Tuesday, December 10, 2013

ডিভাইনিটি অ্যান্ড প্যারীটি



এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিতে অন্য যেকোনো গ্রহের চেয়ে প্রযুক্তির দিক দিয়ে এগিয়ে
আছে "নিরভানা"। নিরভানা সম্পর্কে কোন এলিয়েনরা আজ পর্যন্ত কোন খুচরা
তথ্যও জোগাড় করতে পারেনি। কিন্তু নিরভানার কন্ট্রোলার অফিসে মহাবিশ্বের
যাবতীয় বুদ্ধিমান প্রাণীদের তালিকা সাজানো আছে। বিজ্ঞান দিয়ে যদি নিরভানার
কথা বলতে হয় তবে সেই বিজ্ঞানকেও নিরভানার হতে হবে। নিরভানার বিজ্ঞানকে
এলিয়েনদের সাথে তুলনা করা চলে না। তারা একই সঙ্গে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের
অনুগামী। তারা চলতে পারে আলোর থেকেও শত গুণ দ্রুত বেগে। তাদের আছে
অ্যান্টি-পার্টিকেল। অ্যান্টি-পার্টিকেলের সফল ব্যাবহার এবং নিরাপত্তা দেওয়া
কেবল তাদের জন্যই সম্ভব। তাদের প্রযুক্তির একটা বিরাট অংশ জুড়ে তাই এই
অ্যান্টি-পার্টিকেলগুলো । বিগ-ব্যাং এর আদি ধাপে বিলিয়ন-বিলিয়ন কণা এবং
প্রতিকণার সৃষ্টি হয় যেগুলো পরবর্তী ধাপে একে অপরকে প্রশমিত করে।
কণা এবং প্রতিকণা একে অপরের সাথে সংঘর্ষ করে শুন্যে মিলিয়ে যায় এবং সৃষ্টি
করে বিপুল পরিমাণ শক্তি। হয়তো কনা-এবং প্রতিকণার হিসেবে তারা বিজোড়
সংখ্যক ছিল। ফলস্বরূপ কণা-প্রতিকণার সংঘর্ষ শেষে কেবল একটি কণাই অবশিষ্ট
থাকে। বাকিদের সংঘর্ষের ফলে নির্গত শক্তি এই ক্ষুদ্র কণাকে নিয়ে জন্ম দেয় বিগ-
ব্যাং এর। সম্পূর্ণ মহাবিশ্বের পদার্থ এবং শক্তি বলতে আজ আমরা যা বুঝি তা ঐ
ছোট কণার ভেতর পুঞ্জীভূত ছিল। মহাবিশ্বের সবকিছুকে আমরা আজ পদার্থ
হিসেবে পাই, কণা হিসেবে পাই। স্বাভাবিক নিয়মে কোন প্রতিকণিকার সন্ধান
পাওয়া আমাদের জানা মহাবিশ্বে সম্ভব নয়। কিন্তু এই অ্যান্টি-পার্টিকেলগুলোই
নিরভানার নিরাপত্তা, শক্তি ,জ্বালানী হিসেবে ব্যাবহার হয় উন্নত প্রযুক্তিতে ।
নিরভানাতেই যে পরিমাণ অ্যান্টি-পার্টিকেল আছে তা এই জানা সৃষ্টিজগতকে
শুন্যে পরিণত করার জন্য যথেষ্ট। এলিয়েনদের কোন সিগন্যাল ডিটেক্ট করতে
পারেনি নিরভানাকে, হয়তো তাদের দ্বারা সম্ভব না।

