গ্যালাক্সীর বেগ এবং মহাবিশ্বের প্রসারণের প্রকৃতি পর্যবেক্ষন থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন-মহাবিশ্ব গঠনকারী বস্তুসমূহের ৯০%-ই অদৃশ্য । অর্থাৎ মহাবিশ্বের অধিকাংশ উপাদান তরঙ্গ বিকির্ণ করে না বা উত্তাপ ছড়ায় না, যার ফলে আমরা তা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক বর্ণালীতে ডিটেক্ট করতে পারি না ।
মহাবিশ্ব গঠনের মূল কণিকারগুলোর আচরণ এবং বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যার জন্য পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যে থিওরী তাকে স্ট্যান্ডার্ড মডেলে থিওরী বলে।মূলত স্ট্যান্ডার্ড মডেলের একটি সীমাবদ্ধতা থেকেই অদৃশ্য বস্তুর ধারণার উদ্ভব । মহাজাগতিক রশ্নি নিয়ে পরীক্ষায় এটা প্রমানিত যে, ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রনের পারস্পরিক ক্রিয়ায় আমাদের এই মহাবিশ্ব গঠিত । কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড মডেল আমাদের সামনে জানা বিশ্বজগতের মোট ভরের যে চিত্র তুলে ধরে তা জ্যোতির্বিদদের দেওয়া তথ্য উপাত্তের সাথে মেলে না । স্টান্ডার্ড মডেল মহাবিশ্বের মোট ভরের মাত্র ৪ শতাংশের হিসাব দিতে পারে ।প্রশ্ন উঠতে পারে অবশিষ্ট ৯৬ ভাগ ভর কোথায় গেল? হতে পারে জ্যোতির্বিদদের হিসাব ভুল ছিল অথবা মহাবিশ্বে কোন অদৃশ্য বস্তুর উপস্থিতি রয়েছে যা স্ট্যান্ডার্ড মডেল এড়িয়ে গিয়েছে । হিসাবের ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক কম্পিউটারের উপস্থিতি প্রথম সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে দেয় । সেক্ষেত্রে দৃশ্যমান বস্তুর পাশাপাশি অদৃশ্য বস্তুর ভৌতিক ধারণাকেই মেনে নিতে হয় । বিজ্ঞানীরা এই অদৃশ্য বস্তুর নামকরন করেছেন “ডার্ক ম্যাটার” ।
পদার্থবিজ্ঞানীরা ধারনা করেন এই অদৃশ্য ৯৬ ভাগ ভরের ২৩ ভাগ পদার্থ (ডার্ক ম্যাটার) এবং অবশিষ্ট ৭৩ ভাগ শক্তি (ডার্ক এনার্জি) ।
পদার্থবিজ্ঞানিরা বিভিন্নভাবে ডার্ক ম্যাটারকে ব্যাখ্যা করেছেন । কারো কারো মতে এটা অনুজ্জল নক্ষত্র, ছোট/বড় ব্ল্যাক হোল অথবা মহাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ধূলি যেগুলো খুব অল্প পরিমানে বিকিরণ নির্গত করে বা প্রতিফলিত করে যা আমরা ডিটেক্ট করতে পারি না । এটা MACHO(Massive Compact Hallo Object) নামক পদার্থ হতে পারে যেগুলো গ্যালাক্সীর এখানে সেখানে অদৃশ্যভাবে ছড়িয়ে থাকে । তত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ত্ব স্বীকার করলেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় । বর্তমানে ডার্ক ম্যাটার নিয়ে জ্যোতির্বিদগণ কাজ করছেন উজ্জ্বল বস্তুর উপর এর প্রভাব বিবেচনা করে ।
