Tuesday, January 21, 2014

পুণঃপ্রচারিত

আজ নিজেকে নিজের কাছে খুব হাস্যকর আর অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে। কখনো ভাবি নি, আমার জীবনে এমন বাংলা সিনেমার কাহিনী সত্য হয়ে যাবে। অবশ্য আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। বাসাভর্তি গেস্ট, সবাই যারপরনাই খুশি; যাক এবার অন্তত রায়ানের একটা ব্যবস্থা হল।

একটু আগে বাবা এসে বলে গেলেন, ‘‘তাড়াতাড়ি গোসল করে তৈরি হয়ে নে। বারোটা বাজতে খুব বেশী দেরি নেই।’’ আমিও ভাবছি, এখন যদি ফারিহা থাকত,তবে সে কিভাবে দেখত বিষয়টা। মাত্র বছর দেড়েক আগেও ওকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল দুচোখে। আজ সবই অতীত। আমাদের সেগুনবাগিচার ছোট্ট ফ্ল্যাটটাতে বেশ সুখের একটা সংসার পেতেছিলাম। সময়মত ঘুম থেকে সকালে উঠা, নিয়ম করে বাজার করা, অফিস শেষে বিকেলে দুজনের একসাথে বাড়ি ফেরা- এটাই ছিল নিত্যদিনের রুটিন। কখনো কখনো সন্ধ্যায় নাট্যশালায় নাটক দেখতে যাওয়া আর নাটক শেষে দুজনের বাইরে খেয়ে বাসায় আসা- এযেন নবদাম্পত্য জীবনের যান্ত্রিক কর্পোরেট ভালবাসা। নিজেদের মধ্যে হওয়া খুনসুটিগুলোই যেন দাম্পত্য কলহের একমাত্র উপলক্ষ্য। তারপর একদিন আমাদের এজীবনে ঘটল ছন্দপতন।

সেদিন ছিল বুধবার, আমি অফিসের কাজে গাজীপুরে গিয়ে ফিরতে দেরি হওয়ায় বাইক নিয়ে ফারিহাকে তার অফিস থেকে পিক করতে যেতে পারিনি। তাই সে সেদিন নিজের মত করেই বাসে করে বাসায় ফিরছিল। মোহাম্মদপুর থেকে সুপার সার্ভিস বাসে করেই ফিরছিল সে। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে শেষ বিকেলে অনেক যুদ্ধ করেই হয়তো সে সেই বাসে উঠতে পেরেছিল। আমি রাত ৯টায় বাসায় কোনমতে বাসায় ফিরে দরজায় কলিং বেল দেই। কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে নিজের কাছে থাকা চাবিটা দিয়েই দরজা খুলি, মনে করি যে সে বাথরুমে। কিন্তু একি! ফারিহা, ফারিহা, ফারিহা।।। সারা ঘর খুঁজেও যখন ওর কোন চিহ্ন পাই না,তখন হাত-পা শীতল হয়ে যায়। মোবাইল কল দিচ্ছি, কিন্তু বারবার একই কথা, ‘সংযোগ দেয়া সম্ভব নয়’; ওর কলিগ, বন্ধু-বান্ধব, আমাদের রিলেটিভস সবার সাথে কথা বললাম। কোন সংবাদ না পেয়ে মনে করলাম আমার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে আশেপাশে কোন ভাবির বাসায় গেল কি না, তাই ছুটে গেলাম পরিচিত ফ্ল্যাটগুলোতে। এদিকে ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁই ছুঁই করছে, আমার তখন ভয়ে শেষ হয়ে যাওয়ার যোগাড়।

ওর সাথে তো আমার তেমন কোন বড় ঝগড়ার কথাও মনে পড়ে না গত দু’সপ্তাহে। কি হল ওর? প্রচণ্ড টেনশনেই খোঁজ নিতে শুরু করি সবার সাথে আবার। আমার এই অবস্থা শুনে ছোট ভাই আবির রাত এগারটায় ছুটে আসে আমার ফ্ল্যাটে। এসেই জিজ্ঞেস করে, ‘‘দাদা, কোন খবর পেলি? কাল তো আবার হরতাল, ভাবিকে এর মাঝে যে কোথায় খুঁজি? তুই কি কোন খারাপ ব্যবহার করেছিলি ভাবির সাথে?’’

কোনভাবেই ওর খোঁজ না পেয়ে একপ্রকার নিরুপায় হয়েই রাত বারোটায় বাইকে করে মতিঝিল থানার দিকে ছুটি। সেখানে থানার সেকেণ্ড অফিসার সব শোনার পর জিডি করতে বলেন আর ছবি দিয়ে যেতে বলেন। তার কাছেই শুনতে পাই, কাকরাইলের মোড়ে সন্ধ্যায় বেশ কিছু গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। তার পরামর্শতেই অজানা আশংকা নিয়ে হাজির হই ডিএমসিতে।

পরদিনের পত্রিকার শিরোনামঃ কাকরাইল মোড়ে বাসে আগুননারীসহ ২ জন অগ্নিদগ্ধ – ফারিহা বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। বাঁচার জন্য সে জানালা দিয়ে বের হবার শেষ সুযোগটুকুও নিয়েছিল। কিন্তু পারে নি, শরীরের ৮০ ভাগই পুড়ে গিয়েছিল। হসপিটালে আনার আধঘন্টার মধ্যেই মারা যায় সে। তাকে শনাক্ত করতে হয়েছে পা আর চোখ দুটো দেখে, দুই চোখের মাঝে ছোট্ট একটা কালো টিপ। বিয়ের এক বছরের মাথায় সে হারিয়ে যায় আমার কাছ থেকে, সাথে নিয়ে যায় আমাদের ভালবাসার স্পন্দনটাও(যে ফুল কুঁড়ি না হতেই হারিয়ে গেল এই পৃথিবী থেকে)।

