
প্রাথমিক প্রতিবিধানের (First Aid) উপর এটা তৃতীয় পোস্ট। কি, কেন- তে যাব না (প্রয়োজনে আগের পোস্টগুলো দেখে নেন - http://iferi.com/blog/2013/08/first-aid-1/, http://iferi.com/blog/2013/09/first-aid-2/)। সরাসরি কিভাবে-তে চলে যাই, অস্থি বা হাড় ভাঙলে কি প্রতিবিধান দিতে হবে তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
প্রকারভেদ – হাড় প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ আঘাতে ভাঙতে পারে। আঘাতের ফলে হাড়ের সাথে সাথে শরীরের কি ধরনের ক্ষতি হয়েছে তার ভিত্তিতে হাড় ভাঙ্গার প্রকারভেদ নির্ণয় করা হয়।
- শুধু হাড় ভাঙ্গা, শরীরের অন্য কোন অংশে কোন ক্ষতি নেই।
- হাড় ভাঙ্গার সাথে সাথে শরীরে বাহ্যিক ক্ষতি হওয়া। অনেক সময় হাড় ভেঙ্গে শরীর থেকে বের হয়ে বাহ্যিক ক্ষতের সৃষ্টি করে।
- হাড় ভেঙ্গে আভ্যন্তরীণ কোন যন্ত্রের, যেমন ফুসফুস, মেরুদণ্ড বা মস্তিষ্কের ক্ষতি সাধন।
- একটি হাড়ের একাধিক জায়গায় ভাঙ্গন।
- হাড় ভেঙ্গে এর এক অংশ অন্য অংশের ভিতর প্রবেশ।
- হাড় সম্পূর্ণ না ভেঙ্গে বেঁকে এবং সামান্য ফেটে যাওয়া। একে Greenstick Fracture বলা হয়। শিশুদের হাড় নরম হয় বলে কেবল শিশুদের ক্ষেত্রেই এরূপ ঘটে।
- মাথার খুলি ভেঙ্গে নিচে বসে যাওয়া। একে Depressed Skull Fracture বলে।
লক্ষণ –
- ভাঙ্গা জায়গায় ভীষণ ব্যথা হবে। রোগী ভাঙ্গা জায়গা স্পর্শ করতে পারবে না।
- ভাঙ্গা জায়গা ফুলে যাবে এবং অস্বাভাবিক আকার ধারন করবে। অনেক সময় এক হাড় আরেকটার উপর উঠে গেলে জায়গাটা ফুলে যায় এবং অঙ্গের আকৃতি ছোট দেখা যায়।
- যে জায়গা ভাঙ্গে সে জায়গা স্বাভাবিক সঞ্চালন ক্ষমতা হারায়। ভাঙ্গা অঙ্গের স্বাভাবিক শক্তি লোপ পায়।
[caption id="attachment_612" align="aligncenter" width="849"]

কিছু সাধারণ প্রতিবিধান ও সাবধানতা –
- যেকোনো প্রকার নাড়াচাড়ার আগে ভাঙ্গা জায়গা যেন না নাড়াতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। সম্ভব হলে লাঠি বা শক্ত কিছু দিয়ে বাঁধার ব্যবস্থা করতে হবে, যেন নাড়াচাড়া না হয়। অবশ্য ঘটনাস্থল বিপদমুক্ত না হলে সবার আগে স্থানান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- বাহ্যিক ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হলে তা বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে।
- বাঁধার উদ্দেশ্য হল যেন ভাঙ্গা জায়গা নাড়াচাড়া করতে না পারে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই শক্ত করে বাঁধতে হবে। তবে অবশ্যয়ই খেয়াল রাখতে হবে যেন রক্ত সঞ্চালন বন্ধ না হয়ে যায়।
- সকল অবস্থায় অচেতন থাকলে ABC পরীক্ষা করেন। প্রয়োজনে কৃত্রিম শ্বাস ও CPR দেন। সচেতন থাকলে কি করতে হবে তাও আপনি জানেন।
- বমি হলে যতটা সম্ভব কম নাড়াচাড়া করে কাত করে বমি করার ব্যবস্থা করেন। বমি করতে না পেরে ফুসফুসে চলে গেলে অবস্থা আরও জটিল হতে পারে।
- খেয়াল রাখতে হবে যেন রোগী আরামদায়ক অবস্থায় থাকে, ব্যথার মধ্যে যতটা স্বস্তি দেয়া যায়। সম্ভব হলে ভাঙ্গা জায়গায় বরফ দেয়া যেতে পারে, তাতে ক্ষতস্থান অবশ হয়ে ব্যথা কমতে পারে।
- মানসিক আঘাতের ব্যবস্থা নিতে হবে। রোগী সচেতন থাকলে প্রচণ্ড ব্যথার মধ্যে থাকবে।
মাথার খুলি ভাঙলে –
- মাথা ও কাঁধ সামান্য উঁচু করে শোওয়ায়ে রাখেন।
- রোগীকে নাড়াচাড়া করা থেকে বিরত থাকেন। যদি স্থানান্তর করতে হয় তবে অনেক সাবধানে দুই হাত দিয়ে মাথা স্থির রেখে স্থানান্তর করেন। শরীরের কাপড় আলগা করে দেন, প্রয়োজনে কিছু দিয়ে কেটে ফেলেন।
- রোগীকে গরম রাখার চেষ্টা করেন। হাতের ও পায়ের তলায় শেক দিতে পারলে ভাল হয়।
- মাথায় কিছু প্রবেশ করে থাকলে কোনক্রমেই তা বের করার চেষ্টা করবেন না। সামান্য এদিক সেদিক হলে রোগীর অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।
- কোন অবস্থাতেই রোগীকে পানি পান করতে দিবেন না।
[caption id="attachment_585" align="alignleft" width="349"]

