
কোর্টে সাক্ষ্য দিতে গেলেন, উকিল বাবাজী প্রশ্ন করলঃ গত পরশু রাত ৯টায় আপনি কি করছিলেন? আপনি হেসে খেলে এই সহজ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দেখলেন মুখের হাসি মুখেই আছে, জবাব মুখে নেই। হঠাৎ মনে করতে পারছেন না গত একদিনের আগে আপনি কি করছিলেন। সাক্ষ্য দিতে গিয়ে উলটো ফেসে যাবেন না তো?
এটাতো কঠিন এক পরিস্থিতি, চাপের মুখে অনেক কিছুই ভুলে যেতে পারেন। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই মানুষের নাম, টেলিফোন নাম্বার, কবে কি করেছেন, কবে কি করবেন ভাবছেন এমনকি আপনি এই মুহূর্তে এখানে কেন? এই ধরণের প্রশ্নের জবাবও স্মৃতি হাতড়ে বের করতে পারেন না প্রায়ই। দুর্বল স্মৃতিশক্তির জন্য পরিবার বা বন্ধুদের পাশাপাশি নিজেই নিজেকে দুষে হীনমন্যতায় ভুগছেন এমন মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। কিন্তু কেন আপনি এসব বিষয় মনে রাখতে পারছেন না? কে বা কারা আপনার স্মৃতিগুলোর পিছনে এভাবে উঠে পড়ে লেগেছে?
১। অনিদ্রা এবং ঘুমের স্বল্পতাঃ
[caption id="attachment_410" align="aligncenter" width="306"]

ঘুম কম হওয়া আপনার স্মৃতিশক্তি দুর্বল করার একটি বিশেষ কারন, এমনটাই দেখা গেছে এক গবেষনায়। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বারকলে এর এই গবেষনণায় দেখা যায় ঘুমের সময় মানুষের মগজে বিভিন্ন জরুরী উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় যেগুলো স্মৃতি সংরক্ষণে সহায়তা করে। এ সকল উদ্দীপনা তরঙ্গ আকারে মগজের হিপ্পক্যাম্পাস (Hyppocampus) নামক জায়গা থেকে প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স (prefrontal cortex) এ পৌছায়। ঘুমের স্বল্পতার কারনে পূর্ণবয়স্ক মানুষের এই তরঙ্গগুলো হিপ্পক্যাম্পাসেই আটকে থাকে, তা আর প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স এ পৌছাতে পারে না। কম ঘুম শুধু স্মৃতিশক্তি দুর্বল করার পিছনেই নয়, বরং মগজের ক্ষয়েরও একটি কারন।
২। মানসিক চাপঃ
[caption id="attachment_411" align="aligncenter" width="384"]

অতিরিক্ত কাজের চাপ, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি কারনে ক্রমাগত মানসিক চাপ স্মৃতিশক্তির অন্যতম প্রধান শত্রু। আমাদের মগজ যদি ক্রমাগত মানসিক চাপে থাকে তখন তা জরুরী কাজের জন্যে সদা প্রস্তুত থাকার চেষ্টা করে। এটা কেবল কিছু ক্ষেত্রেই ভালো, যেমন যদি সুন্দরবনের ভিতরে বাঘ আপনাকে তাড়া করে, অথবা জাতীয় ক্রিকেট দলের হয়ে ব্যাট করছেন আপনি আর জিততে হলে শেষ বলে দরকার ৪ রান। কিন্তু সবসময়েই মস্তিষ্কের এই সদা প্রস্তুত ভঙ্গি তার স্বাভাবিক কাজকে ব্যহত করে। এজন্য মস্তিষ্ক তার নিউরণ হারায় এবং নতুন কোষ তৈরীতে ব্যর্থ হয়। যার কারনে মস্তিষ্ক স্মৃতি সংরক্ষণে অপারগ হয়ে পড়ে, এমনকি নতুন স্মৃতি ধারনেও তা বিরুপ আচরণ করে।
৩। বিষন্নতাঃ
[caption id="attachment_412" align="aligncenter" width="337"]

বিষন্নতা মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটার নামক রাসায়নিক পদার্থের অভাবের পিছনে দায়ী। এই রাসায়নিক পদার্থগুলোর মাধ্যমে প্রতিটি কোষের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষিত হয় এবং মস্তিষ্ক স্মৃতি ধারণ করে। তাই বিষন্ন মস্তিষ্ক নিউরোট্রান্সমিটারের অভাবে স্মৃতিধারনে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিষাদগ্রস্থ/বিষন্ন মন দীর্ঘকালীন স্মৃতিধারনেও বাঁধা প্রদান করে। Brain Imaging প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা দেখতে পারি শারীরিক ভাবে বিষন্নতা এবং মস্তিষ্কের সম্পর্কটা আসলে কোথায় দৃশ্যমান। বিভিন্ন গবেষনায় দেখা যায় যে বিষন্ন মানুষের কপালের ঠিক পিছনে মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবগুলো কম কাজ করে।
৪। ঔষধের সেবন/প্রয়োগঃ
[caption id="attachment_413" align="aligncenter" width="378"]

ঔষধ শরীরের প্রতিটি অংশেই প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে কিছু ঔষধ মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে প্রভাব ফেলে, যার কারনে মস্তিষ্কের কোষগুলোর নিজেদের মধ্যকার যোগাযোগ ব্যহত হয়। আবার দুই-তিন ধরনের ঔষধের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায়ও স্মৃতিশক্তি দুর্বল হতে পারে। দুনিয়াজুড়ে রোগশোক যেভাবে বাড়ছে সেভাবে বাড়ছে ঔষধ গ্রহণ। এক পরিসংখানে দেখা যায় প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের জন্য গড়ে ১২.৬ টি ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপশন লাগে, আর ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপশন মানেই এক গাদা ঔষধ। ভাতের বদলে ঔষধ খেলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তো থাকবেই।
৫। পরিপাকে সমস্যাঃ হাইপোথায়রোডিজম (hypothyroidism) একটি বিশেষ অবস্থা যখন শরীরের থাইরয়েড গ্রন্থিগুলো থেকে এনজাইম স্বাভাবিকভাবে নিঃসরিত হয় না। এর ফলে খাদ্য পরিপাকে সমস্যা হয়, আর পরিপাক প্রক্রিয়ায় সমস্যা দেখা দিলে শরীরের অন্যান্য প্রক্রিয়ার পাশাপাশি মস্তিষ্কেও এর প্রভাব পড়ে। স্মৃতিশক্তির দূর্বলতা আজকাল থাইরয়েডজনিত সমস্যাগুলোর একটি সাধারন লক্ষন হয়ে দাড়িয়েছে। এমনকি বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করে যাচ্ছে মস্তিষ্কের ভয়াবহ রোগ আলজেইমার্স এর সাথে
[caption id="attachment_414" align="alignright" width="192"]

হাইপোথাইরয়েডের সম্পর্ক আছে কিনা।
৬। গর্ভাবস্থা এবং ঋতুজরাঃ একজন নারীর প্রজনন সংক্রান্ত বিভিন্ন সময়ে শরীরে এস্ট্রোজেন হরমোনের পরিমাণে তারতম্য হয়, এস্ট্রোজেনের সাথে সম্পর্কিত মস্তিষ্কের অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের উপর প্রভাব পড়তে পারে। ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ বেডফোর্ডের এক গবেষণায় দেখা যায় গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রিমাসিক সময় থেকে এমনকি জন্ম দানের পরের তিন মাস পর্যন্ত স্মৃতিশক্তির এ নাজুক অবস্থা পরিলক্ষিত হতে পারে, তবে সব নারীই যে এই সমস্যার সম্মুখীন হবে এমনটি নয়।
৭। অতিরিক্ত এলকোহল পানঃ অতিরিক্ত মদ পান শুধু যকৃৎ আর কিডনীই নষ্ট করে না, পাশাপাশি স্মৃতিভ্রংশের কারন। অতিরিক্ত এলকোহল পানে মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবএ প্রচুন্ড সংকোচন দেখা যায় যা স্মৃতিসংরক্ষণে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। অতিরিক্ত মদ পান কর্সাকফ সিন্ড্রমের (korsakoff syndrome) জন্ম দেয় যা এলকোহল গ্রহণের কারনে স্মৃতিভ্রংশ রোগ। তাই মদে আসক্ত যারা, এবার সময় হয়েছে পানি-শরবত-দুধ জাতীয় পানীয়তে অভ্যাস করার।
[caption id="attachment_415" align="aligncenter" width="345"]

৮। মাথায় ও মস্তিষ্কে আঘাতঃ মাথায় ও মস্তিষ্কে আঘাতের কারনে স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে। প্রচুন্ড ধাক্কা, শোক ইত্যাদিও এ ক্ষেত্রে ভুমিকা রাখতে পারে। যদিও মস্তিষ্ক একটি মোটা অস্থি দ্বারা আবৃত থাকে তবুও মস্তিষ্কে আঘাত খুবই সহজে হতে পারে, মাঝে মাঝে বাজেভাবে পড়লে অথবা ঝাকুনিতে মাথার খুলির সাথে মস্তিষ্কের কোষগুলোর সংঘর্ষের ফলে এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। উপরন্ত মস্তিষ্কে রক্তপাতসহ আরো অনেক বড় ঝামেলাও হতে পারে। তাই সাবধান!!!
৯। বয়স বাড়লেঃ
[caption id="attachment_416" align="aligncenter" width="275"]