নিরভানায় অবিরত সমতা নির্ধারণের জন্য চলে "প্যারীটি" নামক প্রোগ্রাম।
নিরভানার অধিবাসী সবাই যতটা না এই প্রোগ্রামের সাথে পরিচিত তার থেকেও
কম পরিচিত তাদের নিজ গ্রহ নিরভানা সম্পর্কে। নিরভানায় প্যারীটি প্রোগ্রামে
অচিরেই অংশ নিতে যাওয়া এমন একজনের নাম লিয়েন। কিন্তু প্রোগ্রামে অংশ
নেয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কাউকে জানানো হয় না। লিয়েনদের ভেতর একই
সাথে কৌতূহল, অনাস্থা এবং ভয় কাজ করে। কারণ একবার প্রোগ্রামে যাদের
পাঠানো হয় এখন পর্যন্ত তারা পুনরায় নিরভানায় ফিরে আসেনি। লিয়েনদের
জন্য পালানোর পথ নেই কোন। কন্ট্রোলার সেকশনের ব্যাপক নিরাপত্তার
সামনে তারা নিরুপায়। লিয়েনদের অনুভূতি আছে, আছে চলার, দর্শন, শ্রবণ,
কথা বলার ক্ষমতা। তাদের হাতের তালুতে লাল সিগন্যাল দেখানোর আগেই
এনার্জি রিচার্জ করে নিতে হয়। এনার্জির জন্য তারা তাদের হাতে বসানো চিপটির
মাধ্যমে সরাসরি কন্ট্রোলার সেকশনের সাথে যোগাযোগ করে। কন্ট্রোলার সেকশনে
কে বা কারা আছে এসব কিছুই জানে না লিয়েনরা। একটি "ডেমিয়াগ" সুপার
কম্পিওটারের মাধ্যমে লিয়েনদের গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখা হয়।
ডেমিয়াগের নিরাপত্তা আজ পর্যন্ত কেউ ফাঁকি দিতে পারেনি। লিয়েনরা জানে না
কীভাবে, কবে তাদের সৃষ্টি ? কি তাদের উদ্দেশ্য ? কন্ট্রোল সেকশনে ঢোকার
কোন অনুমতি নেই তাদের। ডেমিয়াগ প্যারীটি প্রোগ্রামে লিয়েনদের পাঠানোর
সময় প্রয়োজনীয় সব ব্যাবস্থা গ্রহন করে। কেবল তখনই কন্ট্রোল সেকশনের
সবথেকে বাইরের ছোট ঘুপচির মতো সিলিন্ডার আকৃতির রুমে প্রবেশের
অধিকার পায় তারা। কেউ ডেমিয়াগের মতের বিরুদ্ধে গেলে ডেমিয়াগ তার
ফাংশন টার্মিনেট করে দেয়। লিয়েনদের মৃত্যু বলতে ডেমিয়াগের মেমোরি
থেকে প্যারীটি প্রোগ্রামে অংশ নিতে যাওয়া লিয়েনদের নিয়ে কল করা
ফাংশন মুছে ফেলাকেই বোঝায়। বলতে গেলে নিরভানায় একক অধিপত্ত
ডেমিয়াগের। লিয়েনদের স্বাধীনতা বলতে কেবল নিচের দিকে তাকিয়ে
সিলিকনময় ধূসর নুড়ি আর পাথর দেখা, অথবা শূন্যের বুকে দৃষ্টি নিক্ষেপ
করে তারা দেখা, কখনো ধূমকেতুর জন্য অপেক্ষা করা। সুন্দরের অনুভূতি
তাদের আছে কিন্তু সুন্দরের অস্তিত্ব নিরভানায় লিয়েনদের নজরেই পরে
না।

লিয়েন কন্ট্রোল সেকশন থেকে ২০০ গজ দূরে শুয়ে আছে শুন্যের দিকে চেয়ে।
নিরভানায় আজ নিয়ে ওর কতদিন পূর্ণ হল তা সঠিক জানে না ও। অন্য
দিনের চেয়ে আজকের আকাশটা অনেক ফ্যাকাসে, তারাগুলোর কেমন
মিহিয়ে যাওয়া আলো। কিন্তু একটুও সমস্যা হল না ওর। প্রতিদিন দেখতে
দেখতে প্রায় আকাশটা মুখস্ত হয়ে গেছে ওর। নিজের দেয়া নামেও ঠিক
করা হয়ে গেছে তারাদের। যখন সে সেই নামগুলো নিয়ে তারাদের খুঁজে
বেড়াচ্ছে এমন সময় ডেমিয়াগের কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেলো। একই সাথে
লিয়েনের হাতের তালুতে রাখা রিসেপ্টরে সিগন্যাল আসলো ডেমিয়াগ
লিয়েনকে নিয়ে প্যারীটি স্টার্ট করতে যাচ্ছে। নির্দেশনা অনুযায়ী ঐ
সিলিন্ডার আকৃতির ছোট রুমটিতে প্রবেশ করে লিয়েন। আবার শোনা
যায় ডেমিয়াগের কণ্ঠ,
"প্যারীটি প্রজেক্ট নাম্বার ১২৩২৩১৩২১, লিয়েন, আপনি কি মিশনে
যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ?"

