Tuesday, December 10, 2013

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল:

পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে নানা রহস্য। মানুষও এসব রহস্য উদঘাটনে মরিয়া হয়ে ছুটেছে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, বাহামা দ্বীপ এবং ক্যরিবীয়ান দ্বীপ এই তিনটি স্থানকে নিয়ে যে ত্রিভুজাকার এলাকা পাওয়া যায় সেটাই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এর রহস্যময়তার জন্য সবার কাছেই কম বেশী পরিচিত। বারমুডা ট্রায়াঙ্গালের আরো সব বিতর্কের মধ্যে একটি হলো, ফ্লাইং সসারের আগমন। অনেকে মনে করেন, এই এলাকাটি উন্নত গ্রহের প্রানিদের পৃথিবীতে অবতারণের স্থান। এ ধারনার কারন হলো, এই এলাকায় চলাচলকারী কিছু নাবিক নাকি আকাশে উড়ন্ত সসারের আনাগোনা দেখতে পান। তবে, এটি নিছক কল্পনা হিসেবে ধরা হয়। কারন, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। যেসব রহস্যময় ঘটনা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকে ঘিরে শোনা যায় সেগুলোঃ

  • বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে প্রায়শ:ই নৌযান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে নিশ্চিন্থ হয়ে যায়।

  • বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের উপর দিয়ে বিমান উড়ে গেলে তার আর হদিস পাওয়া যায় না।

  • এই এলাকায় কম্পাসের কাঁটা এলোমেলো দিক নির্দেশনা দেয়।

  • বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে যেসব মানুষ দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন তাদের সাথে শেষবার যোগাযোগের সময় অদ্ভুৎ আচরন করেছেন বা কথাবার্তা বলেছেন এবং অতঃপর সম্পূর্ণ  নিশ্চিন্থ হয়ে গেছেন।

  •  মাঝে মাঝে সময় এবং অবস্থান উল্টা-পাল্টা হয়ে যায়। একজন পাইলট নাকি আকস্মিকভাবে দুই ঘন্টার পথ চোখের নিমেষে পাড়ি দিয়ে ফেলেছেন।


 

প্রথমবার বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে অস্বাভাবিকভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা উপলব্ধি করা হয় ১৯৫০ সালের ১৬ ই সেপ্টেম্বর। এর দুই বছর পর আবারো fate নামের একটি ম্যাগাজিনে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের অস্বাভাবিক দুর্ঘটনা নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখা হয়। সেখানে ট্রায়াঙ্গেল এলাকায় নিখোজ হওয়া বেশ কিছু বিমান ও জাহাজের উল্লেখ করা হয়। সেখানে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ইউএস নেভীর প্রশিক্ষণ বিমানের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার বর্ণনা ছিল। রেডিওতে পাইলটদের সাথে যোগাযোগের সময় তাদের কথাবার্তা বেশ রহস্যময় মনে হয়েছে। তারা নাকি বলছিলেন: “সাদা পানিতে ডুবে যাচ্ছি।” একটু পরেই বলতে শোনা গেলো “সবুজ পানিতে ডুবে যাচ্ছি।” তার কিছুক্ষণ পরে বলছিলেন “মঙ্গলে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।” মূলত এই প্রবন্ধটিই প্রথম বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের দুর্ঘটনা অলৌকিক হিসেবে বর্ণনা করে।
১৯৬৪ সালে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের দুর্ঘটনাগুলোর রহস্যময়তা বর্ণনা করে প্রথমবারের মত বই লেখা হয়। যার নাম Invisible Horizones. বইটির লেখক ছিলেন Vincent Gaddis. এর পরে বারমুডাকে নিয়ে একের পর এক বই লেখা হতে থাকে। কেউ বলেন: বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের বিমান ও জাহাজগুলো মহাজাগতিক জীবের আক্রমনের শিকার। কেউ আবার বলেন প্রাচীন লেখকদের লেখায় যে ‘আটলান্টিস’ নামক শহরের বর্ণনা পাওয়া যায় সেই শহরটি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের ভিতরেই কোথাও ডুবে আছে। সেই শহরেরই কোন প্রযুক্তিগত প্রভাবে দুর্ঘটনাগুলো ঘটে থাকে। আরেকজন বললেন যেহেতু কম্পাস ঠিকমত পাঠ দেয় না, তারমানে বারমুডার কোথাও শক্তিশালী কোন চুম্বক আছে। যার প্রবল আকর্ষণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে। কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ওয়ার্ম হোলের অস্তিত্ব আবিষ্কার করলেন। কেউ এর মধ্যে স্থান-কালের বক্রতাও টেনে নিয়ে এলেন। এই সবগুলো বই লেখা হয়েছিল ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৪ এর মধ্যে।
এরপর ১৯৭৫ সালে লরেঞ্জ ডেভিড কুশে নামের এক লাইব্রেরিয়ান কয়েকবছরের সংবাদ পত্র ঘেটে এবং সব দুর্ঘটনার খবর অনুসন্ধান করে The Bermuda Triangle Mystery: Solved নামের একটি বই লিখলেন এবং দেখিয়ে দিলেন বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের নামে যত রহস্যময়তা এবং তত্ত্ব বর্ণনা করা হয়েছে তার সবই হয় অতিরঞ্জিত, সন্দেহমূলক কিংবা প্রমাণহীন। কুশের গবেষণা দেখিয়ে দিল যে অধিকাংশ ঘটনার বর্ণনা, সক্ষীর বর্ণনা, পর্যবেক্ষকদের বর্ণনা সামঞ্জস্যহীন। তিনি দেখলেন আগে যে ঘটনাগুলোকে সম্পূর্ন নিখোঁজ বলা হয়েছিলো সেগুলোর বর্ণনাও পত্র-পত্রিকায় পাওয়া যাচ্ছে। এবং তিনি আরো দেখতে পেলেন যে অনেক ঘটনাই ঘটেছে এই এলাকার বাইরে যেগুলোকে ইতিপূর্বে এই এলাকার সাথে সম্পৃক্ত দেখানো হয়েছে। তার গবেষনা ছিলো অত্যন্ত সরল প্রকৃতির এবং তিনি পত্রপত্রিকা ঘেটেই বারমুডা রহস্য উদঘাটন করেন। পরিশেষে তিনি এই উপসংহারে আসেন যে,