তারপর থেকে আমি একা, শুরু হয় আবার দুর্ভাগ্যের ব্যাচেলর লাইফ। যান্ত্রিক অফিসজীবন, বাসায় ফিরে মুভি দেখা আর ফেসবুকে টাইম পাসিং। খাবার-দাবার নিজের মতো কোনমতে চালিয়ে নেয়া। ছুটির দিনগুলো হঠাৎ করেই খুব অসহ্য হয়ে উঠতে লাগল। নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হত। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে কেমন যেন অসামাজিক হয়ে উঠছিলাম। পরিচিত কারো সাথে দেখা করতে ভাল লাগত না; সবার এক কথা, ‘তুই বিয়ে কর।’ ভাল্লাগে না আর সং সাজতে।

ফারিহার মৃত্যুর পর এভাবেই কেটে যাচ্ছিল আমার সময়, ক্যালেন্ডারের পাতায় কখন যে ছটা মাস পার হয়ে গেল? টেরই পাই নি। এক শুক্রবারে বিকেলে সিনেমা দেখে স্টার সিনেপ্লেক্স থেকে বের হয়ে ফুডকোর্টে বসে আছি। এমন সময় হঠাৎ দেখা হয় নিশার সাথে অনেকদিন পর।

নিশা আমার কলেজ লাইফের বন্ধু, খুব ভাল বন্ধু ছিলাম আমরা। ডিজুসের তখন প্রথম মিনিট পরে ফ্রি টকটাইমের মৌসুম। আমরা সারারাত ধরে কথা বলতাম, disconnect হলে আবার কল দিয়ে কথা বলতাম। জীবনে প্রথম যে মেয়েটার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ হয়েছিল, সে হল নিশা। পড়াশোনায় সবধরণের হেল্পই সে করত। অনার্সে ফাইনাল ইয়ারে থাকতে তার বিয়ে হয়ে যায় এক ডাক্তারের সাথে। ওকে দেখে এইসব ভাবছি যখন সে এসে বলল, ‘‘তুমি রায়ান না?’’ ‘‘আরে,চিনতে পারলি তাহলে? তোমার খবর কি, নিশা? ভাই কেমন আছেন? ভাগ্না-ভাগ্নি কিছু হল? কোন খবর রাখলি না?’’ একসাথে একগাদা প্রশ্ন শুনে নিশার তখন ভিরমি খাওয়ার অবস্থা, ‘আগে বসতে বল, এখনো আগের মতো অস্থিরই আছিস।’

তারপর কথায় কথায় জানা হল, সাজ্জাদ ভাই চিকিৎসক হলেও নিজের শরীরকে ফাঁকি দিতে পারলেন না। ২০১২র মে মাসের মাঝামাঝি খুব বেশি জ্বর, টানা দুসপ্তাহ ছিল। তারপর থেকে থেকে প্রতিরাতেই জ্বর আসত। কোন diagnosisএই কাজ হচ্ছে না। হাজারটা টেস্ট বিভিন্ন প্যাথলজি সেন্টারে অর্ধশতবার করার পর জানা গেল, লিম্ফোসাইপটেমিয়া, একদম ফাইনাল স্টেইজ। ব্লাড ট্রান্সফিউশন করেও খুব একটা সুবিধা হবে না। তবুও আরো মাস পাঁচেক বেঁচে ছিলেন তিনি। তারপর থেকেই নিশা ঢাকা শহরের এক নিঃসঙ্গচারিণী। হাজবেন্ড মারা যাওয়ার পর সে এখন ইস্কাটনে খালার সাথেই থাকে আর তার চাকরিটাতো ছিলই আগে থেকে।

দীর্ঘবিরতির পর বন্ধুত্ব ঝালাই করতে দুজনেই ফেসবুকে ফ্রেন্ড হলাম, অনেকদিন পর সেই কলেজ লাইফের আড্ডাও দিলাম বসুন্ধরা সিটির আভিজাত্যের মাঝে। কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, টেরই পাই নি দুজনের কেউ। বিদায়বেলায় ফোন নাম্বার নিয়ে বেরিয়ে বাসায় ফিরব, তখন তার বাসে যাওয়ার কথা শুনে আমার বাইকে এগিয়ে দেবার প্রস্তাব দিই।

সেদিন বাসায় ফিরে আবার যান্ত্রিকতায় ডুবে যাই। নতুন সংযোজন শুধু ওর সাথে ফেসবুকে চ্যাট, স্ট্যাটাসে কমেন্ট আর লাইক দেয়া। মাঝে মাঝে আশুলিয়াতে বাইকে করে ঘুরতে যাওয়া, জাবি ক্যাম্পাসে ঘুরে ফেরা। কখন যে আবার নতুন করে সং সেজে সংসার সাজাবার ভূত চাপল দুজনের জানি না।

এই, বারোটা বুঝি বেজেই গেল, যাই বরের নওশা সাজ নিয়েই আসি।

2 comments: