Tuesday, December 10, 2013

জৈবপ্রযুক্তির সম্ভাবনা: ফল দিয়ে টীকাদান

কৌতূহলী মানুষের নিরলস প্রচেষ্টার ফসল আজকের এই পৃথিবী। এক কালের গুহাবাসী মানুষেরা আজ মহাকাশযান নিয়ে বিশ্ব পরিভ্রমনের প্রস্তুতি নিচ্ছে , ভয় কে জয় করে মেতেছে নিত্য নতুন চমকপ্রদ আবিস্কারের নেশায় । কিন্তু তার পরও কোথায় যেন হারানোর সুর। আসলে বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত আমাদেরকে প্রযুক্তি ও নতুন জ্ঞানে ভরিয়ে তুললেও প্রযুক্তির যথাযত প্রয়োগ সবসময় হয় নি । আর তাই  এত কিছুর পরও আমরা আমাদের পৃথিবীকে  মনের মত সাজাতে পারেনি । এত  প্রাপ্তির  পরও আমাদের এই বসুন্ধরা  আজ নানা প্রশ্নের সম্মুখীন। বর্তমান পৃথিবীর খাদ্য উৎপাদন ও চাহিদা আমাদের আগামী পৃথিবীর  খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ভাবিয়ে তুলছে । সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে আজ চ্যালেঞ্জ করে বসেছে অতি আণুবীক্ষ নিক ভাইরাস,ব্যাকটেরিয়া । শিল্পায়নের প্রসারতায় আমারা আমদের চারপাশের পরিবেশকে বিষিয়ে তুলেছি। উঁচুশ্রেণীর মানুষের সুখের যোগান দিতে গিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত তৈরি করে চলছি হাড্ডি চর্মসার তৃতীয় বিশ্ব। ভাবছেন, তাহলে আমাদের কি মহা বিলুপ্তি ঘটবে? না । আর এ ‘না’ বলার নিশ্চয়তা আপনাকে দিচ্ছে ‘জৈবপ্রযুক্তিবাবায়োটেকনোলোজি’ ।  আসলে ‘জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলোজি’ হচ্ছে জীববিজ্ঞান  ও প্রযুক্তির সমন্বয় । জীববিজ্ঞান বা বায়োলজির জ্ঞানকে  মানুষের কল্যাণে নিয়ে আসাটাই ‘জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলোজি’। বস্তুত ‘জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলোজি’ হচ্ছে  এমন এক শাখা যা কিনা বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার সাথে সেতুবন্ধন রচনার মাধ্যমে আমাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছে  নতুন এক পৃথিবীর। খাদ্য নিরাপত্তা থেকে শুরু করে জটিল সব  রোগের বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকর ড্রাগ তৈরি , পরিবেশ দূষণ কমিয়ে পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে গড়ে তোলা – সর্বোপরি জৈবপ্রযুক্তি হচ্ছে আগামী পৃথিবীর ভবিষ্যৎ রচিয়তা। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে OECD (The Organization for Economic Co-operation and Development)এর  সদস্য দেশগুলো মানব স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জৈবপ্রযুক্তির তথা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যকে অনুমোদন দিয়েছে। আর এর মাধ্যমে সূচীত হয়েছে মানব সমৃদ্ধির এক নতুন ধারা ।


আসুন এবার চোখ বুলিয়ে নেই বিশ্বজুড়ে  জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলোজির অবদান  গুলোর দিকে । ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ইনসুলিন উৎপাদন , ফসলকে রোগ ও প্রতিকূল পরিবেশের প্রতিরোধী করে এর  উৎপাদন বাড়ানো (আমাদের দেশের দক্ষিনাঞ্চলে লবণ সহিষ্ণু ও উত্তরাঞ্চলে খরা সহিষ্ণু ধান উৎপাদন ও সম্ভব ), বামনত্ব ঘোচানোর জন্য গ্রোথ হরমোন , পরিবেশ বান্ধব বায়ো- ফুয়েল , বায়ো-ফার্টিলাইজার  উৎপাদন, দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য উন্নত ও কার্যকর  ভ্যাকসিন, এন্টিবায়োটিক  উৎপাদন , আমিষ সহ অন্যান্য খাদ্যপ্রাণের চাহিদা মেঠাতে উদ্ভিদ ও প্রানীর মান উন্নয়ন ,ফরেনসিক বিভাগে ডি.এন.এ ফিঙ্গার প্রিন্টিং এর মাধ্যমে অপরাধী শনাক্তকরণ , শিল্প কারখারানার বর্জ্য অপসারন,  বায়ো-ইনফরম্যাটিক্স এর মাধ্যমে দ্রুত ড্রাগ ডিজাইনিং , ভাইরাস মুক্ত সবজি উৎপাদন ও আরো অনেক কিছু । আপনাদের একটা পরিসংখ্যান দেয়া যাক । ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত নোবেলপ্রাপ্ত ব্যাক্তির সংখ্যা ১৭২ জন্য । নোবেলপ্রাপ্ত ১৭২ ব্যক্তির মাঝে বায়োটেকনোলোজি ভিত্তিক কাজের জন্য নোবেল পেয়েছেন ৪২ জন। যার মাঝে ফিজিওলোজি এবং মেডিসিন বিভাগে নোবেল জয় করেন ২৯ জন এবং রসায়ন বিভাগে ১৩ জন । তাহলে কি দাঁড়াল এই ১৫ বছরে গড়ে ২.৮ অর্থাৎ ৩ জন করে   জৈবপ্রযুক্তিবাবায়োটেকনোলোজিথেকে নোবেল জয় করেছেন !


