Tuesday, January 21, 2014

সুচিত্রা সেন: বাঙালি নারীর চিরায়ত রূপ

সে অনেক দিন আগের কথা। কোনো এক অলস দুপুরে বিটিভি বা একুশে টিভিতে একটি পুরনো দিনের বাংলা চলচ্চিত্র মাঝঝান থেকে দেখা শুরু করেছিলাম। খুব ভালো লাগছিল বিধায় দেখেই যাচ্ছিলাম যদিও সিনেমা কিংবা তার কুশীলব কাউকেই চিনতাম না। পুরো সিনেমা শেষে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। কী চমৎকার অভিনয়! কী চমৎকার নির্মাণ! আর কি অসাধারণ আবহ সঙ্গীত। সব মিলিয়ে ঘোরের মধ্যেই ছিলাম। বাসায় মা-বাবাকে সিনেমার কাহিনী বলতেই ধরে ফেললেন তারা। উত্তম-সুচিত্রার “সবার ওপরে”। উত্তম-সুচিত্রার সাথে তখনই পরিচয়। মা-বাবা সব সময়েই এ জুটির ভীষণ ভক্ত। বাসায় ডিশের লাইন না থাকায় বিটিভিই ছিল ভরসা। কখনো উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা যদি দেখানো হতো, কোনোভাবেই তারা মিস করতেন না। এমন মা-বাবা বোধহয় অসংখ্য যারা উত্তম-সুচিত্রার অন্ধভক্ত। তাদের সময় বাংলা চলচ্চিত্রের রূপালী পর্দা কাঁপানো এই জুটি কিন্তু এ প্রজন্মেও সম্মানের স্থান অধিকার করে আছেন। উত্তম কুমার মারা গিয়েছেন বহু আগে, সেই ১৯৮০ সালে। আর সুচিত্রা চলে গেলেন মাত্র ৪ দিন আগে, গত ১৭ জানুয়ারিতে। চিরদিন কেউ বেঁচে থাকে না। সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে আগমন হলে প্রস্থান বাধ্যতামূলক।

57257715-CE38-4D49-A958-FC7A2609E174_mw1024_n_s

মা-বাবার কাছেই শুনেছি উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সুচিত্রা। কিন্তু এরপরে শুধুমাত্র একবারই জনসম্মুখে এসেছেন সুচিত্রা, সেটিও ১৯৮৯ সালে তার গুরু ভরত মহারাজের মৃত্যুর সময়। এরপর আর কখনোই তিনি ক্যামেরার সামনে আসেন নি। কেন আসেন নি তাও রহস্যজনক। হিন্দি চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় তাকে ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত করা হলেও জনসম্মুখে আসতে হবে বিধায় তিনি রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে এ পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জানান। জীবনের শেষ দিনগুলোতেও ক্যামেরা নিয়ে সাংবাদিকরা তার কাছে যেতে পারেন নি।

Suchitra-san0120140117105801

সুচিত্রা সেনের আসল নাম রমা দাশগুপ্ত। তার জন্ম ১৯৩২ (মতান্তরে ১৯২৯) তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির পাবনা জেলা সদরে যা বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থিত। চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেছিলেন ১৯৫২ সালে শেষ কোথায় ছবির মাধ্যমে কিন্তু পরবর্তীতে ছবিটি মুক্তি পায় নি। উত্তম কুমারের (আসল নাম অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়) সাথে ১৯৫৩ সালে সাড়ে চুয়াত্তর চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করে ভারত ও বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন সুচিত্রা। এরপরে কাহিনী তো ইতিহাস। ৬০ ও ৭০ দশকে উত্তম-সুচিত্রা জুটির অনেকগুলো ছবি মুক্তি পায়। প্রায় সবগুলোই সুপারহিট। এপার ও ওপার বাংলায় রূপালী পর্দায় সেই সময়ের সেরা জুটি ছিলেন তারা। অদ্ভুত কেমিস্ট্রি ছিল তাদের রোমান্টিসিজমে। পর্দায় তাদের অসাধারণ অভিনয় গুণ ও প্রেমময়তা  লাখো দর্শকের হৃদয় জুড়িয়েছিল। বাস্তব জীবনেও চমৎকার বন্ধুত্বের সম্পর্কে ছিল এই চলচ্চিত্র জুটির। আজকাল দেখা যায় ক্যারিয়ারের কারণে অভিনয়শিল্পীরা অনেক বয়স পর্যন্ত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন না, কিংবা বিয়ে করলেই ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানেন। কিন্তু সুচিত্রা সেনের ক্যারিয়ার শুরু তার বিয়ের বছর চারেক পরে। ১৯৪৭ সালে কলকাতার বিশিষ্ট শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথ সেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। আর চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন ১৯৫২ তে। স্বামীর মৃত্যুর পরেও অভিনয় করেছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে চলচ্চিত্র জগত থেকে বিদায় নেন ১৯৭৮ সালে। এরপর থেকেই মোটামুটি অন্তরীন জীবন শুরু করেন সুচিত্রা সেন এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে সেবামূলক কাজে যুক্ত হন।

উত্তম কুমারের মৃত্যর বেশ অনেক পরে একবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে একবার সুচিত্রা সেন বলেছিলেন “উত্তম ফিরলে আবারো অভিনয় করতাম”। তার এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায় টানা ২০ বছর একত্রে অভিনয় করা সাবেক সহশিল্পীকে কতটা সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন তিনি। বয়সে উত্তম কুমারের চেয়ে ৫ বছরের ছোট ছিলেন সুচিত্রা। কিছুটা জেদি প্রকৃতির নারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। চলচ্চিত্রের সাইনিং পেপারে উত্তম কুমারের আগে নিজের নাম লেখাতে প্রযোজকদের বাধ্য করেছিলেন এরকমও শোনা যায়। ১৯৭৮ সালে প্রিয় বান্ধবী চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমেই অবসর নেন।

image_1544_369980.gif

১৯৬৩ সালে সাত পাকে বাঁধা চলচ্চিত্রের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সিলভার প্রাইভ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস’ লাভ করেন। ভারতীয় অভিনেত্রী হিসেবে তিনিই প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভের এ গৌরব অর্জন করেন। বাংলা ছবির পাশাপাশি কয়েকটি হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন তিনি। ১৯৫৫ সালে ক্যারিয়ার শুরুর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই প্রথম হিন্দি ছবি দেবদাস এর জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন। আর ’৬৬ সালে হিন্দি ছবি মমতার’র জন্য ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ১৯৭২ সালে চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত করেন। আর ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ পদক বঙ্গবিভূষণে ভূষিত করেন। তার মৃত্যুর পর তাকে গান স্যালুট দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

কিংবদন্তিদের মৃত্যুর পর তাদের নিয়ে লেখালেখি হবে, আলোচনা হবে, মিডিয়া সরগরম থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এরপর সময়ের স্রোতে আবারো ব্যস্ত হয়ে পড়বে সবাই, নতুন নতুন ঘটনা ঘটবে। কিন্তু যাই ঘটুক, বাঙালির হৃদয়ে রমা দাশগুপ্ত ওরফে সুচিত্রা সেন বেঁচে রইবেন হাজার বছর ধরে।

তথ্য ও ছবি কৃতজ্ঞতা: উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য ওয়েবসাইট

No comments:

Post a Comment