লিয়েন ডেমিয়াগের এমন কথার কোনই উদ্দেশ্য খুঁজে পায় না। ও ভালো
করেই জানে এখন ওর সময় হয়েছে। দ্বিতীয়বার যখন আবার একই
প্রশ্ন করে ডেমিয়াগ তখন ইতস্তত করে লিয়েনের উত্তর,

"হুম, প্রস্তুত।"
"আপনার কি প্রোগ্রাম শুরু করার আগে কিছু জানার আছে?"
"কি মিশনে পাঠানো হচ্ছে ? আর কোথায়ই বা পাঠানো হচ্ছে
আমাকে?"
"প্যারীটি প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য সৃষ্টিজগতের ভারসাম্য রক্ষা করা। এমন
মিশনেই প্রত্যেককে পাঠানো হয়। আর আপানার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর
ক্লাসিফাইড। তবে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ
দায়িত্ব দিয়ে আপনাকে মিশনে পাঠানো হচ্ছে।"

আর কিছু জানতে চায় না লিয়েন। অন্তত একঘেয়ে , বিরক্তিকর সময়
কাটানোর চেয়ে নতুন কিছুতেই আগ্রহ অনুভব করে।

রুমটিতে সরঞ্জামাদির খুব বেশি আড়ম্বর নেই। মাঝের উঁচু করা বেডটি
কেবল চোখে পরার মতো যার নিচ থেকে অনেকগুলো মোটা ক্যাবল বের
হয়েছে। ক্যাবলগুলোর সংযোগ যে অন্য কোথাও হতে দেয়া হয় তা বুঝতে
আর বাকি রইলো না লিয়েনের। নির্দেশ মতো লিয়েন বেডে গিয়ে শুয়ে
পরল, ডেমিয়াগের নির্দেশ অনুযায়ী ধ্যান-ধারণাকে শিথিল করার
যথাসম্ভব চেষ্টা করলো।

"প্যারীটি প্রজেক্ট, ১২৩২৩১৩২১, রেডি টু ফাংশন।"

ডেমিয়াগের কণ্ঠ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই শক্ত ক্লিপারের সাহায্যে আটকে
ফেলা হল লিয়েনকে। তারপর দুইপাশ থেকে দুই ইঞ্চি পুরু আলুমিনিয়ামের
শিল্ড দিয়ে বক্সের মতো করে ঢেকে ফেলা হল। প্রায় সাথে সাথেই ঘন তীব্র
শীতল তরল দিয়ে কানায় কানায় ভরে গেলো অ্যালুমিনিয়াম বাক্সটি।
লিয়েন কিছু ভাবতে পারছে না। ওর সমগ্র চেতনা যেন কোটি কোটি ভাগে
বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে, ঘন তরলটি যেন শুষে নিচ্ছে ওকে। লিয়েন তার মতোই
আরও কোটি কোটি লিয়েনকে দেখতে পাচ্ছে,শুনতে পাচ্ছে তাদের
কোলাহলের ধ্বনি। ওর চেতনায় একের পর এক আছড়ে পরতে থাকে নতুন
সব বস্তু যা আগে কখনো দেখেনি ও। সুন্দর আর অসুন্দরের তীব্র অনুভূতির
সাথে অনুভব করে নতুন একটি অনুভূতি। লিয়েনের কাছে মনে হয় ডেমিয়াগ
হয়তো ওকে টার্মিনেট করতে যাচ্ছে। এরপর আর কিছু ভাবতে পারেনা লিয়েন।
অ্যালুমিনিয়াম বাক্সটি থেকে এতক্ষণ যে ঠাণ্ডা বাষ্প বের হচ্ছিলো তা হঠাৎ
করে যেন থেমে যায়।





অনেক রাত করে ঘুমাতে যাওয়া জনির অগোছালো রুটিনের অংশ হয়ে
দাঁড়িয়েছে। সাত সকালেই যদি সূর্য তার গরিমার কথা জানান দেয়ার জন্য
বেঁছে নেয় পৃথিবী আর জনির মুখ সেটাকে ও সহজে মেনে নিতে পারেনা।
সূর্যকে এক চোট দেখে নেয়ার জন্য অনেক কিছুই করেছে ও। জানালার
পাশে গাছ লাগিয়েছে , রুমের জানালাও রেখেছে মাত্র একটি। জনির
রুমটিতে সচরাচর প্রবেশের অধিকার নেই কারো। তবে সাহেলা বেগম
মাঝে মাঝে একমাত্র ছেলের রুমটি গুছিয়ে দেয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু
বারবারই জিজ্ঞেস করে ওকে এই ছোট বদ্ধ রুমে কীভাবে থাকে ও ?
কম্পিউটারসহ টেবিল,জানালা থেকে যত দূরে রাখা যায় এমন স্থানে একটি
খাট আর এখানে সেখানে পরে থাকা কিছু বইপত্র। সব অগোছালো হলেও
একটি ভালো অভ্যাস আছে ওর, লেখালেখি করা। তাই ওর ডায়েরি খুব
যত্নসহকারেই রাখে ও। ও বিশ্বাস করে আধ্যাত্মিকতায়, সৃষ্টিকর্তা এবং
বিজ্ঞানকে একসাথে। বিশ্বাস করলেও সৃষ্টিকর্তাকে মানতে চায়না ও। তবুও
ডায়রির প্রতিটি পাতায় থাকে এই তিনটিকে একত্র করার নানাবিধ চিন্তা।