 এবার আসা যাক মূল কথায় “ফল  দিয়ে টিকাদান” এটা কিভাবে সম্ভব ? এটাও  জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলোজির অবদান । বিষয়টা ভাল করে বুঝতে হলে প্রথমে আমাদের কিছু বিষয় সম্পর্কে জানতে হবে।


আসুন , প্রথমে জেনে নেই  ‘টিকা বা ভ্যাকসিন ’ আসলে কি ? মানুষ ও অন্য  যেকোনো  জীবদেহ অসংখ্য  কোষের সমন্বয়ে গঠিত । দেহের বিভিন্ন অংশের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কোষ । যেমনঃ আমাদের মস্তিষ্কের জন্য রয়েছে নিউরন কোষ ,  ত্বকের জন্য জন্য রয়েছে ত্বকীয় কোষ , লিভার বা যকৃতের জন্য রয়েছে হেপাটিক কোষ ।আমাদের দেহের রক্তও  বিভিন্ন্  ধরনের কোষের তৈরি।রক্তের কোষ গুলো হচ্ছে লোহিত রক্ত কনিকা ,শ্বেতরক্ত কনিকা ও অনুচক্রিকা । শ্বেতরক্ত কনিকাসমূহ আমাদের দেহের নিরাপত্তার কাজ করে। অর্থাৎ এদের কাজই হচ্ছে সবসময় খেয়াল রাখা  বাহির থেকে এমন কিছু  কি ( ব্যাকটেরিয়া , ভাইরাস ও অন্যান্য জীবাণু  )আমাদের দেহে প্রবেশ করছে যা কিনা আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর বা যা কিনা আমাদের দেহে বিভিন্ন রোগ তৈরি করতে পারে । যখনি শ্বেতরক্ত কনিকাসমূহ  এমন কিছুর খোঁজ পায় যা কিনা আমাদের জন্য ক্ষতিকর , তখনি শ্বেতরক্ত কনিকাসমূহ  আমাদেরঅগোচরে  নিজ থেকেই সেসব ক্ষতিকর জিনিস গুলোকে ধ্বংসকরে ফেলে বা আমাদের দেহে ওইসব জীবাণুর বিরুদ্ধে  প্রতিবাদ করা শুরু করে ।বিভিন্ন জীবাণুর বিরুদ্ধে আমাদের দেহে গড়ে  উঠা এ ধ্বংস প্রক্রিয়া বা প্রতিবাদ প্রক্রিয়া কে বলা হয় ইম্যুউনিটি  (IMMUNITY) ।এখন কথা হচ্ছে তাহলে আমরা ওইসব জীবাণূর মাধ্যমে অসুস্থ  হচ্ছি কেন? তার কারণ হচ্ছে রোগ  জীবাণুর সাথে আমদের দেহের প্রতিবাদ প্রক্রিয়ার একটা নীরব  প্রতিযোগিতা হয় ।আর এ প্রতিযোগিতায় যখন জীবাণু জয়ী হয় তখনি আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি ।


কোন  জীবাণু প্রথম বার আমাদের দেহে প্রবেশ করলে শ্বেতরক্তকণিকাসমূহ ঐ জীবাণুর বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে ইম্যুউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং আমাদের দেহ ঐ জীবাণুটির বিরুদ্ধে  সৃষ্ট প্রতিরোধ ব্যবস্থা তার মেমরীতে রেখে দেয়। তাই দ্বিতীয়বার যখন ঐ জীবাণুটি আবার আমাদের দেহে আক্রমন করে তখন আমাদের দেহ তার মেমরী তে রাখা প্রতিরোধ ব্যবস্থাটি দ্রুত কার্যকর করে ফলে জীবাণুটি প্রথম বারের মত এত কার্যকর হতে পারে না বা অনেক সময় প্রতিরোধ ব্যবস্থাটি এত ফলপ্রসূ হয় যে জীবাণুটি একেবারে অকার্যকর হয়ে পড়ে অর্থাৎ ঐ জীবাণু আমাদের দেহে রোগ সৃষ্টি করতে পারে না।