মেরুদণ্ড ভাঙলে –
- মেরুদণ্ড ভাঙলে রোগী জ্ঞান হারাবে। এই অবস্থায় শ্বাস নিতে যেন কষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- স্থানান্তর করতে হলে অবশ্যই চিত করে শোওয়ায়ে করতে হবে। স্ট্রেচার আবশ্যক। না পাওয়া গেলে বড় শক্ত কাঠের তক্তা বা এই জাতীয় জিনিস ব্যবহার করা যেতে পারে। কোন অবস্থাতেই বেশি নাড়াচাড়া করা যাবে না।
- মেরুদণ্ড স্বাভাবিক অবস্থায় রাখতে পিঠের নিচে কিছু অংশে বালিশ জাতীয় নরম কিছু দিয়ে ঠেশ দিয়ে রাখতে হবে।
- কোন অবস্থাতেই মেরুদণ্ডে যেন টান না লাগে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মাথা ও ঘাড় যেন কোন ভাবে না নড়ে যায় তার জন্য সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
- কৃত্রিম শ্বাস দিতে হলে মাথা ও ঘাড় নাড়াচাড়া করা যাবে না। আঙ্গুল দিয়ে হাল্কা করে নিচের চোয়াল আলগা করে কৃত্রিম শ্বাস এর ব্যবস্থা করতে হবে। বমির কারণে কাত করতে হলে একাধিক জন মিলে একশাথে রোগীকে সামান্য কাত করতে পারেন। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যেন মাথা, ঘাড় আর মেরুদণ্ড যেন এক সারিতে থাকে।
Collarbone ভাঙলে –
[caption id="attachment_586" align="alignleft" width="249"]

[caption id="attachment_588" align="alignright" width="271"]

আমাদের কাঁধের কাছে এর অবস্থান।
- ভাঙ্গা হাড়ের দিকের বগলে নরম কাপড় বা প্যাড দিয়ে ঊর্ধ্ববাহুকে স্বাভাবিক অবস্থায় এনে মোটা ব্যান্ডেজের সাহায্যে বেঁধে দিতে হবে। তারপর নিম্নবাহু বুকের উপর রেখে আরেকটি কাপড়ের সাহায্যে সুস্থ হাতের দিকে কাঁধের উপর বেঁধে দিতে হবে, যেন নাড়াচাড়া না করতে পারে। এতে ভাঙ্গা স্থানও স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে।
ঊর্ধ্ববাহু ভাঙলে –
[caption id="attachment_595" align="alignright" width="260"]

- আহত হাতের নিম্নবাহু ভাঁজ করে এমনভাবে রাখেন যেন আঙ্গুল কাঁধ স্পর্শ করে। পারলে হাত ও বুকের মাঝখানে একটা নরম কাপড় বা প্যাড দিয়ে দেন।
- এবার হাতটি গলার সাথে মোটা ব্যান্ডেজের সাহায্যে ঝুলিয়ে দেন।
- একটি ঊর্ধ্ববাহুর সমান সোজা লাঠির সাথে ভাঙ্গা হাত ও শরীর ব্যান্ডেজ এর সাহায্যে পেঁচিয়ে দেন, একটি কাঁধের নিচ দিয়ে, আরেকটি কনুই এর উপর দিয়ে। ভুল করে ভাল হাতটি পেঁচিয়ে দিয়েন না।
- যদি একাধিক স্থানে হাড় ভাঙ্গা থাকে এবং হাত ভাঁজ না করা যায় তবে হাত সোজা করে শরীরের পাশে নিয়ে ব্যান্ডেজ দিয়ে নিম্নলিখিতভাবে বাঁধতে হবে –
- শরীর ও বাহু জড়িয়ে।
- শরীর ও কনুই জুড়িয়ে।
- কব্জি ও উরু জড়িয়ে।
প্রয়োজনমত প্যাড ব্যবহার করেন।
নিম্নবাহু ভাঙলে –
[caption id="attachment_590" align="alignright" width="105"]

[caption id="attachment_589" align="alignleft" width="137"]