যখন আমরা নিকটবর্তী কোন নক্ষত্রকে অনিয়মিতভাবে চলতে দেখি, আমরা অংক কষে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে নক্ষত্রটির চারপাশের কক্ষপথে একটি অন্ধকার গ্রহ উপস্থিত । একই তত্ত্ব সর্পিল গ্যালাক্সির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে বলা যায়- ডার্ক ম্যাটার আছে, কারন ডার্ক ম্যাটার না থাকলে সর্পিল ছায়াপথে নক্ষত্রের গতি ব্যাখ্যাতিত রকমের বেশী হতো । সর্পিল ছায়াপথের কেন্দ্রে আবর্তিত নক্ষত্রের কক্ষপথ এবং গ্যাস মেঘ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এগুলো খুব দ্রুত আবর্তন করছে । এইসব ব্যাখ্যাতীত রকমের উচ্চগতি গ্যালাক্সীতে দৃশ্যমান বস্তু ছাড়াও অন্য কোন কিছুর মাধ্যাকর্ষণ বলের উপস্থিতিকেই ইঙ্গিত করে । অদৃশ্য বস্তু থেকে প্রয়োগকৃত মহাকর্ষ বলই নক্ষত্রকে উচ্চগতির কক্ষপথে ধরে রাখে ।
ধারণা করা হয় মহাবিশ্বে প্রতি গ্রাম দীপ্যমান পদার্থের বিপরীতে ১০ গ্রাম ডার্ক ম্যাটার আছে । কিন্তু ডার্ক ম্যাটারের গাঠনিক উপাদান কি? বিজ্ঞানীদের মতে ডার্ক ম্যাটার WIMP (Weakly Interacting Massive Particle) দিয়ে গঠিত । এই কণার বৈশিষ্ট হলো- এটি মাধ্যাকর্ষণ বলের সাথে শক্তভাবে ক্রিয়া করে এবং অন্যান্য বলের সাথে দুর্বলভাবে ক্রিয়া করে । অন্য আরেকটি ধারনা অনুসারে ডার্ক ম্যাটার হলো এক্সিয়ন নামক এক ধরণের কণা যার ভর একটি প্রোটনের ভরের এক ট্রিলিয়ন ভাগের একভাগ মাত্র যা শক্তিশালী বল দ্বারা দুটো কোয়ার্ককে(“কোয়ার্ক”- প্রোটন এবং নিউট্রনের গাঠনিক উপাদান) আবদ্ধ করে ।
নিউক্লিওসংশ্লেষ, যেটি বিগ ব্যাং এর পরে মহাবিশ্বে বস্তুর উৎপত্তির মূল কারণ অনুসন্ধান করে, তা একটি মডেল দাড় করায় । এই মডেল অনুসারে বিগ ব্যাং এর ঠিক পরে ব্যারিয়নিক এবং নন-ব্যারিয়নিক পার্টিকেল সৃষ্টি হয় । ব্যারিয়নিক পার্টিকেলগুলো ব্ল্যাকহোল, সূর্যাকৃতির MACHO, ডার্ক গ্যালাক্সির গাঠনিক উপাদান । তত্ত্বীয় পদার্থবিদদের মতানুযায়ী ফোটিনো, নিউট্রিনো, গ্রাভিটিনো, এক্সিয়ন এবং ম্যাগনেটিক মনোপোল নন-ব্যারিয়নিক ডার্ক ম্যাটার গঠন করে । এগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা শুধুমাত্র নিউট্রিনো শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন, যার ভর যেকোনো অজানা মানের হতে পারে । যদি কেউ এসব এক্সোটিক পার্টিকেলের ভর একটি নির্দিষ্ট পাল্লা পর্যন্ত পরিমাপ করতে পারেন, তাহলে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়- এইসব এক্সোটিক পার্টিকেল মহাবিশ্বকে পরিব্যাপ্ত করতে পারে এবং ডার্ক ম্যাটার গঠন করতে পারে । কিন্তু সবকিছুই একটি বড় ‘যদি’ এর উপর নির্ভর করছে ।
ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতির প্রথম প্রমাণ মেলে ১৯৩০ সালে যখন জ্যোতির্বিদ ফ্রিটজ জুইকি লক্ষ করেন যে- গ্যালাক্সিগুলোর বেগ মহাকর্ষ সূত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় । ১৯৯০ সালে ডার্ক ম্যাটারের ধারণার প্রয়োজন হয় শুধুমাত্র গ্যালাক্সির বেগ ব্যাখ্যা করার জন্য নয়, বরং গ্যালাক্সি এবং অন্যান্য বৃহৎ কাঠামোগুলোর মহাবিশ্বে উপস্থিতির কারণ ব্যাখ্যা করার জন্য । ১৯৭০ সালে বিজ্ঞানী ভেরা রুবিন দেখান- ডার্ক ম্যাটার ছাড়া গ্যালাক্সিগুলো মহাবিশ্বে গুচ্ছ হিসেবে থাকতে পারত না । ডার্ক ম্যাটারই মূলত গুচ্ছ গ্যালাক্সিগুলোকে চারপাশে আবদ্ধ করে আটকে রেখেছে ।
কোয়াসার-এর চিত্র লেন্সিং এর মাধ্যমে গ্যালাক্সিতে ডার্ক ম্যাটারের বন্টন সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় । কোয়াসার হচ্ছে দুরবর্তী এক ধরনের বস্তু যা প্রচুর পরিমানে আলো এবং অন্যান্য বিকিরণ নির্গত করে । যেহেতু মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বাহিরের অনেক কোয়াসার আমরা টেলিস্কোপের সাহায্যে দেখতে পাই, সেহেতু তাদের আলো অবশ্যই মধ্যবর্তী গ্যালাক্সি পার হয়ে আমাদের চোখে আসে । সাধারণ আপেক্ষিকতা থেকে এটা আমাদের অজানা নয় যে গ্যালাক্সিতে বিদ্যমান নর্মাল পদার্থ এবং ডার্ক ম্যাটার দুটোই স্পেস-টাইম কার্ভকে বাঁকায় । এই বাঁক কোয়াসার চিত্রকেও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে ।অধিকাংশ ক্ষেত্রে টেলিস্কোপে আমরা একই কোয়াসারের ভিন্ন ভিন্ন চিত্র দেখি । যেহেতু গ্যালাক্সির যেকোনো অংশ ঐ অংশের স্পেস-টাইম বক্রতার ধারণা দেয়, সেহেতু কোয়াসারের চিত্রগুোলোকে উজ্জ্বলতার সাপেক্ষে বিচার করে বলে দেয়া যায়- গ্যালাক্সিতে কিভাবে নর্মাল পদার্থ এবং ডার্ক ম্যাটার ছড়ানো আছে । সতর্ক পর্যবেক্ষণ দেখায় যেকোনো ডার্ক ম্যাটারগুচ্ছ অবশ্যই ৩০০০ আলোকবর্ষ অপেক্ষা কম জায়গাজুড়ে থাকে ।
বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী ১০২৫ টি পরমাণু সম্বলিত ২ কিলোগ্রাম সাধারন ম্যাটারের মধ্য দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৫ মিলিয়ন ডার্ক পার্টিকেল অতিক্রম করতে পারে । কিন্তূ এক বছরে মাত্র একটি WIMP নিউক্লিয়াসকে আঘাত করতে পারে । আঘাতপ্রাপ্ত নিউক্লিয়াসটি রি-কয়েল করে এবং এটাকে ঘিরে থাকা ম্যাটারের মধ্যে আয়নিত ইলেকট্রনরুপে শক্তি সঞ্চয় করে যা পরবর্তীতে আয়নের সাথে একত্রিত হয়ে নিরপেক্ষ পরমানু তৈরী করে । এইভাবে সঞ্চিত শক্তি একটি X-RAY ফোটন সদৃশ । ডার্ক ম্যাটার সন্ধানী বিজ্ঞানীদের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ দুটি-সঞ্চিত শক্তি সংগ্রহ করা এবং এটি যে ডার্ক ম্যাটার থেকে এসেছে তা সুনিশ্চিতভাবে প্রমান করা ।
No comments:
Post a Comment