টীকা বা ভ্যাকসিন হচ্ছে আসলে অকার্যকর জীবানুর মিশ্রণ যা  আমাদের দেহ ঐ  জাতীয় জীবাণুর  বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা  গড়ে তুলতে সাহায্য করে কিন্তু নিজেরা রোগ সৃষ্টিতে অক্ষম। অর্থাৎ পরে ঐ  টীকা বা ভ্যাকসিনের কার্যকর জীবাণু বাইরের কোন উৎস থেকে আমাদের আক্রমন কারা মাত্রই আমাদের অতিশয় স্মার্ট (!) দেহ তার মেমরীতে রাখা  প্রতিরোধ ব্যবস্তা দ্রুত প্রয়োগ করে যার ফলে ঐ সব জীবাণু আর রোগ সৃস্টি করতে পারে না ।  কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা আরকি !


 প্রশ্ন আসতে পারে রোগ জীবানুকে আবার অকার্যকর করা হয় কিভাবে ? আগেই বলা হয়েছে মানুষ সহ প্রতিটি জীবই অসংখ্য কোষের সমন্বয়ে তৈরি ।আর কোষের অভ্যন্তরীন কাজ নিয়ন্ত্রিত হয় প্রোটিন নামক বিভিন্ন ধরনের জৈবঅণু দ্বারা ।আমাদের দেহে রোগ সৃষ্টির অন্যতম কারণ হচ্ছে বিভিন্ন অনুজীব যেমনঃ ব্যাকটেরিয়া , ভাইরাস ইত্যাদি। এসব জীবাণুর রোগ তৈরির প্রক্রিয়া এক রকম নয়। কোন জীবাণু হয়ত এমন কোন  প্রোটিন তৈরি করে যা সরাসরি আমাদের শরীরের জন্য বিপদজনক আবার কোন জীবাণু হয়ত এমন কোন প্রোটিন বা জৈব পদার্থ তৈরি করে যা আমাদের শরীরের স্বাভাবিক কোন প্রক্রিয়াকে পরোক্ষ ভাবে বাধাগ্রস্থ করে । তাই জীবাণুকে অকার্যকর করা মানে হচ্ছে জীবাণুর সব বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে শুধু মাত্র যে  বৈশিষ্ট্য  ( প্রোটিন  বা জৈব পদার্থ ) আমাদের দেহে রোগ তৈরি করে সেটাকে সরিয়ে দেয়া  অথবা রোগ সৃষ্টির জন্য যে মাত্রা দরকার তার নীচে নিয়ে আশা ।এই বৈশিষ্ট্য  সরিয়ে ফেলা বা রোগ সৃষ্টির জন্য যে মাত্রা দরকার তার নীচে নিয়ে আশার কাজটি বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে কঠিন হলেও আজকের দিনে জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলোজির কল্যাণে তা খুব একটা কঠিন কাজ নয়।


একটা জীবের কি কি বৈশিষ্ট্য থাকবে বা কি কি প্রোটিন তৈরি হবে তা প্রতিটি জীব কোষের অভ্যন্তরে ক্রোমোজোমের মধ্যে  নির্দিষ্ট অণুক্রমে সাজানো বা লিখা থাকে ।আর লিখার এ  ভাষাটা হচ্ছে ডি.এন.এ/DNA (মানুষ , উদ্ভিদ , ব্যাকটেরিয়া ) অথবা আর.এন.এ/RNA (ভাইরাস)।একটা নির্দিষ্ট আকারের ডি.এন.এ বা আর. .এন.এ থেকে যখন কোন  বৈশিষ্ট্য  বা  প্রোটিন প্রকাশ পায় তখন সেই ডি.এন.এ বা আর.এন.এ  অংশ কে বলা হয় জীন(Gene) ।আমাদের দেহে এরকম ২৫০০০-৩৫০০০ জীন রয়েছে যা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য  বা  প্রোটিন প্রকাশের জন্য দায়ী ।আজকের দিনে জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলোজির কল্যাণে আমরা  ডি.এন.এ বা আর.এন.এ র এ ভাষাটা পড়ে ফেলতি পাড়ি । অর্থাৎ বুঝে ফেলতে পাড়ি যে কোন জীন কোন বৈশিষ্ট্য  বা  প্রোটিন প্রকাশ করছে ।আর  সেকারণেই একটা জীবাণুর ডি.এন.এ বা আরএন.এর পুরো অংশ(জিনোম) থেকে আমাদের জন্য বিপদজনক অর্থাৎ রোগ সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্য  বা  প্রোটিন প্রকাশের জন্য দায়ী জীন কে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে সরিয়ে ফেলতে পাড়ি বা জীন প্রকাশের মাত্রা কমিয়ে দিতে পাড়ি ।আর এভাবেই তৈরি করতে পাড়ি অকার্যকর জীবাণু অর্থাৎ টীকা বা ভ্যাকসিন।আগেই বলে রাখা ভাল এখানে শুধু টীকা বা ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলোজির বেসিক একটা প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে ।


