টু-পারসন টেন্ট কিনে নেওয়া। তাহলে ট্রেকিং এর সময় একজন টেন্ট ক্যারি করলে ট্রিপের অন্যান্য গিয়ার গুলো অন্যজন ক্যারি করতে পারে। এভাবে একদিকে যেমন একটা ভাল মানের টেন্ট কিনতে একজনের অর্ধেক টাকা লাগছে অন্যদিকে ট্রেকিং এর সময় ওয়েট ডিসট্রিবিউশন ও ভালভাবে হচ্ছে।

সিজনঃ

কোম্পানী গুলো বিভিন্ন সিজনের জন্য বিভিন্ন ধরনের টেন্ট তৈরী করে। লো-অলটিটিউড এর জন্য যেই টেন্ট ব্যবহার করা যায় সেটা আপনি হাই-অল্টিটিউডে ব্যবহার করতে পারবেন না। বৃষ্টির দিনে যেটা ব্যবহার করা যায় সেটা আপনি হিমালয়ের বরফে ব্যবহার করতে পারবেন না। আবার গরমের দিনে দরকার হয় ভালো ভেন্টিলেশন এর ব্যবস্থা থাকা টেন্ট। আবার সব ঋতুতে ব্যবহার করা যায় এমন ফোর-সিজন টেন্ট ও পাওয়া যায়। সারা বছর ধরে সব কয়টি ঋতুতে সব ধরনের আবহাওয়ায় যে টেন্ট ব্যবহার করা যায় স্বাভাবিক ভাবেই সেই টেন্ট এর দাম খুব বেশী হয়। তাই টেন্ট কেনার আগে কোন ধরনের টেন্ট আপনার দরকার সেটা আগেই চিন্তা করে ঠিক করে রাখুন।

 সেট আপঃ

টেন্ট এর মডেলের উপর ডিপেন্ড করে টেন্ট এর সেট আপ কেমন হবে। কিছু কিছু টেন্ট সেট আপ করা খুবই সহজ আবার কিছু কিছু খুবই জটিল আর সময় সাপেক্ষ। কিছু টেন্ট পিচ করতে একজনই যথেষ্ট আবার দুই তিন জন মিলেও একটা টেন্ট পিচ করা অনেক কষ্টকর লাগে। এমন টেন্ট কেনা উচিৎ যেটা খুব সহজে আর কম সময়ের মধ্যে পিচ করা যায়।

 কনডেন্সেসন বা বডি ঘেমে যাওয়াঃ

ফিজিক্স ১০১- ঠান্ডা কোকের গ্লাসের বডি যে কারনে ঘেমে যায় ঠিক একই কারন অর্থাৎ ভিতরে আর বাহিরের তাপমাত্রার বিভিন্নতার কারনে টেন্টের ভিতরের বডিও ঘেমে যায়।

সাধারনত টেন্ট এর দু’টা লেয়ার থাকে। উপরের লেয়ার বা ফ্লাই কভার এর ফেব্রিক বা কাপড় ওয়াটার প্রুফ হয় আর ভিতরের লেয়ার টা ওয়াটার প্রুফ হয় না। কনডেনসেশন কম হওয়ার জন্যেই ভিতরের লেয়ার টা ওয়াটার প্রুফ করা হয় না। এই কারনে টেন্ট এর ভিতর আমাদের শরীর থেকে যেই বাষ্প তৈরী হয় সেটা ভিতরের স্তর ভেদ করে বাইরে চলে যায় আর বাইরের স্তরের নীচের দিকে  ঘেমে টেন্টের নীচ দিয়ে বাইরে চলে যায়। সব টেন্ট এর ভিতরের বডি কিছু টা হলেও ঘামবে। তবে ভাল টেন্ট গুলোতে এই কন্ডেন্সেসন টা খুব কম হয়। যেই টেন্ট এর ভেন্টিলেসন ভাল সেই টেন্ট ই কেনা উচিৎ।

আজকাল উন্নতমানের ফ্যাব্রিক(গোর-টেক্স) দিয়ে এক লেয়ার এর টেন্ট ও তৈরী হচ্ছে। এগুলো অনেক হাল্কা আর দাম ও সেই সাথে অকল্পনীয় রকমের বেশী হয়।

গরম এর দিনে ট্রেকিং এর জন্য টেন্টের ভেন্টিলেশন খুব ভাল না হলে আরামদায়ক ক্যাম্পিং এর চিন্তা করা ও কষ্টকর। বাতাস যেন ভালভাবে টেন্টের ভিতর প্রবেশ করতে পারে তেমন টেন্ট দেখে নেয়া উচিৎ।

 পোলঃ

পোল গুলো সাধারনত স্টীল, এলুমিনাম বা ফাইবার গ্লাসের তৈরী হয়। ছোট ছোট টুকরো গুলো ইলাস্টিক কর্ড দিয়ে একটার সাথে আরেকটা লাগানো থাকে। ফাইবার গ্লাস এর পোল গুলো থেকে এলয় এর তৈরী পোল গুলো বেশী শক্তিশালী ও ফ্লেক্সিবল হয়। ফাইবার গ্লাস এর পোল গুলো এক্সট্রিম কন্ডিশনে ভেঙে যেতে পারে। ইলাস্টিক কর্ডিং পোল গুলোর আরেক টা সুবিধা হচ্ছে এগুলা অনেক বেশী প্রেসার নিতে পারে। আর টেন্ট খোলার সময় মাঝখান থেকে পোল গুলো আলাদা করে প্রেসার কমিয়ে ফেলা যায়। এভাবে পোল ভাঙার সম্ভাবনাও কমে যায়।

