Saturday, December 14, 2013

শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবসের শিক্ষা

এফবিসিসিআই এর কোনো এক সভাপতি একবার বলেছিলেন, “শিক্ষা নয়, ব্যবসায়কে জাতির মেরুদণ্ড ঘোষণা করতে হবে”। ভদ্রলোককে আমি দোষ দেই না। যে যার জ্ঞানবুদ্ধি মতো মন্তব্য করবে সেটাই স্বাভাবিক। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশে ব্যবসায়-বাণিজ্যে উন্নতি কিন্তু কম হয় নি। বহু শিল্প কল-কারখানা গড়ে উঠেছে, বিদেশে রপ্তানি বেড়েছে, জন্ম হয়েছে অনেক সফল ব্যবসায়ীর। কিন্তু তারপরও দেশ হিসেবে আমরা কিন্তু খুব একটা এগিয়ে নেই। কারণ কী? কারণ, শিক্ষা। কেন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে শিক্ষার অগ্রগতি হয় নি এ প্রশ্নের উত্তর একটাই। মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবি হত্যা। ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা রাও ফরমান আলির লিস্ট ধরে ধরে দেশের বুদ্ধিজীবিদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছে বদর বাহিনী ও আল শামসের লোকজন। যারা শিক্ষার আলো ছড়াবেন তাদেরকে সরিয়ে দিলে ঐ রাজনীতি আর ব্যবসায় দিয়ে দেশের উন্নতি করা যায় না।

১৪ ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস বলা হলেও পুরো ৭১ সাল জুড়েই কিন্তু চলেছে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিকভাবে বুদ্ধিজীবি নিধন। বিশেষ করে যুদ্ধের শেষ সময়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বুদ্ধি মোটা হলেও তারা কিন্তু সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসেই বুঝে গিয়েছিল যুদ্ধে জেতা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। “জিততে যেহেতু পারব না সুতরাং স্বাধীন দেশ যেন সহজে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য তার শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে শেষ করে দেই”- এরকম মনোভাব থেকে শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিক থেকে শুরু করে পুরো পাকিস্তান আমল জুড়ে গড়ে ওঠা দেশের সেরা সেরা শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, সাহিত্যিকদের হত্যাযজ্ঞ। পূর্ব পাকিস্তানের সূর্য সন্তানদের নাম পাক বাহিনীর জানার কথা না। তাই বুদ্ধিজীবিদের তালিকা করতে তাদের সহায়তা করে রাজাকার, আল বদর, আল শামস নামক কোলাবোরেটররা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোয়ার্টার্সে গিয়ে গিয়ে পাক বাহিনীর বুটের তলা চোষা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের ডেকে নিয়ে যায় বাসা থেকে। কিন্তু তাদের লাশও ঘরে ফেরে না। লাশ  পাওয়া যায় রায়ের বাজারের খালের পাশে।

eKaisar_1260800321_1-chuknagar

সেজন্য ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস। আজকের বাংলাদেশের নষ্ট রাজনীতি, ভ্রষ্ট সমাজনীতি আর কলঙ্কিত সব মানুষের জন্ম কিন্তু ঐ ১৪ ডিসেম্বরের ফসল। যাদের দেখে পরের প্রজন্ম সৎ, কর্মঠ, নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক হতে শিখবে তাদেরকে যদি সরিয়ে দেয়া যায় তাহলে শুরু হয়ে যায় প্রজন্ম পার্থক্য। মেধা-মননের ধারাবাহিকতা ভুলুণ্ঠিত হয়। আজকের সমাজের রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, আইনজীবী, পুলিশ তথা পাবলিক যে অভব্য হয়ে ওঠেছে তার পেছনে দায়ী ‘৭১ সালের ঐ ১৪ ডিসেম্বর। এরা শিখবে কোত্থেকে? ভালোদের শেষ করে দিলে ভালো হওয়া শেখাবে কে?

৬০ এর দশকে বাংলার মাটিতে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের বীজ বপন শুরু হচ্ছিল। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু আজ? আজ পেট্রোল বোমা দিয়ে মানুষ মারা হয়, ব্যবসায়কে জাতির মেরুদণ্ড আখ্যা দেয়ার আহ্বান জানানো হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে জ্ঞানচর্চার পরিবর্তে হয় ক্যানভাসিং। বিবেক হলো মস্তিষ্ক আর শিক্ষা হলো মেরুদণ্ড। মস্তিষ্ক না থাকলে পা’কে মেরুদণ্ড মনে হতেই পারে।

আজ ১৪ ডিসেম্বর। স্বাধীনতার ৪২ তম শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস। এদিনে নাম ধরে কোনো বুদ্ধিজীবিকে স্মরণ করে বাদ পড়া বুদ্ধিজীবিদের আত্মায় কষ্ট দিতে চাই না। খালি এটুকুই বলতে চাই, “আমরা তোমাদের ভুলব না?” বুদ্ধিজীবিদের ভোলা সম্ভব নয়। যাদের অনুপস্থিতি মেরুদণ্ডের কশেরুকা অনুপস্থিতির সমতুল্য তাদের কি ভোলা যায়?

rayerbazarmemorial14

দু’দিন বাদে বিজয় দিবস। শুধু জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে কুচকাওয়াজ, প্যারাট্রুপিং করে আর ঘরে বসে ব্লগ লিখে নয়, সকল কর্মের মাধ্যমে দেশকে ভালোবাসার পরিচয় দিই। তাহলে আর থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার মতো আমাদের হতে হবে না, বরং তারাই বাংলাদেশের মতো হতে চাইবে।

জয় বাংলা।

 

ছবি কৃতজ্ঞতা: অ্যামাজননিউজ.কম ও স্কাইস্ক্র্যাপারসিটি.কম

No comments:

Post a Comment