জানলার পাশে কিছু পাখির ক্লান্তিহীন কোলাহলে ঘুম ভেঙ্গে মেজাজটা
সকালেই আজ খিটখিটে হয়ে ছিল। চা চেয়ে ডায়রির কিছু পাতা
উলটাচ্ছিল ও। দরজায় আস্তে কড়া পড়ল। দরজা খোলার পর চায়ের
কাপ হাতে নাতাশাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্তি যেন পেলো নতুন মাত্রা ।
নাতাশা জনির ফুফাতো বোন। বয়সে জনির থেকে তিন বছরের ছোট।
আগে গ্রামে থাকতো। অনার্স শেষ করার জন্য এক বছর ধরে মামার বাসায়।
অসামাজিক হউয়ায় জনি কোন ধরনের কারণ ছাড়াই নাতাশাকে সহ্য
করতে পারেনা। নাতাশা যথেষ্ট সুন্দরী, ব্যাবহারেও অনেক মার্জিত। এক
কথায় বলতে গেলে লক্ষি টাইপের মেয়ে। জনি যথেষ্ট এক্সপ্রেশন দিয়েই
বোঝানোর চেষ্টা করলো ঠিক এই মুহূর্তে ও নাতাশাকে সহ্য করতে পারছে না।

নাতাশার উপস্থিতি ওকে কেমন যেন বিভ্রান্ত করে দেয়, ও সেটা চায়না।
আবেগের কোন ধার ধারতে চায়না ও, চায়না কোন অনুভূতি যেগুলো ওর
বীভৎস সব এক্সপেরিমেন্টের পথে বাঁধা হয়ে দাড়ায়, নিজের মাঝে মানবীয়
নয়, চায় দানবীয় চরিত্রের প্রকাশ। অনেক চেষ্টার পর নাতাশার ব্যাপারে
সিদ্ধান্তে আসে ও যেখানে আবেগের স্থান নেই, আছে শুধু বর্বরতা।
মনের খুচখুচানি চায় যথাসম্ভব দূর করতে, কিন্তু তবুও খানিকটা আঠার
মতো জড়িয়ে থাকে জনিকে। ভালোবাসার আবেগকে ও মন থেকে দূর করে
দিতে চায়,বিকল্প হিসেবে কেবলই অপেক্ষা করে কোন শয়তানি সুযোগের।
সুযোগ এদ্দিনে পালে হাওয়াও দিয়ে যায়, নাতাশা তখন ডাঙায় তোলা মাছের
মতো তড়পাচ্ছিল ।  ব্যাপারটা ভাবতেই শিহরিত হয়ে উঠে জনি।