স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা সব সময়ে অস্বাভাবিকভাবেই হয় তা নয়, বরং বয়স বাড়ার সাথে সাথেও হতে পারে যা একটি স্বাভাবিক বিষয়। সাধারনত বয়স ৪০ থেকে ৫০ বছর হলে মানুষ ধীরে ধীরে বিভিন্ন স্মৃতি কম মনে রাখতে পারে।
১০। ডায়াবেটিসঃ অন্যান্য অনেক পুষ্টি গুনের মত গ্লুকোজও আমাদের মস্তিষ্কের খাদ্য। রক্তে গ্লুকোজ এর পরিমাণ বাড়লে বা কমলে তার একটি প্রভাব পড়ে আমাদের মস্তিষ্কে। রক্ত ও মস্তিষ্কের মধ্যে একটি প্রতিবন্ধক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কে কতটুকু গ্লুকোজ পৌছাবে রক্ত থেকে। রক্ত থেকে প্রয়োজনের তুলনায় কম বা বেশি গ্লুকোজ পৌছালে তা মস্তিষ্ককে দুর্বল করে দেয়, আর ডায়াবেটিসের সময় এ ধরণের গ্লুকোজের তারতম্য দেখা যায় বলে ডায়াবেটিসও স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার অন্যতম কারন।
১১। গাজা সেবনঃ
[caption id="attachment_417" align="aligncenter" width="288"]

চিকিৎসা শাস্ত্রে মারিজুয়ানা বা গাজার ব্যবহার নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও নিয়মিত গাজা সেবন করলে মস্তিষ্ক ত্রা প্রয়োজনীয় সংকেত প্রদানে বাঁধা পায় যা থেকে স্মৃতিধারণে অক্ষমতা দেখা যায়। মস্তিষ্ক তার নিউরন থেকে এস্ট্রোসাইটিস (astrocytes) নামক কোষে সংকেত পাঠায় যা গাজা সেবনে ব্যহত হয়। এ ছাড়া মারিজুয়ানার টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল (Tetrahydrocannabinol – THC) নামক উপাদান যা নেশার উদ্রেক করে তা মস্তিষ্কের নিউরনের আন্তঃযোগাযোগ দুর্বল করে দেয়। এসব কারনে প্রায়শই গাজা সেবনকারীরা Short Term Memory loss এ ভুগতে পারে।
১২। আমি কিছু একটা মনে করতে পারছি নাঃ হ্যা, এই ধরনের দ্বিধায় ভুগলে বা নিজেই নিজেকে বুঝালে যে আপনি কিছু একটা মনে করতে পারবেন না তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়।
১৩। মস্তিষ্কের ব্যবহার কম হলেঃ মস্তিষ্কের ব্যবহার কম হলে, চিন্তাশক্তি এবং স্মৃতিশক্তি উভয়েরই কম ব্যবহার করলে মস্তিষ্ক দুর্বল হয়ে পড়ে যার কারনে আমরা ছোটখাটো অনেক বিষয়ই ভুলে যাই। আজকালকার প্রজন্মের যারা সারাদিন বাসায় টিভি দেখে বা ঘুমিয়ে-আড্ডা মেরে দিন পার করে দেন বলে মস্তিষ্ক ব্যবহারের সুযোগ পান না, তারা অনেকেই হয়ত ধরতে পেরেছেন বিষয়টা।
১৪। পানি ও পুষ্টি স্বল্পতাঃ প্রতিদিন একজন পুরুষের গড়ে ৩ লিটার এবং নারীর ২.২ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। পানির অভাব এবং পুষ্টির অভাব স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার জন্য অনেক সময়ই দায়ী। চেষ্টা করুন কম চর্বিযুক্ত প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে। তবে খাবারের সাথে পানি খাবেন না, পানি পান করবেন।
এবার এসব কারন এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে দেখুন তো নিত্য প্রয়োজনীয় মনে রাখার মত জিনিসগুলো মনে রাখতে পারছেন কিনা। তবে কিছু দুঃসহ স্মৃতি মনে না রেখে ভুলে যাওয়াই ভালো।
এইসব নাই, তারপরও তো কিছুই মনে থাকে না, ক্যামনে কি ?
ReplyDeletesame here :D
ReplyDeletei guess bhejal khaite khaite amader ei dosha!
আমারও একই সমস্যা।
Deleteআমারও একই সমস্যা।
Delete