ভেবেছিলাম, সিলেটে SUST Project Fair 2013 থেকে ফিরে আপনাদের সাথে শেয়ার করব আমাদের এই দুদিনব্যাপী সফরের কিছু ইন্টারেস্টিং অভিজ্ঞতা কিন্তু আজকে এখানে এই লেখাটি যখন পোস্ট করছি তখন সাস্টের এবং স্যারের সরাসরি ছাত্র হিসেবে আমরা একই সাথে ক্ষুব্ধ-ব্যথিত-বিস্মিত-বিপর্যস্ত বোধ করছি।
একজন ব্যক্তি কোন প্রতিষ্ঠান থেকে বড় হতে পারে কি না - এই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় আমাদের এবং আমাদের পরের প্রজন্মের একটা বড় অংশের কাছে জাফর স্যার যেকোন প্রতিষ্ঠানের চাইতে বড় একজন ব্যক্তিত্ব। স্যারের ব্যক্তিগত, ধর্ম-সংক্রান্ত বা রাজনৈতিক যেকোন বিশ্বাসে ভিন্নমত থাকতেই পারে কিন্তু তাঁর একজন সরাসরি-ছাত্র হিসেবে বলতে পারি ভার্সিটিতে জাফর স্যার কখনওই অসদুদ্দেশ্যে কোন পদক্ষেপ নেননি। ট্র্যাডিশনালি আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা অত্যন্ত সম্মানিত একটি পেশা হলেও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নতজানু এবং সুবিধাবাদি ভূমিকার কারণে আস্তে আস্তে তারা তাদের দেবতুল্য আসন হারিয়েছেন। আমাদের এখানে শিক্ষকেরা নীল-সাদা-গোলাপি এবং বর্ণচোরা হন, তারা ভাড়া খাটেন, ফরমায়েশি ইশতেহার লিখে দেন এবং অনুগ্রহধন্য হবার আশায় ছাত্রনেতা নামধারী কিছু পান্ডার পিঠ চুলকে দেন। আর যারা এগুলো করতে পারেন না তারা টিমটিম করে জ্বলতে জ্বলতে একসময় দুপ করে নিভে যান। (কথাগুলো প্রত্যক্ষ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লিখলাম, কেউ দ্বিমত পোষণ করতে চাইলে আমি দৃষ্টান্ত সহ বাহাসে বসতে রাজি আছি।)
এই ব্যাকড্রপে মফস্বলের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে লেখালেখি থেকে শুরু করে নানা কাজের ভেতর দিয়ে MZI (Muhammad Zafar Iqbal এর সংক্ষেপিত রূপ MZI -আমাদের সেমিস্টারের রুটিনে এভাবেই তাঁর নাম লেখা হত) আমাদের মনে বিশ্ববিদ্যালয়-গবেষণা-সমাজ ভাবনা এগুলো নিয়ে পুরোপুরি নতুন একটা ধারণা গড়ে তোলেন। সমাজে ভাল মানুষের অভাব কখনওই থাকে না, অভাব থাকে ভাল একজন দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্বের। এই কথাটা শিক্ষক সমাজের ক্ষেত্রেও ভীষণভাবে প্রযোজ্য। আক্ষরিক অর্থেই একদল উৎসুক এবং ভালো মানুষ শিক্ষকদের নেতা হিসেবে জাফর স্যার এক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন। এই শতকের শুরু থেকেই একদল সমমনা শিক্ষক ও সচেতন সমাজকর্মীদের সাথে নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্যার দেশের নানা প্রান্তে ছুটে গেছেন, অংশ নিয়েছেন তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করার মত বিভিন্ন আন্দোলনে, জন্ম দিয়েছেন অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের ও উদ্যোগের।
[caption id="attachment_1048" align="aligncenter" width="788"] iFeri.com SUST Project Fair 2013[/caption]
স্যারের এই সব কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষ সুফলভোগী ছিলাম আমরা যারা সাস্টের ছাত্র। ভার্সিটি থেকে বের হবার পর এমন কোন চাকরির ইন্টারভিউ দেইনি যেখানে জাফর স্যার সম্বন্ধে কিছু 'থোক' প্রশ্ন বরাদ্দ থাকতো না। আমার মনে হয়, সে সময়ের কিছু প্রশ্নের উত্তর আপনাদের সাথে শেয়ার করলে আপনারা বুঝতে পারবেন শিক্ষক হিসেবে জাফর স্যার কেমন। জাফর স্যার কোনদিন, কোন একদিন, আমাদের কোন কোর্সের নির্ধারিত ক্লাসে এক মিনিট দেরিতে আসেন নি, হরতাল বা অন্য যেকোন কারণে যে ক্লাসগুলো মিস হত সেই সব ক্লাসগুলো সবসময়ই তিনি মেকাপ করতেন, পরীক্ষায় কখনও কাউকে অন্যায়ভাবে কম বা বেশি দেননি, তাঁর ছাত্রদের মেধার সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করেছেন এমনকি সেটা তাঁর মতের সাথে পরিষ্কার অমিল থাকলেও। স্যারের ঢাকা এবং ক্যাম্পাস, দুই বাসাতেই যাওয়ার সুবাদে জানি কতটা সাদামাটা জীবনে তিনি অভ্যস্ত - এই কথাটা বললাম তাদের উদ্দেশ্যে যারা একসময় অর্থ আত্মসাতের মত অপবাদও স্যারের নামে দিতে দ্বিধা করেনি।
