Thursday, May 1, 2014

মিষ্টির দোকান

আমি বড় হয়েছি আজিমপুর এলাকায়। ইডেন কলেজের সামনে দিয়ে যাতায়াত করতে হতো। দেখতাম হাতে করে, মাথায় করে কিছু বৃদ্ধ ব্যক্তি মিষ্টি আর বাকরখানি বিক্রি করেন। পথিক তাদের থামিয়ে তৃপ্তি নিয়ে বাকরখানি দিয়ে মিষ্টি খেয়ে তেলের ক্যান থেকে পানি ঢেলে ঢক ঢক পান করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে। আজিমপুরের বটতলায় দেখেছি হরিপদের মিষ্টির দোকান সকালে নাস্তার দোকানে পরিণত হতো। পরোটা, ভাজি, মিষ্টির শিরা দিয়ে তৈরি অসাধারণ সুজি। চাইলে পরোটা নিয়ে হরেক রকম মিষ্টি, জিলাপি সব খাওয়া যাবে। মনে পড়ে, আব্বা ঢাকা কলেজের উল্টা দিকের যাদব ঘোষ থেকে দই-মিষ্টি আনতেন। ইচ্ছা হলেও যাদব ঘোষে বসে এক পিস কালোজাম আর এক প্লেট দই খাওয়া যেত। আমাদের মিষ্টির দোকানগুলোতে সকাল বেলা অবধারিতভাবে পরোটা আর সুজি পাওয়া যেত। আমাদের মিষ্টির দোকানগুলোর নাম ছিল যাদব ঘোষ এন্ড গ্র্যান্ড সন্স, মরণ চাঁদ, মোহন চাঁদ, বিক্রমপুর, আলাউদ্দিন, বোম্বে সুইটস, মুসলিম, বনফুল কিংবা ভাগ্যকুল। এই নামগুলো যেন মিষ্টির দোকানের জন্যেই তৈরি। কিন্তু কোথায় গেল সেই দিনগুলো? আমাদের মিষ্টির দোকানগুলো করপোরেট হয়ে গেল। সকালে সেখানে পরোটা ভাজা হয় না। দোকানে এসি লেগে গেল। প্রাচীন আমলের ফোম দেখা যাওয়া সোফায় বসে তৃপ্তি নিয়ে নিমকি দিয়ে এক পিস মিষ্টি আর ছোট্ট স্টেইনলেস স্টিলের বাটিতে একটু খানি দই খাওয়া যায় না। মিনিমাম হাফ কেজি মিষ্টি নিতে হবে, মিনিমাম এক পাতিল দই নিতে হবে। আমরা ইংরেজ হয়ে গিয়েছি। আমাদের আর আধা কেজি নাই, আমাদের সব ‘হাফ’ হয়ে গিয়েছে। আমাদের নূন্যতম এখন মিনিমাম। এখন আর পাতিলের ওজন বেড়েছে, সমানুপাতিক হারে দইয়ের জন্য কমেছে। বাইরে থেকে পাতিলের অনেক ঘোপ, কিন্তু তলায় অনেকটাই পুরু সে পাতিল। সব যেন ছদ্মবেশ! ইংরেজদের ভাষায় ক্যামোফ্লজ।

kalojam  e

মিষ্টির দোকানের সহকারীরা আর কম দামী সাফারি স্যুট টাইপের পোশাক পরেন না। তারা এখন শার্ট-প্যান্ট শু পরা ফর্মাল। যেন সব এমবিএ। দোকানে ঢোকার সাথে সাথে “স্যার, সুইটস লাগবে?”। মিষ্টি এখন সুইটস। কথা বলতে বলতে পকেট থেকে রিসিট হাতে চলে আসে তাদের। দোকানে চেয়ার-টেবিল আছে। কিন্তু তা বসে এক পিছ মিষ্টি খাওয়ার জন্য না। অনেক অর্ডার করলে বসে অপেক্ষা করার জন্য। দোকানের নাম আর যাদব ঘোষ, বিক্রমপুর, মুসলিম না, সব ইংরেজ নাম। প্রিমিয়াম, প্রিমিয়ার, প্রমিনেন্ট। ইংরেজি মানেই ইশট্যান্ডার্ড। কোথায় আমার সেই রাস্তায় ফেরি করে বেড়ানো বাকরখানি আর মিষ্টি আলা? কোথায় আমার সেই তেলের ক্যান? সব তো ফিল্টারের জার! সব কর্পোরেট। সবখানে ফর্মালিটিজ।

rasogolla

কয়েকদিন আগে গেলাম এক মিষ্টির দোকানে। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল দোকানে বসেই একটু স্টেইনলেস স্টিলের ছোট্ট থালায় দই খাবো। এক পাতিল নিতে হবে। ভালো কথা। নিলাম। নিমকি দিয়ে কালোজাম আমার খুব পছন্দের। বাসায় কালোজাম ছিল। ভাবলাম ‘হাফ’ কেজি নিমকি নিয়ে যাই। এরপরই বাধলো গলদ। দোকানে ঠোঙ্গা নাই। এদিকে মিষ্টির প্যাকেটে নিমকি দিতেও তাদের খুব আপত্তি। ৫০ টাকার নিমকির জন্য একটা প্যাকেট চলে যাবে??? জান যাবে তো প্যাকেট যাবে না। প্যাকেটের দাম নাকি ৮ টাকা। সব কথা আমার সামনেই হলো। কোনো লাজ-লজ্জার বালাই-ই নেই। অতঃপর বুদ্ধিমান কর্মচারী একখানা তরিকা বের করতে সক্ষম হলেন। দোকানের বাইরে ফুটপাতে বসে থাকা ফলের দোকানদারের থেকে একটা ঠোঙ্গা চেয়ে আনলেন। আমাকে সেই ঠোঙ্গায় নিমকি দেয়া হলো। মনে আছে, বাল্যকালে মিষ্টির দোকানে রস চুয়ায় যাতে না পড়ে সেজন্য ডবল প্যাকেটে মিষ্টি দিতেও আপত্তি করতো না দোকানীরা। যা হোক, এখন আধুনিক যুগ বলে কথা। এখন তরমুজ, পেঁপে, বাঙি সব গুঁড়ের মতো থুক্কু স্যাকারিনের মতো মিষ্টি।

Kalo_Jam_sweets

‘সুইটস’ এর প্যাকেটের দামও বাড়তি, আআআআট টাকা। আগের মতো সাদা প্যাকেটের ওপর রং-বেরঙের ঢাকনা নাই। ঢাকনা আর তলা একসাথে। মিষ্টির চেয়ে প্যাকেট ভারী। মিষ্টি উঠায় রাখার পর প্যাকেটের ওজনও আড়াইশো গ্রামের মতো অনুভূত হয়। একবিংশ শতক বলে কথা। আচ্ছা, চিনির দাম বাড়লে মিষ্টির দাম বাড়ে কিন্তু চিনির দাম কমলে মিষ্টির দাম কমে না কেন?

No comments:

Post a Comment