এবার আসা যাক গাছের ফলে আমরা কিভাবে টীকা বা ভ্যাকসিন নিয়ে আসব ।আগেই বলেছি যে টীকা বা ভ্যাকসিন হচ্ছে অকার্যকর জীবাণু ।আরও নির্দিষ্ট করে বললে  টীকা বা ভ্যাকসিন হচ্ছে কোন জীবাণুর ঐসব প্রোটিনের মিশ্রণ যা কিনা আমাদের দেহে রোগ সৃষ্টি করতে পারে না কিন্তু আমাদের দেহে ঠিকই রোগ  প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে । এখন কথা হচ্ছে আমরা যদি কোন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের প্রোটিনের জীন (যেসব জীন রোগ সৃষ্টিকারী প্রোটিন তৈরি করে না) কোন উদ্ভিদের জিনোমে প্রবেশ করাতে পাড়ি তাহলে উদ্ভিদে ঐ ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের প্রোটিনের প্রকাশ ঘটবে । এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলোজির কল্যাণে প্রোটিনের এই প্রকাশ টা আমারা ইচ্ছে করলে গাছের ফলের মধ্যেও ঘটাতে পাড়ি। তাহলে কি দাঁড়াল , গাছের ফল খাওয়ার সাথে আমাদের টীকা বা  ভ্যাকসিন নেয়া হয়ে যাবে।এভাবে প্রস্তুতকৃত ভ্যাকসিনের নাম দেয়া হয়েছে  ‘এডিব্ল ভ্যাকসিন’ । ধরুন হেপাটাইটিস বি  ভ্যাকসিনের কথা ।গবেষণায় দেখা গেছে  হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের তিনটি প্রোটিন HBsAg , HBcAg , HBeAg আমাদের দেহে ইম্যুউনিটি  (IMMUNITY) অর্থাৎ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের বিপক্ষে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পাড়ে কিন্তু এসব প্রোটিন রোগ সৃস্টির সাথে জড়িত নয় ।এখন এই হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের প্রোটিন গুলোকে  আমারা যদি জৈবপ্রযুক্তিবা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে আমাদের অতি পরিচিত কলা  বা টমেটো তে প্রকাশ ঘটাই তাহলে আমার কলা বা টমেটোতেই হেপাটাইটিস বি  ভ্যাকসিন  পেয়ে যাবে যা কিনা আমাদের দেহে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের বিপক্ষে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।তাহলে কি দাঁড়াল , আপনি হয়ত সকালের নাস্তায় কলা খাবেন বা দুপুরের সালাদে টমেটো খাবেন কিন্তু একই সাথে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টীকাদান কর্মসূচীও হয়ে যাবে।


 বর্তমানে যেসব প্রচলিত ভ্যাকসিন রয়েছে তাদের মান নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষন ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। যেমনঃ কোন কোন ভ্যাকসিন সংরক্ষনের জন্য বিশেষ রেফ্রিজারেশন ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে এডিবল  ভ্যাকসিন আমাদের সামনে সম্ভাবনার এক নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে । । এডিব্ল  ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণ বা বিশেষ ভাবে  সংরক্ষনের কোন প্রয়োজন নেই । তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশ গুলোর জন্য এডিবল  ভ্যাকসিন  আশীর্বাদস্বরূপ । এসব দেশে সাধারনত রোগ শোকের প্রকোপ এমনিতেই বেশি থাকে। তাই আগামীতে হয়ত দেখা যাবে হাইতির কোন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের কয়েক বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেই ঐ দেশের মানুষের জন্য ম্যালেরিয়া ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে যাচ্ছে । আপনাদের কিছু তথ্য দিয়ে রাখি , হিসেব করে দেখা গেছে মাত্র চল্লিশ বিঘা জমিতে আলু চাষ করলে পুরো চীনে কলেরা ভ্যাকসিন জোগান দেয়া যাবে । আর পুরো পৃথিবীর মানুষের জন্য লাগবে ২০০-২৫০ বিঘা জমি !