- কনুই ভাঁজ করে ঊর্ধ্ববাহুর সাথে সমকোণ করে রোগীর নিম্নবাহু এমনভাবে রাখেন যেন হাতের তালু শরীরের দিকে আর বুড়া আঙ্গুল উপরের দিকে থাকে।
- দুটি শক্ত কাঠি ব্যবহার করে ব্যান্ডেজের সাহায্যে রোগীর নিম্নবাহু পেঁচিয়ে ফেলেন, যেন হাড় ঠিক স্থানে সোজা হয়ে থাকে।
- এরপর রোগীর হাত একটি কাপড়ের সাহায্যে গলার সাথে ঝুলিয়ে দেন।
হাঁটু বা পায়ের অন্য কথাও ভাঙলে –
[caption id="attachment_591" align="alignleft" width="227"]

- রোগীকে চিত করে শোওয়ায়ে দেন।
- ভাঙ্গা পায়ের নিচে বা দুই পাশে, পায়ের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একটি লম্বা কাঠের তক্তা বা সোজা লাঠি রেখে ব্যান্ডেজের সাহায্যে তা নিম্নলিখিতভাবে বেঁধে ফেলেন –
- উরুতে একটি বাঁধ।
- গোড়ালি ও পায়ের পাতা জুড়িয়ে একটি বাঁধ।
- পা স্থির রাখার জন্য যতটা প্রয়োজন পায়ের বাকি অংশে ততটা বাঁধ দেন। ভাঙ্গা স্থানের কাছে বাঁধ দেয়ার সময় সাবধানতা অবলম্বন করেন।
- হাঁটু ভাংলে হাঁটুর ঠিক উপরে একটি ব্যান্ডেজের মধ্যভাগ রেখে তা পেঁচিয়ে হাঁটুর ঠিক নিচে এসে গিঁট মেরে দেন।
- তক্তা ও পায়ের মাঝে যত সম্ভব প্যাড বা নরম কাপড় ব্যবহার করেন।
- সকল অবস্থায় সবসময় যেন রোগীর ভাঙ্গা পা উঁচু করে রাখা যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে।
[caption id="attachment_592" align="alignright" width="168"]

পায়ের পাতা ভাঙলে –
- গোড়ালি থেকে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত দীর্ঘের একটি কাঠের তক্তা নেন।
- ব্যান্ডেজের সাহায্যে তক্তাতিকে পায়ের সাথে যত ভাল ভাবে বাঁধা যায় বাধেন।
- এবার আরেকটি ব্যান্ডেজের সাহায্যে পেঁচিয়ে পায়ের গোড়ালি সহ পাতা পেঁচিয়ে ফেলেন।
- পা সবসময় একটু উঁচুতে রাখতে হবে।
সন্ধিচ্যুতি –
একটি হাড় আরেকটি হাড়ের সাথে যেখানে মিলেছে তাকে সন্ধি বলে। অনেক সময় আঘাত পেলে বা টান খেলে হাড় তার সন্ধি থেকে ছুটে যেতে পারে। এ অবস্থায় টানাটানি করে হাড়কে জায়গায় বসানোর চেষ্টা না করে যেভাবে রোগী আরাম পায় সেভাবে তাকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
[caption id="attachment_596" align="alignright" width="156"]

মচকানো –
এটা আমাদের প্রায় প্রতিদিনেরি ঘটনা।
- মচকানো জায়গা নাড়াচাড়া করা যাবে না। যতটা সম্ভব আরামদায়ক অবস্থায় রাখতে হবে।
- মচকানো জায়গায় বরফ দেন, রোগী আরাম পাবে।
- সম্ভব হলে ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে দেন, এতে নাড়াচাড়া কম হয়।
- আহত জায়গা সামান্য উঁচুতে রাখার ব্যবস্থা করেন।
সব ধরনের হাড় ভাঙ্গনের প্রতিবিধান একবারে ব্যাখা করা সম্ভব না, এর বেশিরভাগ আমি নিজেও জানি না। আমরা শুধু চেষ্টাই করে যেতে পারি। চেষ্টা করে যেতে হবে, শিখে যেতে হবে; শেখার কোন শেষ নেই। কোন পরিস্থিতি কখন এসে হাজির হয় তা কেউ বলতে পারে না। একজন প্রাথমিক প্রতিবিধানকারী হিসেবে আপনার উপস্থিত বুদ্ধি রোগীর অবস্থার উন্নতি ঘটাতে অনেক সাহায্য করবে। তৎপর থাকেন, দ্রুত চিন্তা করেন, হাতের কাছে যা আছে ব্যবহার করতে শিখেন, বিপদে মানুষের অনেক উপকার করতে পারবেন। এর বিনিময় আপনি কি পাবেন? যা কোটি টাকা দিয়েও কেনা যায় না, মানসিক প্রশান্তি!
ধন্যবাদ্য
ReplyDeleteঅনেক গুরুপ্তর্পূন তথ্য পেলাম।
আমি কি কিছু প্রশ্নের উওর পেতে পারি কারন আমার পায়ের গোড়ালি ভেঙ্গে গিয়েছে।
fracture is noted in coronoid process of ulna সামান্য ফেটে গেছে সমাধান দিন
ReplyDelete