 পেগঃ

হালকা টেন্ট গুলো জায়গামত ফিক্স রাখতে পেগ দিয়ে চারদিকে গেঁথে দিতে হয়। প্রচন্ড বাতাসে টেন্ট ঠিক রাখতে এর কোন বিকল্প নাই। কিছু কিছু টেন্ট এর উপরের কভার টাও চারদিক থেকে টানা দেয়ার জন্য পেগ লাগে। টেন্ট গুছানোর সময় গুনে গুনে পেগ গুলো রাখা উচিৎ, অনেক ছোট হওয়ার কারনে পেগ হারানোর হার সবচেয়ে বেশী।

আমাদের দেশে আজকাল তিন ধরনের টেন্ট পাওয়া যাচ্ছেঃ

 

ক. রীজ টেন্টঃ

ridge-tent01

এগুলো অর্থডক্স A-ফ্রেম টেন্ট। স্কাউটিং এর জন্য এই টেন্ট গুলো বেশী ব্যবহার করা হয়। এগুলো অনেক স্টেবল হলেও সেট আপ করা অনেকটাই ঝামেলা মনে হয় আমার কাছে। এর সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে এর ওজন। এগুলো অনেক বেশী ভারী হয়। আর চারদিকে স্ট্যাকিং অনেকই বেশী। টানা দিতে দিতেই সময় গুলো চলে যায়। ভিতরের জায়গা ও তুলনা মূলক ভাবে কম থাকে।

 খ. ডোম টেন্টঃ

41fLxpw1G6L._SL500_SS500_

ওজনে হালকা, সেট আপ করা অনেক ইজি, আর ব্যাকপ্যাকে ক্যারি করা অনেক সুবিধা জনক বলেই আজকাল এই টেন্ট গুলো বেশী জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সাধারনত দুটা পোল সেট করে একজনই টেন্ট পিচ করতে পারে। ভিতরে জায়গাও অনেক বেশী থাকে। কিছু কিছু মডেলে আলাদা বারান্দা বা কম্পার্টমেন্ট ও থেকে। এরো ডাইনামিক শেইপের কারনে মাউন্টেনিয়ারিং এর জন্য তাই এই ধরনের বেশী উপযোগী। তবে একটা ভালমানের ডোম টেন্ট এর দাম ও অনেক বেশী হয়।

 গ. টানেল শেইপড পপ-আপ টেন্টঃ

Folding-Camping-Tent-Pop-Up-Tent-LS-001-

চোখের নিমিষেই এই টেন্ট পিচ করা হয়ে যায়। ফ্লেক্সিবল পোল কয়েল করা থাকে। ব্যাগ থেকে খুলে জায়গা মত বসিয়ে দিলেই হল- প্যাঁচানো কয়েল গুলো খুলে টেন্ট আপনা আপনি টানেল শেইপ নিয়ে নেয়। কিন্তু ট্রেকিং এর জন্য এই ধরনের মডেল খুবই অসুবিধা জনক। গোল রাউন্ড শেইপের বেশ বড় একটা কয়েল ক্যারি করতে হয়। ভিতরে জায়গা ও অনেক কম থাকে। মাঝার সাইজের একজন বসলেই ছাদে মাথা লেগে যায়। তবে দূর থেকে দেখতে এই মডেলের টেন্ট খুবই সুন্দর লাগে।

এখন যেই মডেলের টেন্ট ই কিনুন না কেন, কেনার সময় অবশ্যই নিচের কয়েকটি পয়েন্ট নিশ্চিত হয়ে নিবেনঃ

১. সহজে পিচ করা যায়

২. চেইন গুলো কাজ করছে

৩. যথেষ্ট ভেন্টিলেশন আছে

৪. সেলাই গুলো সব ঠিক আছে

৫. পোল গুলোর যথেষ্ট স্ট্যাবিলিটি আছে

 

আগামী পর্বে থাকছেঃ

  • টার্প ও হ্যামক

  • ক্যাম্প সেট আপ

  • টেন্ট এর মেন্টেইনেন্স


 

3 comments:

  1. দারুণ হচ্ছে, দুখী মানব ! পড়ছি, আর নিজেকে একটু বোকা বোকা মনে হচ্ছে, আমরা তো কিছু না বুঝেই দৌড় দিয়েছি এতদিন ! কিন্তু আপনার একটা ট্যুরের ছবি শেয়ার করেন না প্লিজ !

    ReplyDelete
  2. দয়া করে টেন্ট কোথায় কিন্তে পাওয়া যায় জানাবেন।

    ReplyDelete
  3. Nowshar ভাই, iFeri.com - এ আপাতত Pop-up Tent পাওয়া যাচ্ছেঃ http://iferi.com/index.php/sports/tents.html আপনি ফোনেও অর্ডার করতে পারেন । ঢাকার ভেতর ফ্রি হোম ডেলিভারি দেওয়া হয় । ধন্যবাদ ।

    ReplyDelete