এবার জানা যাক, সারা বিশ্বে এই এডিবল ভ্যাকসিনের বর্তমান চিত্রটা কেমন । ১৯৯৮ সালে হংকং এর  প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ডঃ ডমিনিক লাম’স ‘এডিবল প্লান্ট ভ্যাকসিন’ এর পেটেন্ট সত্ত্ব নিয়ে নেন। ম্যাসুচুসেটস ইন্সিটিউট অব টেকনোলোজী (MIT) এডিবল ভ্যাকসিনের এই পেটেন্টকে পৃথিবীর সেরা দশটি পেটেন্টের একটি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে । আর বিখ্যাত টাইমস ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে ‘এডিবল প্লান্ট ভ্যাকসিন’ একবিংশ শতাব্দীর সেরা দশটি আবিস্কারের মধ্যে একটি। ডঃ ডমিনিক ও তাঁর দল  ইতিমধ্যেই ‘এডিবল প্লান্ট ভ্যাকসিন’ এর বাজারজাত করণ প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন ।  এছাড়া পৃথিবীর অনেক জায়গায় বিজ্ঞানীরা এডিবল ভ্যাকসিন নিয়ে নিরলস গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন ।অনেক ভ্যাকসিন আবার পরীক্ষামূলক ধাপ পেড়িয়ে বাজারে আসার অপেক্ষায় । যেমনঃ রোজয়েল ইন্সটিটিউট অব নিউইয়র্কের বিজ্ঞানীরা এডিবল হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন প্রস্তুতিতে সফল হয়েছেন। ইউনিভার্সিটি অব টোকিও এর বিজ্ঞানীরা এমন এক ধান গাছ উদ্ভাবনে সফল হয়ছেন যা কিনা আমাদের জন্য কলেরা ভ্যাকসিন হিসেবে কাজ করবে ! অন্যদিকে , জার্মানীর বিজ্ঞানীরা দিচ্ছেন টমেটো দিয়ে ভ্যাকসিনের সমাধান । তাই অদূর ভবিষ্যতে হয়ত এমন এক দিন আসবে যে আপনি দুপুরে খেতে বসবেন ভ্যাকসিনে ভরপুর সুস্ব্যাদু সব খাবার নিয়ে ! অর্থাৎ টীকাদান কর্মসূচী হবে ‘ফলে ফলে খাবার টেবিলে’ !


 একটি সুন্দর ও সুস্থ পৃথিবীর নিশ্চিয়তায় এডিবল ভ্যাকসিন তথা  জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলোজির সম্ভাবনা রূপকথার কল্প কাহিনীকেও হার মানায়। জৈবপ্রযুক্তির সম্ভাবনা আজ আর আলোচনার টেবিলে সীমাবদ্ধ নয় । জৈবপ্রযুক্তির আমাদের  স্বপ্ন দেখাচ্ছে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার , স্বপ্ন দেখাচ্ছে মরণ ব্যাধি এইডস ক্যান্সার কে  জয় করার , স্বপ্ন দেখাচ্ছে পারসনালাইজড ড্রাগ(প্রতিটি মানুষের জন্য আলাদা আলাদা ড্রাগ ) ও বায়োপ্রিন্টার প্রযুক্তির (দুর্ঘটনায় মানুষের কোন অঙ্গ হানি ঘটলে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে দ্রুত পুনঃস্থাপন করা হবে) , স্বপ্ন দেখাচ্ছে ডিজাইনার বেবীর (বাবা-মা তার সন্তানের গায়ের রং, চোখ বা চুল যেমন চান  জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে  ঠিক তেমন শিশু-ই তৈরী করে দেয়া সম্ভব হবে), জৈবপ্রযুক্তি স্বপ্ন দেখাচ্ছে দূষণমুক্ত পরিবেশের, স্বপ্ন দেখাচ্ছে এমন এক পৃথিবীর যেখানে খাবারেই মিলবে রোগ থেকে মুক্তি (এডিবল ভ্যাকসিন)।  আর তাই আমরা বলতেই পারি  আগামী  পৃথিবী  হবে জৈবপ্রযুক্তিময় পৃথিবী ।


 

 

Mahmudul Hasan


4th year 2nd Semester


Dept. of Genetic Engineering & Biotechnology , SUST


No comments:

Post a Comment