জনির এমন আচরণে ইদানীংকালে খুব একটা কষ্ট পায় না নাতাশা, অভ্যাস হয়ে
গেছে। শুরুর দিকে অনেক খারাপ লাগতো, ইচ্ছা করত জনিকে বলতে ক্যান
তার সাথে এমন ব্যাবহার করে সে। কিন্তু এখন আর এমনটা মনে হয় না।
নিজেকে গুটিয়েই রাখে জনির কাছ থেকে। এমনিতে মামা, মামির কোন
আচরণে ও আজ পর্যন্ত কষ্ট পায়নি। এতদিনে নাতাশা ঠিক বুঝতে পেরেছে
জনিকে। কেবল অদ্ভুত বললে ভুল হবে, নাতাশার কাছে মাঝে মাঝে মানসিক
রোগী বলে মনে হয়। জনির একাকীত্ব, হেঁয়ালি আচরণ সব মিলিয়ে এখন ওর
প্রতি আর কোন ক্ষোভ নেই নাতাশার। বরঞ্চ সেখানে অনেকটাই সমবেদনার
জন্ম নিয়েছে। হয়তো জনিকেই ও ভালবাসতে পারতো। কিন্তু এখন আর সেটা
সম্ভব নয়। মোটামুটি চার মাসের পরিচয়ে বলতে গেলে ও জড়িয়ে পড়েছে
ব্যাচম্যাট তিয়েনের সাথে গভীর প্রণয়ে। জনিকে জানানো হয়নি ব্যাপারটা
কখনো, সেই উপায়ও নেই। জনির সামনে নিজেকে নাতাশা শত আলোকের
ভিড়ে সদ্য নিভে যাওয়া প্রদীপ মনে করে। কেবল ধোঁয়ার আস্তরণ বুলিয়ে
দেয় ও সেই আলোতে। জনির অপমান, অবহেলার প্রতিবাদ করতে যায়না
কখনো। নীরবে মেনে নেয়ার এই ব্যাপারটা অন্তত ওকে মুক্তি দেয়। প্রথমে
যখন ও এসেছিলো এই বাড়িতে একদিন ভুলক্রমে জনির রুমে ঢুকে পড়েছিল,
মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে একটা কাগজের টুকরা নেড়ে দেখছিল। জনি
সেদিন ওর সাথে যা করেছিলো তা ও আজও ভুলতে পারেনি। সেদিনের কথা
আজ দুঃস্বপ্নের মতো লাগে নাতাশার, নিজেকে বোঝাতে পারেনা এমন কীভাবে
হতে পারলো জনি। ভালোবাসার শীতল অনুভূতিকে উপেক্ষা করে জনি
কেবল দেহের তাপে নিজেকে শান্ত করতে চেয়েছে, দুটোকে পরিপূরক করার
প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। যদিও পরবর্তীতে এমনটি দ্বিতীয়বার হয়নি,
জনি দূরেই রাখতে চেয়েছে ওকে। । নাতাশা সেদিন বুঝতে পারেনি ঐ
কাগজটাতে ঠিক কি লেখা ছিল। লেখাটা ছিল অনেকটা এরকম ,

"খারাপ খুব একটা নেগেটিভ কিছু নয়। পজিটিভের পাল্লাকে ছিরে যাওয়ার
হাত থেকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র নেগেটিভ। সৃষ্টিজগত এই নীতিই মেনে
চলে। ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে প্রকৃতি কঠোর হতেও পিছপা হয়না। সামঞ্জস্য
সৃষ্টির অলংকার। সৃষ্টির দাঁড়িপাল্লায় দুপাশে একই পরিমাণ পজিটিভ ও
নেগেটিভ আছে। এই দুইয়ের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা যতই চলুক , দাঁড়িপাল্লাটি
তার অবস্থান থেকে এক চুলও এদিক ওদিক সরবে না। এর ব্যাতিক্রমে আসীন
একমাত্র ঈশ্বরই হতে পারেন। আমি ঈশ্বরের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চাই না।
বরঞ্চ আমি তাকে দেখিয়ে দিতে চাই যে আমি খারাপ হতে পারি কিন্তু আমার
দরকার একটা ভালো মানুষের সমতুল্য তার কাছে। জীবন নামের এই নাটকটা
একটা ধোঁকা মাত্র, মাঝে মাঝে আমি এর শেষ দেখতে পাই। আমি জানি একটা
ধুলিকণার মতোই মূল্য আমাদের, চেতনাকে কিছু হাড় আর মাংসপিণ্ডের মাঝে
গুজে দিয়ে ঈশ্বর যেটা করছে তা প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই হতে পারেনা।"

