Wednesday, October 9, 2013

জানা-অজানায় চে

বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে এমন তরুণ প্রজন্মের কাছে চে গুয়েভারা এক প্রবাদপ্রতীম চরিত্র। শুধু বামপন্থার রাজনীতি করে এমন তরুণরা নয়, পরিবর্তন ও ন্যায়ের স্বপ্ন দেখা যেকোনো তরুণই চে’র ভক্ত। আর সে কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার আশেপাশে আমরা দেখতে পাই চে’র মাথার ক্যাপ, চে’র ছবিযুক্ত টি-শার্ট কিংবা ব্যাগ। তরুণরা চে’কে শরীরে মেখে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। আর সে কারণেই তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিতে চে গুয়েভারার আদর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চে গুয়েভারার নাম শোনেন নি, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এমন তরুণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। চে সম্পর্কে আমরা সবাই কম-বেশি জানি। তার সম্পর্কে আরেকটু জানার কিংবা জানাবার ধৃষ্টতা দেখিয়েছি এখানে। চে গুয়েভারার প্রকৃত নাম ‘আর্নেস্তো গেভারা দে লা সের্না’। তবে তিনি ‘চে গেভারা’ নামেই অধিক পরিচিতি পেয়েছেন। স্প্যানিশে চে অর্থ প্রিয়। ‘চে গেভারা’ অর্থ ‘প্রিয় গেভারা”। ভালোবেসে মানুষ তাকে এ নামে ডাকতো। তার নাম ইংরেজিতে উচ্চারণ করলে গুয়েভারা হয়, স্প্যানিশে কিন্তু গেভারাই। চে’র জন্ম ১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনায়। পেশায় তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে তিনি সমগ্র লাতিন আমেরিকায় ঘুরতে বের হন। সে সময় লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের দারিদ্র্যের সামগ্রিক রূপ দেখে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন এবং এ অঞ্চলের দারিদ্র্য দূরীকরণের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। জন্মসূত্রে বা জাতিগতভাবে চে আর্জেন্টিনার নাগরিক হলেও মানসিকভাবে তিনি আসলে গোটা লাতিন আমেরিকারই নাগরিক ছিলেন। অবশ্য পরে দেখা যায় তিনি আসলে একজন বিশ্ব নাগরিক ছিলেন। পৃথিবীর যে প্রান্তেই বৈষম্যের শিকার মানুষ ছিল সে প্রান্তেই তিনি ছুটে গিয়েছেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে।

CheG1951

পারিবারিক প্রভাব বা কবিতার প্রতি অনুরক্ততাই হয়তো বাল্যকাল থেকে তার মাঝে বিপ্লবী চেতনার জন্ম দেয়। আর সে কারণেই ১৯৫১ সালে বুয়েস আইরেস বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র থাকাকালীন তিনি এক বছরের জন্য শিক্ষাবিরতি দিয়ে মোটর সাইকেলে করে বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদোর সাথে পেরুর দিকে রওনা দেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পেরুর সান পাবলো লেপার কলোনীতে (কুষ্ঠ রোগীদের বিশেষ কলোনী) স্বেচ্ছা সেবক হিসেবে কাজ করা। যাত্রা পথে তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষকদের দরিদ্র জীবনযাত্রা দেখে চরম ব্যথিত হন। তিনি দেখতে পান কীভাবে দরিদ্র কৃষকেরা মহাজনদের দ্বারা অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। একই সাথে লেপার কলোনীতে কুষ্ঠ রোগীদের পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ববোধ দেখে অভিভূত হন। এ ভ্রমন অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি যে ডায়েরী লেখেন তা ‘দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরীজ’ নামে সুপরিচিতি লাভ করে। লাতিন আমেরিকায় এ সামাজিক বৈষম্য দূর করার জন্য তিনি গুয়েতেমালার রাষ্ট্রপতি জাকাবো আরবেনজ গুজমানের নেতৃত্বে গুয়েতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে সিআইএ’র ষড়যন্ত্রে গুজমানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে চে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাবার পক্ষে আরো সংকল্পবদ্ধ হয়ে পড়েন।

