Monday, March 10, 2014

আমার শহুরে ছেলেবেলা-২

আমাদের ঢাকা শহরে কাকডাকা ভোর নামতো। এখনো গাড়িডাকা ভোর নামে। যাই হোক, কাকডাকা ভোরে কাকের ডাকে প্রথম উঠতাম। আলসেমি করে বিছানায় গড়াগড়ি দিতে দিতে মা চূড়ান্তভাবে ওঠাতেন। গ্রামের বালক বা কিশোরের মতো ঠান্ডা পানিতে হাতমুখ ধুতে হতো না। মা পানি গরম করে রাখতেন। পান্তা ভাত খাওয়ার সুযোগ ছিল না। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার সন্তান হিসেবে আটা রুটি, আলুভাজি অথবা ডিমভাজি খেতে হতো নাস্তায়। ছুটির দিন অর্থাৎ শুক্রবারে হতো ‘ইম্প্রুভ ডায়েট’। পরোটা, আলুভাজি বা ডিমভাজি আর ডেজার্ট হিসেবে সুজি। নাস্তা খুব আয়েশ করে খাওয়ার অবকাশ ছিল না। স্পাইডারম্যান, মোগলী অথবা জনি কোয়েস্ট দেখতে দেখতে নাকেমুখে কোনোক্রমে নাস্তা গোঁজা হতো।

দুপুরে বিদ্যালয় থেকে ফিরে গ্রামীণ কিশোরের মতো পুকুরে ঝাঁপ দিতাম না। ঢাকা ওয়াসার বালতি অথবা ড্রামভরা পানি দিয়ে গোসল সারতাম। খেয়ে দেয়ে অপেক্ষা করতাম আসরের আযানের জন্যে। আসরের আযান দিলে নিউ মার্কেট থেকে ৬০ টাকা দিয়ে কেনা ক্যাপটা মাথায় চাপিয়ে খেলতে নামতাম। খেলার বর্ণনা আগেই দিয়ে ফেলেছি অবশ্য। আমার খেলার সাথীরা ছিল অদ্ভুত। কেউ আমার চেয়ে ৫ বছরের বড় আবার কেউ হয়তো ৪ বছরের ছোট। সবাই সবাইকে অবলীলায় তুমি তুমি করে নাম ধরে ডাকতো। আমাদের টিমে কখনো কখনো ‘অতিথি খেলোয়াড়’ হিসেবে স্থানীয় বস্তি থেকে ছেলেরা আসতো। কোনো ভেদাভেদ ছিল না। ছিল না কোনো কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন। ডিশের সংযোগ বিহীন টিভিতে বিটিভিই ছিল ভরসা। রবিবারে হতো ধারাবাহিক নাটক আর সোমবারে হতো প্যাকেজ নাটক। মঙ্গলবারে হয়তো প্রয়াত হূমায়ুন আহমেদের কোনো ধারাবাহিক নাটক থাকতো। তাড়াতাড়ি পড়াশুনা শেষ করে রাত নয়টা থেকে দশটা পর্যন্ত নাটক দেখা চাই। বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে হতো না তখনকার নাটক। মনে আছে, হূমায়ুন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক যেদিন হতো সেদিন পাড়ায় চুরি হতো সবচেয়ে বেশি। গ্রিলের ফাঁক  দিয়ে হাত ঢুকিয়ে তখনকার গায়ে সইষ্যার তেলমাখা থ্রি কোয়ার্টারস প্যান্ট পরা চোরেরা বিছানার চাদর, শাড়ি, লুঙ্গি, বাচ্চাদের জামাকাপড় চুরি করতো। রাত সাড়ে দশটার পড়ে মাঝে মাঝে হাঁটতে বের হতাম সপরিবারে। সপরিবারে রাতে হাঁটতে বের হওয়ার একটা ঐতিহ্য তখন ছিল। আর লোডশেডিং মানে অবধারিতভাবে রাস্তায় হাওয়া খেতে বের হওয়া থুক্কু বন্ধুদের সাথে আরেক দফা হৈ চৈ আড্ডা।

Dhaka_At_Night_wallpaper

আজিমপুর চায়না বিল্ডিং এর গলিতে এভাবে আমাদের শহুরে শৈশব এবং কৈশোরের দিনগুলো পার হতে লাগলো। হরতালে রাস্তায় ইট গেঁড়ে আর কোনো কোনো মৌসুমে পাড়ার বড় ছাদওয়ালা বাড়ির ছেলেটার ছাদে ক্রিকেট খেলার ধুম পড়তো। শীতের ছুটিতে হতো টেস্ট ম্যাচ। সকালে এক ইনিংস আর বিকেলে আরেক ইনিংস। যথারীতি ফলো অন এবং এলবিডব্লিউ বলে কিছু ছিল না সেই খেলাগুলোতে। ছাদের বাইরে বল গেলে সবচেয়ে বড় আউট। আমার কৈশোরের এই খেলাময় দিনগুলোতে ভাঁটা পড়ে যখন আজিমপুর ছেড়ে ধানমন্ডিতে চলে আসি। হঠাৎ করে খেলার সাথীদের হারিয়ে ফেলে একা হয়ে যাই। বেশ বড়সড় একটা নিঃসঙ্গ সময় পার করে অবশেষে আবারো রাস্তায় আমাদের খেলাধুলা শুরু হয়। এলাকার স্থানীয় ছেলেপেলে এবং ড্রাইভাররা একত্রে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হরতালের দিনগুলোতে ক্রিকেট খেলতো তখন ধানমন্ডিতে। মাঝে মাঝে এই গলির সাথে ঐ গলির সাকিব আল হাসানদের ‘চ্যালেঞ্জ ম্যাচ’ হতো।

সন্ধ্যার পরে পড়ায় ফাঁকি দিয়ে পড়তাম তিন গোয়েন্দা। তিন গোয়েন্দা পড়তে পড়তে এক সময় ধরলাম হূমায়ুন আহমেদ আর জাফর ইকবাল। মনে পড়ে, অর্ধ-বার্ষিক বা বার্ষিক পরীক্ষা কিছুই আমার তিন গোয়েন্দা বা হূমায়ুন আহমেদ পড়ায় ছেদ ঘটাতে পারতো না। রাত জেগে টর্চের আলোতে তিন গোয়েন্দা শেষ করেছি কত। সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্প, প্রফেসর শঙ্কু, তারিণীখুড়োও চলেছে বেশ। এসবই সম্ভব হয়েছে কারণ তখন ইন্টারনেট, ফেসবুক, মোবাইল ফোন আর প্রযুক্তির হাবিজাবি এসব ছিল না। আমার শৈশব আর কৈশোরটা হয়তো গ্রামীণ শিশু বা কিশোরের মতো খুব দাপুটে যায় নি কিন্তু ঢাকা শহরের বুকে যতটা দস্যিগিরি করা যায় ততটাই করা সম্ভব হয়েছে। এই প্রাণের শহরের সমস্যা-সুবিধা সবগুলোকেই আনন্দ হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু প্রযুক্তির এই যুগে খুব অভাববোধ করি সহজ-সরল, প্রযুক্তিহীন অথচা আবেগে ভরপুর সেদিনগুলোর। আর তাই তো প্রায়ই হারিয়ে যাই আজিমপুরের ছেলেবেলার সেই দিনগুলোতে।

ছবি কৃতজ্ঞতা: beauty-places.com

No comments:

Post a Comment