হরতালে এক সময় খুব আনন্দ হতো। সে আনন্দের শুরু ৯৫ পরবর্তী সময়ে। তখন আওয়ামী লীগের আমল। আমারও স্কুল জীবনের শুরুর দিককার সময়। লাগাতার হরতাল মানেই ছুটি। তিনদিনের হরতাল সর্বদা শুক্র-শনিবারের সাথে জুড়ে দেয়া হতো। ৫ দিনের ছুটি কাটাতে এত ভালো লাগতো যে বলার নয়। সকাল-বিকেল চলতো পাড়ার ক্রিকেট। মাঝে মধ্যে টেস্টও খেলা হতো। সকালে এক ইনিংস, দুপুরে লাঞ্চ ব্রেক আর বিকেলে দ্বিতীয় ইনিংস। রাতে চলতো ব্যাডমিন্টন। জীবনে তো মজ্জায় মজ্জা। তখন যে হারে রাস্তায় ক্রিকেট খেলেছি ঐ হারে খেলা চালিয়ে যেতে পারলে সাকিব-তামিমের জায়গায় বোধহয় জাতীয় দলে আমিই খেলতাম। যাই হোক, দুঃখের কথা আর না বাড়াই। কেন জানি তখন ধারণা ছিল হরতাল বোধহয় সরকারি দল দেয়। অনেক পরে আবিষ্কার করেছি হরতালের উদ্যোক্তা বিরোধী দল :p । এরপরে হরতাল উপভোগ করেছি বিএনপির আমলে অর্থাৎ ২০০১ পরবর্তী সময়ে। ক্রিকেট চর্চা থেমে থাকে নি। তখন পরিস্থিতি এখনকার মতো ছিল না। হরতাল মানে রাস্তা ফাঁকা, ইট দিয়ে স্ট্যাম্প বানিয়ে অ্যারোপ্লেন বা ডানলপ টেনিস বলে ওসাকার লাল টেপ মেরে শুরু হয়ে যেত খেলা। আর এখন তো হরতাল মানে আইপ্যাডটা বের করে টেম্পল রান জাতীয় হাবিজাবি খেলা। এখনো মনে পড়ে রাস্তার ড্রেইনে বল পড়ার স্মৃতি। বল যে ফেলতো তাকেই তুলতে হতো। পানি পাওয়া গেলে ভালো নয়তো মাটিতে ড্রপ দিয়েই কাজ সারা হতো। ড্রপ দিতে গিয়ে ড্রেইনের পানির নোনতা স্বাদও যে পায়নি তা কিন্তু অস্বীকার না। সব মিলিয়ে যা বলতে চাই তা হলো হরতাল মানে নিখাঁদ বিনোদন ছিল।
তখনও বুঝতাম না এই হরতাল কতটা সর্বনাশা জিনিস। আমরা যখন মজা করে খেলতাম, আমার মা-বাবাকে জান হাতে করে অফিসে যেতে হতো। বাস না পেয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে রিকশা নিতে হতো। প্রতি মূহুর্তে চিন্তা করতে হতো এই না এসে গায়ে বোমা পড়ে। এই না ভাঙচুর শুরু হয়। হরতালে জাতীয় অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতি, পরিবহন ব্যবসায়ের লোকসান, মানুষের দুর্ভোগের সীমাহীন চিত্র তখন অনুধাবন করতে পারি নি কচি হৃদয় দিয়ে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দিনমজুর, রিকশাওয়ালারা কাজের অভাবে হরতালে খেয়ে না খেয়ে যে দিন পার করে তা আমার শৈশবের কালিমাহীন মন অনুধাবন করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। হরতালের সংস্কৃতি চলমান। কোনো আমলেই তা বন্ধ হয় নি। যখনই যে বিরোধী দলে গিয়েছে তখনই সে হরতাল নামক এই মরণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। ক্ষমতার লড়াইয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক অস্ত্র উদ্ভাবন কিংবা ব্যবহারের মতো মেন্টাল ক্যাপাসিটি বা ফ্যাকাল্টি আমাদের রাজনীতিবিদদের ছিলও না, হবেও না। হরতাল-অবরোধ-সংঘাত ব্যতীত কোনো কর্মসূচী গ্রহণের হিম্মত বা ইচ্ছা কোনোটাই তাদের নেই। আর সরকারি দলও ভুলে যায় যে তারা এক সময় বিরোধী দলে ছিল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আজীবন ক্ষমতায় থাকার লোভ সামলাতে দলগুলো চিরকাল ব্যর্থ হয়েছে।
আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্র যে নির্বাচিত রাজতন্ত্র তা কিন্তু টার্মিনোলজি থেকেই বোঝা যায়। যেমন- নির্বাচনে জয় লাভ করে কোনো দল সরকারি দায়িত্ব নিলে আমরা বলি ‘ক্ষমতায় আসলো অমুক দল’। আমরা বলি না, ‘দায়িত্ব গ্রহণ করলো তমুক দল’। আমরা প্রায়শ’ বলে থাকি আওয়ামী লীগের আমল বা বিএনপির আমল। যেন এটা সেই সম্রাট আকবরের রাজত্ব বা চেঙ্গিস খানের সময় যখন সামরিক দখলের মাধ্যমে রাজারা ক্ষমতা গ্রহণ করতো এবং রাষ্ট্রের মালিক বনে যেত। ব্রিটেনের উপনিবেশ হিসেবে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান সকলেই ছিল। কিন্তু উপনিবেশবাদী চিন্তাধারায় আমরাই সবচেয়ে এগিয়ে। পাকিস্তান হয়েছে শতভাগ সামরিক রাষ্ট্র। তাদের সব কিছু ঐ পারমাণবিক বোমার মাঝে সীমাবদ্ধ। আর আমাদের সব কিছু ঐ কুট-কৌশলের রাজনীতির মাঝেই আটকে রয়েছে। অন্য দিকে চিকন বুদ্ধি সম্পন্ন ভারত গোটা বিশ্বে তাদের অবস্থান গড়ে তুলছে তিলে তিলে। আর দাদাগিরির কথা তো বাদই দিলাম।
ট্রু গণতন্ত্রে আমাদের পৌঁছতে আরো অনেক দেরি। আর হরতাল-সংঘাতের রাজনীতি ক্রমাগত আমাদেরকে পিছিয়ে দিচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে এগোতে না পারলেও আমরা যদি সাম্যাবস্থায় থাকতাম তাও হতো। কিন্তু প্রতিদিন যদি আমরা এভাবে পিছিয়ে পড়ি তবে বাংলাদেশ মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড হবে না কখনই। হরতালকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে বন্ধ করা সম্ভব রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছার মধ্য দিয়েই। হরতালে যে প্রাণহানি ঘটে তার দায়ভার কি কোনো দল কখনো গ্রহণ করেছে? হরতালে মানুষ হত্যার জন্য কেউ কি আজ পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলেছে? দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থনীতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়ে হরতাল দিনের পর দিন টিকে থাকতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন ছাত্রদের দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন হরতালকে নিষিদ্ধ করা। তবে এখানে কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা রয়েছে। যখন সরকার জনগণের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে তখন সতঃস্ফূর্ত হয়ে জনতা হরতাল পালন করে। সেই চিন্তা থেকেই কিন্তু হরতালের কনসেপ্ট গড়ে উঠেছে। কিন্তু রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে হরতালকে নিষিদ্ধ করতে কি ব্যবস্থা নেয়া যায় তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং আইনজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন। জাতিকে স্থবির করে দেয় যে হরতাল তা কখনোই শুভ কোনো বার্তা বয়ে আনতে পারে না।
ছবি কৃতজ্ঞতা: প্রথম আলো এবং শীর্ষ নিউজ
No comments:
Post a Comment