যুগে যুগে টাইম মেশিন নিয়ে অনেক জলপনা কল্পনা হয়েছে। আজও হচ্ছে। আমাদের এখন মনে হতে পারে যে টাইম মেশিন হয়ত সম্ভব। কারণ আমরা অতীত দেখতে পাই স্মৃতি হিসেবে। আর জীবনের এক সেকেন্ড যেতে না যেতেই তা অতীত হয়ে যায়। আবার সম্ভাব্য ভবিষ্যতও আমরা কল্পনা করতে পারি। যেমন যুক্তি দিয়ে যদি চিন্তা করি যে কোন একটা ব্যাপার ভবিষ্যতে ঘটবে কখনও কখনও দেখা যায় অদুর ভবিষ্যতে দেখা যায় সেই ব্যাপারটাই ঘটছে। তাই এভাবে ভাবলে মনে হয় সময়ের ভিতর দিয়ে তো যাওয়া যেতেই পারে, অন্তত মনের মাধ্যমে।
সম্প্রতি ২৭ বছর বয়সী ইরানের তরুণ বিজ্ঞানী আলী রাজেকি ‘টাইম মেশিন’ উদ্ভাবন ও নিবন্ধনের দাবি করেছেন। তিনি এমন একটি যন্ত্র উদ্ভাবনের দাবি করেছেন, যা ব্যবহার করে কোনো ব্যক্তি তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে পারবে।কমপক্ষে পাঁচ বছর এবং সর্বোচ্চ আট বছর পরে কী হবে, সে সম্পর্কে যন্ত্রটি প্রায় নির্ভুল তথ্য দেবে বলে আলী রাজেকি দাবি করেছেন। তার দাবি, অনেকগুলো জটিল গণনাপ্রণালীর মাধ্যমে যন্ত্রটি ৯৮ শতাংশ সঠিক তথ্য দিতে সক্ষম। যন্ত্রটি স্পর্শ করার সাথে সাথে যন্ত্রটি স্পর্শকারীর ভবিষ্যত তথ্য সম্বলিত একটি প্রিন্টেড কপি দেয়।আলী রাজেকির দাবি। “এ মেশিনটি কোন দেশের ভবিষ্যতের কোন অপ্রাত্যাশিত ঘটনার বছরও অবলিলায় বলে দিবে। তবে বর্তমানে কথিত এই টাইম মেশিনের বাণিজ্যিক উৎপাদন না করার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ” আমরা এখনই এটির প্রটোটাইপ চালু করছি না, এতে চিন এ যন্ত্রের আইডিয়া চুরি করতে পারে। দেখা যাবে, এক রাতেই তারা কয়েক কটি যন্ত্র তৈরি করে ফেলেছে!”তবে কথিত এই টাইম মেশিনের জন্য আমাদের আরও পাঁচ থেকে আট বছর অপেক্ষা করতে হবে, যাতে মেশিনটির বর্তমানের ভিবিষ্যত বাণী সত্য হচ্ছে কি না তা নিরূপণ করা যায়। যেমনটা আগে বলা হয়েছে, এই মেশিনটি সর্বোচ্চ আট বছর পরে কী হবে তা বলে দিতে সক্ষম।
আমরা যদি একটি সাদা খাতা অথবা কোন ব্ল্যাকবোর্ড দেখি তাহলে বুঝি যে এটি একটি দ্বি-মাত্রিক বস্তু , কারণ এর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আছে। এখন আমরা যদি আমাদের নিজেদের শরীর দেখি অথবা একটা পানির বোতল দেখি দেখব এর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, পুরুত্ব আছে অর্থাৎ এটি ত্রি-মাত্রিক। এখন চারমাত্রিক ব্যাপারটা আবার কি? স্টিফেন হকিংস খুব সহজ ভাবে বলেছেন সময় হল চারমাত্রিক যা কিনা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, পুরুত্ব এর মতই। ধরি,আমরা একটি গাড়ি চালাচ্ছি। এখন গাড়িটি যদি সামনের দিকে যায় তাহলে সেটা হবে প্রথমমাত্রা, গাড়িটি যদি ইউটার্ণ নিয়ে ডান কি বামে যায় তাহলে সেটা হবে দ্বিতীয় মাত্রা, গাড়িটি যদি ওপরের দিকে কোন পাহাড়ের রাস্তা ধরে উঠতে থাকে তাহলে সেটা হবে তৃতীয় মাত্রা। আর চতুর্থমাত্রাটা হল সময় ।