  • দুঘটনা কবলিত জাহাজ এবং উড়োজাহাজের সংখ্যা অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করা হয়েছিল।

  • এটা এমন একটি এলাকা যেখানে প্রতিনিয়ত মৌসুমী ঝড় বহমান। এবং ঝড়ের সাথে দুর্ঘটনার সংখ্যা তুলনা করলে সেটা যথেষ্ট বাস্তব-সম্মত মনে হয়।

  • বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এলাকাটি অত্যন্ত ব্যস্ত নৌ-পথ। ব্যস্ততা তুলনা করলে এখানে ঘটা দুর্ঘটনার সংখ্যা সমুদ্রের অন্যান্য এলাকায় ঘটা দুর্ঘটনার সাথে সমতুল্য।

  • ব্যস্ত নৌপথ হওয়ায় এখানে প্রচুর জলদস্যুর আনাগোনা ছিল। এরা সাধারণত ছোটখাটো জাহাজে লুটপাট চালিয়ে সেগুলোকে ডুবিয়ে দিত।

  • অনেকসময় খবর আংশিকভাবে প্রকাশ করা হত। কোন জাহাজ বা প্লেনের নিখোঁজ হওযার খবর প্রচার হত। কিন্তু ফিরে আসার খবর প্রচার হত না।


কুশের বইটি প্রকাশের পর সবার টনক নড়ে এবং আরো যা পাওয়া যায়:

  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই এলাকায় প্রচুর সাবমেরিন মোতায়েন হয়। এদের আক্রমনে যেসব জাহাজ ও প্লেন ডুবি হত সেগুলো সামরিক কর্তৃপক্ষ গোপন রাখত।

  • এই এলাকার নীচ থেকে প্রচুর মিথেন গ্যাস নির্গত হয় যা পানির সাথে মিশে হাইড্রেটেড মিথেন তৈরি করে। এই হাইড্রেটেড মিথেন বেশ হালকা। একারনে কিছু কিছু ভারী জাহাজ পানিতে ডুবে যায়।

  • মেক্সিকান উপসাগরীয় প্রবল স্রোতে(এই স্রোতটি অনেকটা নদীর মত) অনেক দুর্ঘটনা কবলিত যান দুরে ভেসে যায়।

  • কম্পাসের ব্যপারে তথ্য হল পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানেই কম্পাসের বিক্ষেপের ভিন্নতা দেখা যায় যেহেতু পৃথিবীর ভৌগলিক মেরু এবং চৌম্বকীয় মেরু এক নয়। খুব অল্প কিছু যায়গায় অবস্থানকালে একই দুই মেরু একই দিকে থাকে এবং কম্পাস সঠিক দিক নির্দেশ করে। অন্যত্র কম্পাস চৌম্বকমেরুর দিক নির্দেশ করে।

  •  মানুষের ভুলেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ইউএস নেভীর তথ্য থেকে জানা যায়।


এসবের বাইরেও কথা আছে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যময়তার সুযোগে কিছু কিছু কোম্পানী তাদের অপেক্ষাকৃত পুরোনো জাহাজ বা বিমানগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ডুবিয়ে দিয়ে বীমার টাকা আদায় করত বলেও শোনা যায়।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল বা শয়তানের ত্রিভূজ আটলান্টিক মহাসাগরের একটি বিশেষ অঞ্চল, যেখান বেশ কিছু জাহাজ ও উড়োজাহাজ রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হওয়ায় কথা বলা হয়। অনেকে মনে করেন ঐ সকল অন্তর্ধানের কারণ নিছক দূর্ঘটনা, যার কারণ হতে পারে প্রাকৃতিক দূর্যোগ অথবা চালকের অসাবধানতা। আবার চলতি উপকথা অনুসারে এসবের পেছনে দায়ী হল কোন অতিপ্রকৃতিক কোন শক্তি বা ভিনগ্রহের কোন প্রাণীর উপস্থিতি। তবে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য রয়েছে যে , যেসব দূর্ঘটনার উপর ভিত্তি করে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকে চিহ্নিত করা হয়েছে তার বেশ কিছু ভুল, কিছু লেখক দ্বারা অতিরঞ্জিত হয়েছে এমনকি কিছু দূর্ঘটনার সাথে অন্যান্য অঞ্চলের দূর্ঘটনার কোনই পার্থক্য নেই। এরকম অনেক রহস্য আর ব্যাখ্যা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে।

No comments:

Post a Comment