গতকাল স্যার শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদ ত্যাগ করেছেন। কারণটা অনুমানের বা কানাঘুষোর কোন ফাঁক তিনি রাখেননি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুচ্ছ-পরীক্ষা পদ্ধতি চালুর যে আন্দোলনে তিনি প্রথম জোরাল পদক্ষেপটি রাখতে পেরেছিলেন যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সাস্টের পরীক্ষা আয়োজন করে সেখান থেকে কর্তৃপক্ষের সরে আসার সিদ্ধান্তই স্যারকে এবং ম্যাডামকে বাধ্য করেছে তাদের সাধের এবং সাধনার প্রতিষ্ঠান থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে। গুচ্ছপরীক্ষা হলে কি হয় ? গুচ্ছপরীক্ষা হলে যশোরের বা রংপুরের বা খাগড়াছড়ির বা সিলেটের বা সিলেটের বা সিলেটের বা সিলেটের (বারবার বলছি তাদের জন্য যারা মনে করেন যশোরে মানুষ থাকেন না, যারা একটি সীমান্ত শহর হিসেবে যশোরের গুরুত্ব জানেন না, যারা অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে যশোরের অবস্থান জানেন না, যারা মধুসূদনকে চেনেন না এবং যারা মনে করেন সিলেটের একজন ছাত্রের পক্ষে ইহজীবনে যশোর যাবার কোন সম্ভাবনা নেই তাদের জ্ঞাতার্থে) একজন ছাত্র যেকোন এক জায়গায় (যশোর বা সিলেট) বসে তার পছন্দমত ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিতে পারতেন। এর বাইরে এই পদ্ধতির আর কোন অভিনবত্ব বা দুরভিসন্ধি নেই ! কিন্তু যথারীতি এই পদ্ধতি নিয়েও নোংরা আঞ্চলিক রাজনীতির ঘুঁটি চালা হল এবং একটা অন্যায় যুদ্ধে কারো জয় ছাড়াই অসৎ একদল মানুষের প্ররোচনায় সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ পরাজয় বরণ করল।
স্যারের যেকোন সিদ্ধান্তের বুঝে-না-বুঝে বিরোধিতা কোন নতুন বিষয় নয়, কিন্তু কাছের মানুষ যখন ময়দান থেকে সরে আসে এবং যুদ্ধশিবির বদলায় তখন কোন আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষই আর সেনাপতির পদ আঁকড়ে ধরে থাকতে পারেন না। এই প্রস্থানের রক্তক্ষরণ স্যার বা তাঁর শুভানুধ্যায়িদের যতটা আহত করবে এর 'আফটারম্যাথ' তার চেয়ে অনেক বেশি আহত করবে এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং এই জনপদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের বাসিন্দাদের।
এই লেখার উদ্দেশ্য মোটেও জাফর ইকবাল বাঙালি জাতির জন্য কেন অপরিহার্য বা তিনি একজন মহাপুরুষ এটা প্রমাণ করা নয়। স্যারের অনেক মত বা আদর্শের সাথে হয়ত আমরা একমত নই কিন্তু তাই বলে নিরপেক্ষ থাকার ভান ধরে এই অন্যায় শক্তির বিজয়োল্লাস এবং অনাচারের প্রতিষ্ঠা দেখা স্যারের একজন প্রত্যক্ষ ছাত্র হিসেবে আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা যারা আম জনতা তারা কিন্তু খুব ভালভাবেই জানি বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলো শুধুমাত্র তখনই একমত হতে পারে যখন সেখানে নাগরিক হিসেবে আমাদের সুস্পষ্ট স্বার্থলঙ্ঘন হয় ও তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়। আমরা আশা করি স্যারের এই পদক্ষেপে সিলেট এবং সাধারণ (অসচেতন) দেশবাসীর বোধোদয় হবে এবং তারা সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে এই বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হবে যে শুধু ভোটের রাজনীতিই এই দেশের শেষ কথা না, আমরা এখন নিজেদের স্বার্থ বুঝি ও সেটা আদায় করে নিতে জানি।
No comments:
Post a Comment