চে’র আনুষ্ঠানিক বিপ্লবী জীবন শুরু হয় কাস্ত্রো ভ্রাতৃদ্বয়ের সাথে সাক্ষাতের পর থেকে। ১৯৫৪ সালে গেভারা মেক্সিকো শহরে গিয়ে একাধিক হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালের জুন মাসে তার সাথে দেশান্তরী রাউল ও ফিদেল কাস্ত্রোর পরিচয় ঘটে। রাউল ও ফিদেল তখন কিউবার মার্কিন-মদদপুষ্ট একনায়ক ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করছিলেন। কিউবায় বাতিস্তা সরকার পতন আন্দোলন চালানোর জন্য যে বিপ্লবী দল পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিলেন ফিদেল সে দলে একজন চিকিৎসক রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন তিনি। চে গেভারা সানন্দে বিপ্লবী দলের সাথে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতে রাজি হন। ১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটানোর উদ্দেশ্য একটি বিপ্লবী দল মেক্সিকো থেকে কিউবার দিকে গ্রানমা নামক এক ছোট্ট কেবিন ক্রুজারে রওনা হয়। কিউবার লাস কালোরাডাস উপকূলে বাতিস্তার সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হতে হয় তাদের। সেখানে চে’ তার ৮২ জন সহযোদ্ধাকে হারান। মাত্র ২১ জন বিপ্লবীকে নিয়ে চে সিয়েরা মস্ত্রা পর্বতমালার দিকে রওনা হন। চে যোদ্ধা ছিলেন না। তিনি ছিলেন দলের চিকিৎসক। তার কাছে ছিল ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসাসামগ্রীর একটি বাক্স। কিন্তু ৮২ জন কমরেড নিহত কিংবা ধরা পড়ার পর চে’র দল যখন পালিয়ে যাচ্ছিল তখন একজন সহযোদ্ধার ফেলে যাওয়া গোলাবারুদের বাক্স তুলে নেন চে। ওষুধ ও গোলাবারুদের বাক্স একত্রে বহন করা তার জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ছিল। এক পর্যায়ে তিনি ওষুধের বাক্স ফেলে দিয়ে শুধু গুলির বাক্স নিয়ে পথচলা শুরু করেন। আর ঠিক সেই মূহুর্তেই চিকিৎসক চে গেভারা পরিণত হন একজন যোদ্ধায়।

Che Guevara

সিয়েরা মস্ত্রা পর্বতমালায় আশ্রয় নেয়া বিপ্লবী দল পুনরায় সংঘবদ্ধ হতে পেরেছিল। চে স্থানীয় কৃষক ও সাধারণ মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করতে শুরু করলেন। আস্তে আস্তে বিপ্লবীদের দল বড় হতে লাগল। চিকিৎসক কাস্ত্রো হয়ে উঠলেন যোদ্ধা। তিনি বিপ্লবীদের সামরিক প্রশিক্ষণও প্রদান করতেন। এক সময় স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু করেন। রণকৌশল এবং কূটনৈতিক নানা বিষয়ে ফিদেল কাস্ত্রোকে গেভারা পরামর্শ দিতেন। টাইম ম্যাগাজিন চে’কে ‘কাস্ত্রোর মস্তিষ্ক’ উপাধি দেয়। চে’ বিপ্লবী দলের একজন কমান্ডার হিসেবে কাজ করতে থাকেন। কর্তব্যে অবহেলাকারীদের নির্দ্বিধিয়া গুলি করতেন তিনি। এভাবে এক ভয়ংকর যোদ্ধা হয়ে ওঠেন তিনি এক সময়। দীর্ঘ দিন বিপ্লব চলার পর উপায় না পেয়ে ১৯৫৯ সালের ২ জানুয়ারি একনায়ক বাতিস্তা ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে গেল। বিপ্লবীদের কমান্ডার চে কিউবার রাজধানী হাভানায় বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করলেন। আমজনতা তাদের সাদরে বরণ করে নিল। কিউবা বিপ্লবে সফল নেতৃত্ব দানই চে গেভারার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।

একনায়ক বাতিস্তাকে অপসরণ করে বিপ্লবী কাস্ত্রো সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর গেভারা অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি কিউবার শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় একদিন বিপ্লবীদের অধিবেশনে ফিদেল কাস্ত্রো জিজ্ঞেস করেন তাদের মাঝে কোনো ‘ইকোনমিস্ট’ আছেন কিনা। কিন্তু চে ভুলে শুনতে পান “কোনো কমিউনিস্ট আছে কিনা”। ফলে তিনি নির্দ্বিধায় হাত তোলেন এবং কাস্ত্রো তাকে ব্যাংক অব ন্যাশনাল বা কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান করে দেন। এসময় কিউবার নোটে তাঁর স্বাক্ষর হিসেবে শুধু ‘চে’ লেখা থাকত।