সায়েন্সফিকশন সিনেমায় দেখা যায় একটি সুবিশাল,শক্তিশালী টাইম মেশিন যেটি চতুর্থমাত্রার মাধ্যমে একটি সুড়ংগ তৈরী করে, একজন বিশেষ চরিত্র থাকে যিনি এই মেশিনের মধ্যে দিয়ে চলাফেরা করতে জানেন ।এই ধারণাটা করা খুব কষ্টকল্প, বাস্তব এর থেকে ভিন্ন হতে পারে ; কিন্তু এমন সম্ভাবনা বাস্তব জগৎ এ অসম্ভব নয়।
পদার্থবিদ্যার সুত্রসমুহ টাইম মেশিন দিয়ে সময় ভ্রমণ করার একটা ধারণা দেয় যেটা সম্ভব হতে পারে ওয়ার্মহোল’র মাধ্যমে। ওয়ার্মহোল হল একটা অবস্থার নাম। ওয়ার্মহোল অসম্ভব ছোট দেখার জন্য এবং এরা আমাদের চারিদিকেই অবস্থান করছে ।স্টিফেন হকিংস বলেন, এমন কোনকিছুই নেই যা কিনা সমতল এবং কঠিন। আমরা যদি খুব ভাল করে দেখি দেখব পরমাণুগুলোর ভেতরে একটা শুণ্য স্থান আছে। এটা হল মৌলিক ভৌত নীতি যেটা সময়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
এদিকে টাইম মেশিনের সবচেয়ে বড় মডেল হচ্ছে আমদের মহাবিশ্ব। আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থিত কৃষ্ণ গহ্বর স্বয়ং নিজে একটি টাইম মেশিন। কৃষ্ণ গহ্বর এর ঘনত্ব এত বেশি যে আলোও এর ভেতর ঢুকলে বেরিয়ে আসতে পারে না। আমরা জানি, আলো এক সেকেন্ডে ৩,০০,০০০ কি.মি. হিসেবে, এক বছরে যেতে পারে ১০ ট্রিলিয়ন কি.মি. বা ৬ ট্রিলিয়ন মাইল। একে এক আলোকবর্ষ বলা হয়। সুতরাং আলোকবর্ষ সময়ের একক নয়, দুরত্বের একক। চাঁদের আলো পৃ্থিবীতে পৌঁছাতে সময় লাগে ১ সেকেন্ডে। এর অর্থ আমরা পৃ্থিবীতে অবস্থান করে এক সেকেন্ড পূর্বের চাঁদকে দেখতে পাই। আবার সূর্য্যের আলো পৃ্থিবীতে আসতে সময় লাগে ৮ মিনিট ৪ সেকেন্ড। তার মানে এক্ষেত্রে আমরা ৮ মিনিট ৪ সেকেন্ড পূর্বের সূর্য্যেকে দেখতে পাই। সিরিয়াস নামের সবচাইতে উজ্জ্বল যে নক্ষত্রটি আমরা দেখি রাতের আকাশে, তার দূরত্ব পৃ্থিবী থেকে ৮ আলোকবর্ষ। সুতরাং রাত ১০ টায় পৃথিবীতে আবস্থান করে, ৮ আলোকবর্ষ পূর্বের নক্ষত্রকে দেখতে পাই মাত্র। ওরিয়ননেবুলার দূরত্ব পৃ্থিবী থেকে ১৫০০ আলোকবর্ষ। পৃ্থিবীতে রোমান সাম্রাজ্য পতনের সময় ওরিয়ননেবুলা যে আলো বিকিরণ করেছিল, তা-ই একবিংশ শতাব্দী তথা তৃ্তীয় সহস্রাব্দের প্রারম্ভে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির দূরত্ব পৃ্থিবী থেকে ২.৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ। অর্থাৎ আদি মানবেরা যে সময়ে সামনের দু’টো পা-কে হাতে পরিণত করে, চারপায়ে হাঁটার পরিবর্তে পেছনের দু’পায়ে হাঁটতে শুরু করেছিল, সেই সময়ে এন্ড্রোমিডা যে আলো বিকিরণ করেছিল, তা-ই হোমো সেপিয়েন্সের উত্তরপুরুষ হিসেবে আমরা আজকে প্রত্যক্ষ করছি। ১০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের কোন গ্যালাক্সি প্রত্যক্ষ করে মানে ১০ মিলিয়ন বছর পূর্বের গ্যালাক্সিকে প্রত্যক্ষ করা। ১০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সিটি ঠিক এই মুহূর্তে যে আলো বিকিরণ করছে, তা দেখবে এখন থেকে ১০ মিলিয়ন বছর পরে আবির্ভূত আমদের বুদ্ধিমান উত্তরপুরুষরা। কিন্তু ততোদিনে পৃথিবী নামক গ্রহটিতে প্রাণের আস্তিত্ত্ব বিশেষত মানবজাতি থাকবে কিনা তা-ই সন্দেহ। এদিকে ১ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের কোন গ্যালাক্সিগুচ্ছ পর্যবেক্ষণ করার অর্থ সেই গ্যালাক্সিগুচ্ছ ১ বিলিয়ন বছর পূর্বে যে আলো বিকিরণ করেছিল, তা পর্যবেক্ষণ করা। সুতরাং মহাবিশ্বের কী পরিমাণ আমরা পর্যবেক্ষণ করতে আমরা সক্ষম হবো, তা আলোর গতি দ্বারা সীমাবদ্ধ। অথবা বলা যেতে পারে তা আলোর গতির সাথে সম্পর্কিত। মহাবিশ্বের বয়স যদি ২০ বিলিয়ন হয়, তবে ২০ বিলিয়নের অধিক আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি কিংবা গ্যালাক্সিগুচ্ছ অথবা গ্যালাক্সিগুচ্ছসমূহের গুচ্ছ থেকে আলো আমাদের পৃথিবীতে এসে পৌঁছানোর মতো সময় এখনো হয়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে বলা যায়, পৃথিবী থেকে আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের সব ডিরেকশনে প্রসারণ ঘটছে ২০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। এখানে একটি তাত্ত্বিক প্রসঙ্গ এসে যায়। আর তা হলো, আমদের দৃশ্যমান মহাশূন্যের সাথে পুরো মহাবিশ্বের সংযোজন ঘটেনি। অর্থাৎ, মহাবিশ্বের বিশাল অংশ আমদের দৃশ্যমান জগতের বাইরে অবস্থিত।
এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে সবচেয়ে দ্রুত গতি সম্পন্ন কণা পাওয়া গেছে জেনেভায় অবস্থিত সার্ণের গবেষণাগারে যেখানে একটি বেলনাকৃতি সুড়ংগ দিয়ে কণা গুলোর মধ্যে সংঘর্স ঘটে সবচেয়ে দ্রুত গতির মাধ্যমে ।
কিন্তু মানুষের গতি বারাতে হলে আমাদের যেতে হবে মহাকাশে। এপোল-১০ এর গতি ছিল ঘন্টায় ৩০,০০০ কিলোমিটার ।কিন্তু টাইম ট্রাভেলের জন্য দরকার এর চেয়ে ২০০০ গুণ গতি সম্পন্ন অনেক বড় ভারী মহাকাশযান। যেটা অনেক জ্বালানী ধরে রাখতে পারবে আলোর গতিতে পৌছনোর জন্য। এই গতি সম্পন্ন মহাকাশযানটি যদি আমাদের মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত কৃষ্ণ গহ্বরকে আবর্তন করতে থাকে তাহলে এই আবর্তন শুরুর ৬ বছর পরে তা আলোর গতি অর্জন করবে। তখন মহাকাশযানের একদিন হবে পৃথিবীর এক বছরের সমান।
তবে আশা করা যায় বিজ্ঞানীরা একদিন তাদের পরিশ্রম সার্থক করে পৃথিবীবাসীকে তাদের কাঙ্ক্ষিত টাইম মেশিন উপহার দিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ সময়ে নিয়ে যাবে।
No comments:
Post a Comment