Tuesday, December 10, 2013

আপেক্ষিকতা তত্ত্ব : একটি বৈজ্ঞানিক মহাকাব্য

সময়কাল ১৯০৫।
সুইজারল্যান্ডের পেটেন্ট অফিসের এক অখ্যাত তরুণ কেরানী অনেকদিনের রাতজাগা শ্রম, নিজের ছাপোষা চাকরির সমূহ ঝুঁকি এবং দাম্পত্য জীবনের ক্ষতি করে তিনটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখে ফেলেন। তিনটিই পদার্থবিদ্যার আলাদা আলাদা বিষয়ের উপর লেখা গবেষণা প্রবন্ধ।

একজন কেরানী মানুষ রাতজেগে আবোল তাবোল কীসব প্রবন্ধ লিখেছে, তা নিয়ে কারও মাথা ঘামানোর কথা না। কিন্তু তবু তত্‍কালীন পৃথিবীর বড় বড় মাথাওয়ালা বিজ্ঞানীরা প্রবন্ধ তিনটি নিয়ে মাথা ঘামালেন। কারণ, এগুলো প্রকাশিত হয়েছিল বিখ্যাত জর্নাল 'এনালেন ডার ফিজিক' এর ১৭ খণ্ডের চতুর্থ সংখ্যায়।

জ্ঞানী পাঠকগণ নিশ্চয় এতক্ষণে বুঝে ফেলেছেন, আমাদের কেরানী সাহেবটা কে। যাঁরা ধরতে পারেন নি, মূলত তাঁদের জন্য আমার এই লেখাটা (জ্ঞানী পাঠকদের জন্য লেখার দুঃসাহস এই লেখকের নেই!)| যাই হোক, কেরানী মহোদয়ের নাম আলবার্ট আইনস্টাইন। যিনি বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ বিজ্ঞানীর মতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ।

বিংশ শতাব্দির শুরুতে তিনি যে তিনটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন, তার মর্ম তত্‍কালীন মাথাওয়ালারা বুঝতে না পারলেও পরবর্তীতে এদের প্রত্যেকটি প্রবন্ধ থেকে পদার্থবিদ্যার একেকটি নতুন শাখার জন্ম হয়েছে। এদের মধ্যে একটি হল আপেক্ষিকতা তত্ত্ব।

আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নামক একটি জটিল অথচ বিশ্বকে খুব সরল এবং নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করার মত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের একক স্রষ্টা হচ্ছেন আইনস্টাইন। এটাকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বললাম ঠিকই, কিন্তু এই তত্ত্বের যৌক্তিক গঠন, দার্শনিক ভিত্তি, গাণিতিক-জ্যামিতিক কাঠামো এবং নির্ভুল সুন্দর ক্ষেত্র সমীকরণগুলি (Field equation) এতটাই মনোমুগ্ধকর, বিষ্ময়কর আর সত্য যে একে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব না বলে বৈজ্ঞানিক মহাকাব্য বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। আপেক্ষিক তত্ত্ব সম্পর্কে তত্‍কালীন পৃথিবীর একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ম্যাক্স বর্ন মন্তব্য করেছিলেন, "আমার সবসময়েই মনে হয়েছে আইনস্টাইনের এই তত্ত্ব প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের সর্বোত্তম ফসল। দার্শনিক তীক্ষ্ণতা, ভৌত স্বজ্ঞা এবং গাণিতিক দক্ষতার এ এক দুর্লভ সম্মিলন। এটা আমার কাছে সুনিপুণ চিত্রশিল্পীর এক মহান কাজ বলেই মনে হয়েছে, যা শুধু দূর থেকেই উপভোগ করা যায় এবং তার অকুণ্ঠ প্রশংসা করা যায়।"

প্রশ্ন হচ্ছে, আইনস্টাইন কি করে এই মহাকাব্যিক সৃষ্টি একাই সম্পন্ন করলেন? কি করে তিনি একাই পদার্থবিজ্ঞানকে এগিয়ে দিলেন কয়েক যুগ? আমরা এর উত্তর খুঁজবো আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মধ্যেই। এটি কী, কেন সৃষ্টি হল, কীভাবে সৃষ্টি হল এসবের মধ্যে।

আবার ফেরত যাই সেই ১৯০৫ এ। আইনস্টাইনের ওই তিনটি প্রবন্ধের একটির শিরোনাম ছিল আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব (Special Theory of Relativity) । প্রবন্ধটি প্রকাশের সাথে সাথে বিজ্ঞানী মহলে আলোড়নের সৃষ্টি হয় এবং অনেকেই এটার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়। এর অবশ্য যথেষ্ট কারণও ছিল।

আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বে আইনস্টাইন গতানুগতিক ধারণার বাইরে এসে দেখান যে, পরম সময় বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুর সময়ের প্রবাহ আলাদা এবং আপেক্ষিক গতির উপর নির্ভরশীল। সহজ ভাষায় দুই যমজ বোনের বয়স বেড়ে যাওয়া নির্ভর করবে তাদের আপেক্ষিক গতির উপর। এক বোন যদি আরেক বোনের সাপেক্ষে আলোর কাছাকাছি গতিতে কয়েক বছর ভ্রমণ করেন, তাহলে এমনও হতে পারে যে, তার বোন থুরথুরে বুড়ি হয়ে গেছে, আর সে তরুণীই রয়ে গেছে। কারণ, গতিশীল থাকার ফলে তার সময়ের প্রবাহ ধীর হয়ে গিয়েছিল! এটা হল আপেক্ষিক সময়। স্থানও আপেক্ষিক এবং সেটাও গতির উপর নির্ভরশীল। যে লাঠিটাকে আমরা ১০০ মিটার দেখছি, আলোর কাছাকাছি বেগে গতিশীল থাকলে সেটিকেই ২০০ মিটার দেখা সম্ভব! এখন এগুলো প্রমাণিত সত্য। কিন্তু তখন আইনস্টাইন এইসব সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন দুটি স্বীকার্য থেকে। স্বীকার্য দুটি হল- (১) জড় প্রসঙ্গ কাঠামোতে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো এক, এবং (২) মহাশূন্যে আলোর বেগ সবসময় স্থির বা ধ্রুব।

আলোর গতিবেগ যে স্থির তা অনেকে মেনে নিলেও আপেক্ষিক স্থান-কালের ধারণা তখন কেউ গ্রহন করতে পারলেন না। তাঁদের যুক্তি আইনস্টাইনের ঐ প্রবন্ধের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, আর তাছাড়া প্রবন্ধটি খুব খাপছাড়া একটি গবেষণা যেখানে জড় প্রসঙ্গ কাঠামোকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে!

আসলে তখনকার পদার্থবিজ্ঞান কিছুটা গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন হয়ে ছিল। নিউটনীয় বলবিজ্ঞানকে অবিশ্বাস করার মত কেউ ছিল না এবং নিউটনীয় বলবিজ্ঞান দ্বারাই যে বিশ্বজগত্‍ ব্যাখ্যা করা সম্ভব সবাই এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো। তাই আইনস্টাইন যখন সেই প্রবন্ধে দেখালেন যে গতিবেগ যখন আলোর কাছাকাছি চলে যায় তখন নিউটনীয় গতিবিদ্যা বিন্দুমাত্র কাজ করে না, এবং স্থান-কাল আপেক্ষিক হয়ে পড়ে তখন সবাই জিনিসটাকে খানিকটা অবজ্ঞার চোখে দেখলেন।

আইনস্টাইন নিজেও তাঁর আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলেন না। কারণ তিনি জানতেন তাঁকে এটি প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আরও কাজ করতে হবে, এর ভিত্তি তৈরি করতে হবে, এর সাধারণীকরণ করতে হবে।

শুরু হল তাঁর এক প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। একদিকে পেটেন্ট অফিসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে লাগলেন, অন্যদিকে চালিয়ে গেলেন তাঁর গবেষণা। এভাবেই কেটে গেল দশ বছর। মাঝে ছোটখাট কিছু গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু তাঁর মূল লক্ষ ছিল আপেক্ষিক তত্ত্বকে সম্পূর্ণ করা। দিনের অধিকাংশ সময় তিনি বিচরণ করতে লাগলেন বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীলতার জগতে। এসময় কাছের মানুষেরা ধরে নিয়েছিলেন হয়তো তাঁর মাথাটাই গেছে! নইলে কেউ অমন ক্ষ্যাপাটের মত অলীক ধারণার পিছনে ছোটে নাকি!

কিন্তু ছুটেছেন আইনস্টাইন। এই তত্ত্বের জন্য তিনি নতুন করে শিখেছেন টেন্সর ক্যালকুলাস ও রিমানীয় জ্যামিতি। তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে চতুর্মাত্রিক মিনকোস্কি সমতল দ্বারা মহাকর্ষ বর্ণনা করা যাচ্ছে না, তখন তিনি সেখানে রিমানীয় জ্যামিতি ব্যবহার করেন। (রিমানীয় জ্যামিতি হচ্ছে বক্রতলের জ্যামিতি যেখানে ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রি থেকে কম বা বেশিও হতে পারে!) রিমানীয় জ্যামিতি ব্যবহার করে আইনস্টাইন সফলতার দেখা পান। মহাকর্ষকে বেঁধে ফেলেন বিজ্ঞান, গণিত আর জ্যামিতির আশ্চর্য সম্মিলনে।

নিউটন মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু মহাকর্ষ বল কী এটা সম্পর্কে খুব একটা ধারণা দিতে পারেন নি। আইনস্টাইন দিলেন এর উত্তর। তিনি বললেন মহাকর্ষ হচ্ছে স্থান-কালের বক্রতার ফল। আর মহাশূন্য হল স্থান-কালের একটা নমনীয় তল। বস্তুর ভর এমন একটা জিনিস যা তার আশেপাশের সেই নমনীয় স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়। ভর যত বেশি হবে স্থান-কালের বক্রতা তত বেশি। অন্য কোন বস্তু যখন সেই বক্র স্থান-কালে চলে আসে তখন আর সরলরৈখিকভাবে চলতে পারে না। বক্র তলের বক্র রেখা (জিওডেসিক) বরাবর চলে। যাকে আমরা বাহির থেকে দেখি মহাকর্ষ বল তা মূলত এই জিওডেসিকের বক্রতার ফল।

আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে রিমানীয় জ্যামিতি ব্যবহারের ফলে সেখানে আর জড় প্রসঙ্গ কাঠামোর প্রয়োজন পড়ে না এবং বস্তুর যখন ত্বরণ হয় তখনও এই তত্ত্ব প্রযোজ্য হয়ে পড়ে। আর এভাবেই সীমাবদ্ধতামুক্ত হয়ে পদার্থবিদ্যার জগতে দৃঢ় এবং বৃহত্‍ পদক্ষেপ ফেলে আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব।

আইনস্টাইন তাঁর এই তত্ত্ব নিয়ে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে তিনি বলেন, "একবার অধ্যয়ন করলে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব সম্পর্কে আপনি সুনিশ্চিত হবেনই।"

আসলেই মানব জাতি বহুবার তাঁর এই তত্ত্ব সম্পর্কে সুনিশ্চিত হয়েছে বহু পর্যবেক্ষণে। কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। তাই আমরা কল্পনা করতেই পারি, হয়তো আপেক্ষিকতা তত্ত্বেও একদিন ত্রুটি ধরা পড়বে এবং নতুন কোন আইনস্টাইন আমাদের চারপাশের জগত সম্পর্কে এর থেকেও বিষ্ময়কর, চমকপ্রদ কোন তত্ত্ব দিয়ে মানুষের জ্ঞানকে নিয়ে যাবে আরেক উচ্চতায়।

তথ্যসূত্রঃ

১. প্রাণের মাঝে গণিত বাজে - সৌমিত্র চক্রবর্তী
২. কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস – স্টিফেন ডব্লিউ হকিং
৩. থিওরি অফ রিলেটিভিটি - মুহম্মদ জাফর একবাল
৪. বিজ্ঞান সমগ্র - এম হারুন-অর-রশিদ
৫. http://en.wikipedia.org/wiki/Albert_Einstein
৬ কৃষ্ণ গহ্বর শিশু মহাবিশ্ব ও অন্যান্য – স্টিফেন ডব্লিউ হকিং

লেখকঃ

আবদুল্লাহ আল মাসুদ
রেজিঃ ২০১২৩৩৪০০৬
ডিপার্টমেন্টঃ আইপিই
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

 

No comments:

Post a Comment