Tuesday, September 10, 2013

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন: সচেতন হতে হবে কিন্তু আমাদেরই

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘উটপাখি’ কবিতায় আছে “অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?” নাহ। অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকার কোনো সুযোগ নেই। ইউটোপিয়ান সমাজে প্রলয় বন্ধ থাকতে পারে, উন্নত দেশে প্রলয় সীমিত আকারে থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের দেশে চোখ বন্ধ করলে প্রলয় বন্ধ হওয়া তো দূরে থাক, প্রলয়ের মহাযজ্ঞ শুরু হয়ে যাবে। সমাজে চলার জন্য আমাদের শুধু চোখ,কান বা মুখ খোলা রাখাই যথেষ্ঠ নয়, প্রয়োজনে হাত-পাও খোলা রাখতে হয়। মূল কথা হচ্ছে, অসচতেন হলে আপনাকে ঠকিয়ে দিতে পারে যে কেউ।

বাজার করা, পণ্য বা সেবা ক্রয় করা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছিন্ন অংশ। কিন্তু আমরা কি কখনো লক্ষ্য করেছি যে কেনাবেচার এই মহাযজ্ঞে আমরা প্রতারিত হচ্ছি প্রতিনিয়ত?  ওজনে কম দেয়া, নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অধিক দামে পণ্য বিক্রি করা, এক পণ্য দেখি অন্য জিনিস গছিয়ে দেয়া কিন্তু প্রতারণার সামিল। সবচেয়ে বড় য়ে প্রতারণা আমাদের দেশে হয়ে আসছে সেটি হলো খাদ্যে ভেজাল বা বিষাক্ত উপাদান মেশানো। ব্রিটেনে মানুষ হত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া না হলেও খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক মেশালে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কেননা একজনকে হত্যা করলে একজনই মরে কিন্তু খাদ্য বা ঔষধ কিংবা প্রসাধন সামগ্রীতে বিষাক্ত পদার্থ মেশালে হাজার হাজার মানুষের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।

image_332_46256

আমরা অনেকেই জানি, আমাদের দেশে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন’ নামে একটি আইন আছে। খুব শক্তিশালী না হলেও ‘কনজিউমার এসোশিয়েশন অব বাংলাদেশ’ এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর গত ২০০৯ সালে দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন জাতীয় সংসদে পাশ হয়। এ আইনের ফলে ভোক্তা তার প্রাপ্য অধিকার আদায়ের জন্য আইনী রক্ষাকবচের আওতাভুক্ত হবেন। হরমামেশা দোকানপাট বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অমান্য করছে সে বিষয়ে আমরা কতটুকু খোঁজ রাখি? আইন করে কিন্তু সমাজে পরিবর্তন আনা যায় সামান্যই। আইনের প্রয়োগ সর্বোচ্চ করা সম্ভব তখনই যখন সামাজিক সচেতনতা গড়ে ওঠে। যখন কোর্টের বাইরে সামাজিকভাবে কোনো অন্যায় প্রতিরোধের মানসিকতা জনগণের মাঝে তৈরি হয়। যেমন- বাল্য বিবাহের কথাই ধরা যাক। শুধু আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নয়, বরং জনগণের সচেতনতা ও উপলব্ধির মাধ্যমে বাল্যবিবাহ অনেকটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের জন্য যে প্রচারণা সমাজে হয়েছে, ভোক্তা অধিকার রক্ষায় ততটা প্রচারণা হয় নি। প্রচারণা বলতে মোবাইল ফোনে ‘গভর্মেন্ট ইনফো’ পাঠানো পর্যন্তই।

প্রায়ই এমন হয় যে একটি পণ্যের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য লেখা রয়েছে কিন্তু বিক্রেতা বেশি দাম চাইলে বিনা প্রতিবাদে আমরা অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে পণ্যটি ক্রয় করছি। এভাবে কিন্তু আমরা বিক্রেতাদের ধীরে ধীরে প্রশ্রয় দানের মাধ্যমে শক্তিশালী করে তুলছি। একই সাথে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে। হোটেল বা রেস্টুরেন্টে প্রায়ই এমআরপি (ম্যাক্সিমাম রিটেইল প্রাইস) লেখা কোমল পানীয় বা আইসক্রিম অধিক মূল্যে বিক্রি করা হয়। আবার সুপার শপগুলোতে এমআরপি লেখা পণ্যের সাথে অতিরিক্ত মূল্য সংযোজন কর প্রদান করতে হয়। অথচ এমআরপি বা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য অর্থ পণ্যটির জন্য প্রযোজ্য সকল প্রকার কর পরিশোধিত অর্থাৎ, সকল করসহই পণ্যটির সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ওপরে আর কোনো কর প্রদান করতে হবে না। কিন্তু কি অবলীলায় দিনের পর দিন ঝকমকে সুপার শপগুলো আমাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভ্যাট আদায় করে নিচ্ছে। অথচ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের চতুর্থ অধ্যায়ের ৪০ নম্বর অনুচ্ছেদে রয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্য কোনো পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের চেষ্টা করিলে তার অনুর্ধ্ব এক বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন

শুধু তাই নয়, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে জনগণকে প্রতারিত করলে, ভেজাল খাদ্য বা ঔষধ উৎপাদন করলে কিংবা সেখানে নিষিদ্ধ দ্রব্য মেশালেও শাস্তির বিধান রয়েছে এ আইনে। যেমন উল্লেখিত আইনের ৪র্থ অধ্যায়ের ৪২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে মানুষের জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এমন নিষিদ্ধ (আইন বা বিধি দ্বারা) দ্রব্য খাদ্যে মেশালে অপরাধী অনধিক তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবে। অন্যায়ের তুলনায় এখানে সাজা খুবই নমনীয় হয়ে গিয়েছে। ওজনের কারচুপি কিংবা প্রতিশ্রুত সেবা বা পণ্য যথাযথভাবে সরবরাহ না করলেও শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু যথারীতি দেশে আইন থাকলেও, আইনের প্রয়োগ নেই। তাই হরহামেশা আইনের লঙ্ঘন ঘটে চলছে।

complain

সুষ্ঠুভাবে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি আমরা যে যার পর্যায় থেকে যদি সচেতন হই তাহলে সমাজে ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবো। কেউ প্রতারিত করার চেষ্টা করলে প্রথমেই তার প্রতিবাদ করতে হবে। প্রয়োজনে আইনের কথা বিক্রেতাকে অবহিত করতে হবে। এমনকি উক্ত পণ্য বা সেবা ক্রয় থেকে বিরত থাকার ব্যবস্থাও গ্রহণ করা যেতে পারে। সবাই যার যার অবস্থান থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে সমাজে আইনের শাসন কোনোদিনও প্রতিষ্ঠিত হবে না। সচেতন হওয়ার সময় হয়তো পার হয়ে যাচ্ছে, তাই শীঘ্রই আমাদেরকে নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।

 

পাঠকের সুবিধার জন্য নিচে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর লিংক নিচে দিয়ে দিলাম
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯

1 comment:

  1. কাজের জিনিস, তবে মুশকিল হচ্ছে বাস্তবে এটা কাজীর জিনিস (গরু) হয়ে গেছে !

    ReplyDelete