১৯৬৫ সালে কিউবার শুভেচ্ছাদূত এবং বিশ্ব বিপ্লবীদের কূটনীতিক হিসেবে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আফ্রিকা সফরে যান। সফর থেকে কিউবায় ফিরে ফিদেলের সাথে ৪০ ঘন্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন চে’। এ বৈঠকের পর চে’ একেবারে গায়েব হয়ে পড়েন। তার অবস্থান সম্পর্কে কেউ কোনো খোঁজ পাচ্ছিল না। আসলে চে’ গেভারা নতুন মিশনে নেমেছিলেন। কিউবায় তার কাজ শেষ। এবার তাকে নতুন কোনো বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে হবে। সে লক্ষেই ১৯৬৫-৬৬ সালে আফ্রিকায় বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। আফ্রিকার মানুষ তাকে নাম দিয়েছিল ‘মুগান্দা’ যার অর্থ ‘ত্রাণকর্তা’। আর গেরিলারা তাঁকে সম্বোধন করতো কমান্ডার ‘তাঁতু’ নামে। তিনি তখন কঙ্গোবাসীর স্বাধীনতা নিয়ে বিপ্লব করছিলেন। কিন্তু বিপ্লবীদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে তার সে বিপ্লব সফল হয় নি। পরে তিনি কিউবায় ফিরে আসেন।

Che-Guevara-che-guevara-30524289-384-321

হাভানায় থাকাকালীন চেয়ে চিন্তা করেন বলিভিয়ায় মার্কিন মদদপুষ্ট সরকার পতনের। বলিভিয়ার জনগণের মুক্তির জন্য তিনি কিউবার সিক্রেট সার্ভিসের সহযোগিতায় উরুগুয়ের নাগরিকের ছদ্মবেশে বলিভিয়ায় প্রবেশ করেন। ১৮ জন বিশ্বস্ত কিউবাঙ্কে নিয়ে মোট ৫০ জনের একটি গেরিলা দল গঠন করেন চে। কিন্তু বলিভিয়ার কমিনুনিস্ট পার্টির কাছ থেকে তারা কোনো সহায়তা পায় নি। এমনকি রাশিয়ার সাথে মার্কিনিদের সদ্য সুসম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় রাশিয়াও সেভাবে বিপ্লবীদের সাহায্যে এগিয়ে আসে নি। বিপ্লবীদের মনোবল আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যায়। অনেকে পালিয়েও যায়।  বলিভিয়ার সামরিক বাহিনীর সাথে পেরে উঠতে ব্যর্থ হয় চে’র বিপ্লবী দল। এক সময় তিনি ধরা পড়েন। বন্দী অবস্থায় ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বিপ্লবের রাজপুত্র চে গেভারাকে হত্যা করে সেনাবাহিনী।

Che_on_Mule_in_Las_Villas_Nov_1958

আজ ৪৬ বছর পরে ২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর। ৪৬ বছর ধরে চে’ আমাদের সাথে নেই। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘গুয়েভারার প্রতি’ কবিতার প্রথম লাইনেই লিখেছেন, “চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়”। শুধু সুনীলকে না, চে’র মৃত্যু পৃথিবীর স্বাধীনতাকামী সকল মানুষকেই অপরাধী করে দেয়। যুগে যুগে বিপ্লবের দিশারী, পরিবর্তনের দিশারী, মুক্তিকামী মানুষের নেতাদের প্রাণ হারাতে হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে। কিন্তু তবুও বিপ্লব থেমে থাকে নি। চে’র জীবন আরো হাজারো বিপ্লবীর জন্ম দিয়েছে, দিচ্ছে, ভবিষ্যতেও দিয়ে যাবে। চে’কে হত্যা করার আগের একটি ঘটনা বলেই লেখা শেষ করবো। বন্দী অবস্থায় চে’কে এক তরুণ সেনা কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করে, “আপনি কী ভাবছেন?” চে’ উত্তর দেন, “আমি বিপ্লবের অমরত্বের কথা ভাবছি”। হ্যাঁ, সত্যিই তো। চে মারা গিয়েছেন, কিন্তু বিপ্লব তো মারা যায় নি। বিপ্লব তো অমর।

No comments:

Post a Comment