উদ্ভট সব চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ জনির ডায়রির প্রতিটি পাতা। সেখানে কিছু
লেখায় সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্য থাকলেও সে নিজেকে মানাতে পারেনা তার
অস্তিত্ব নিয়ে। প্রকৃতি নিয়েও আছে হাজারো প্রশ্ন যার উত্তর দিতে গেলে স্বয়ং
প্রকৃতিও হয়তো খাবি খেয়ে যাবে। তবে ইদানীংকালে নতুন বিষয় হয়ে যোগ
হয়েছে নাতাশা। জনি বুঝতে পারেনা নাতাশার প্রতি তার অনুভূতিগুলো,
বুঝলেও নিজেকে বোঝাতে পারেনা কখনো। নিজেকে খারাপ ভাবার, প্রমাণ
করার জন্য ধ্রুব বেগে ছুটেছে সে। তাদের বাড়িতে নাতাশা আসার আগ
পর্যন্ত এতে কোন ব্যাঘাত ঘটেনি। কিন্তু এখন মাঝে মাঝে ভিন্ন এক অনুভূতি
কাজ করে। ওর তখন কেবল জোরে দম ফেলানো ছাড়া আর কিছু করার
নেই। বুঝতে পারে ও, অনুভূতিগুলো ওর কেমন যেন ভোঁতা ভোঁতা, বিশাল
শৃঙ্গের বদলে যেন সমভূমি, সহজেই মাড়িয়ে যায় অনুভূতিগুলো। ছোট থাকতে
বাবা-মাকে কাছে পায়নি, কলেজ থেকে দুবার অন্য ছাত্রদের প্রতি উগ্র
আচরণের জন্য বহিষ্কৃত হয়েছে। ফের আবার তাকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেয়ার
সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারেনি ওর বাবা। জনিকে ব্যাখ্যা করার জন্য, ওর
পরিচয় পাবার জন্য দুই-একটি ঘটনা মোটেও যথেষ্ট নয়। ওকে বোঝা তখনই
সম্ভব হতে পারে যদি ওর পুরো টাইমলাইন ধরে আগানো যায়। কিছু আচরণে
ওকে মনে হতে পারে উন্মাদ, আবার কখনো দেখা যায় জীবনের প্রতি অনীহা ,
সৃষ্টিকর্তার প্রতি ক্ষিপ্ত। ওর ডায়রির পাতায় থাকে নতুন সব এক্সপেরিমেন্টের
নকশা, নিজের আবিষ্কৃত মতবাদ, রক্তের স্রোত দ্রুত লয়ে বয়ে চলে সেগুলোকে
বাস্তবে রুপ দেয়ার জন্য।

জনির সাথে তিয়েনের দেখা হয়েছে, কথাও হয়েছে দুই একবার। ইদানীং মাঝে
মাঝেই ওকে নাতাশার সাথে আসতে দেখা যায়। জনির কাছে এটা আদৌ গুরুত্ব
পূর্ণ ব্যাপার না। ওর কাছে গুরুত্ব আছে ওর প্ল্যানের, যা এখন পর্যন্ত অসমাপ্ত
ছিল। তিয়েনকে পেয়ে উলটো তাই জনির ভালোই লাগে। তবে সেটা শুধুমাত্র
এক্সপেরিমেন্টের খাতিরে, হাতের নাগালে সহজলভ্য গিনিপিগ পেয়ে যাওয়ার
সুবাদে। সময় এগিয়ে থাকতে চায় ঠিক, কিন্তু জনির চিন্তায় তার আশু প্রভাবই
পরে, সময়ের তালে নকশা আরো ধারালো হয়, তিয়েন হয়ে উঠে হিংস্র হায়েনার
টার্গেট। জনি শুনতে পায় সেই হায়েনারই বীভৎস হাসি, যে তার শিশু অবস্থা
থেকে যৌবনে পাড়ি দিতে চলেছে যার সোপান তৈরি করে দিয়েছে নাতাশা
তিয়েনকে ওদের বাড়িতে সহজলভ্য করে দিয়ে। ক্ষুদ্র ধন্যবাদের ধার ধারেনা
জনি, এটাকে নিজের চরিত্রের অন্তরায় ভাবে। নাতাশা , তিয়েন কেউ কিছুই
বুঝতে পারেনা । কিন্তু ভরে উঠতে থাকে জনির ডায়েরীর পাতা , "টার্মিনেট"
টাইটেলের ভেতর জমতে থাকে তিয়েনকে নিয়ে একটার পর একটা নতুন
প্ল্যান। কিন্তু সবশেষে একটিই প্ল্যান অবশিষ্ট থাকে যাকে কেন্দ্র করে
এক্সপেরিমেন্টের দিনক্ষণ, স্থান ঠিক করে ফেলে জনি, "১৩ নভেম্বর সন্ধ্যা
৭.০০ টা।





ডেমিয়াগের আধিপত্য সব গ্রহের প্রতি, সব সৃষ্টির প্রতি। ঈশ্বরই কি
ডেমিয়াগের অধীন না ঈশ্বরই ডেমিয়াগকে একাগ্র ক্ষমতার অধিকারী
করেছে তা অন্য গ্রহে তো দূরের কথা ,জানতে পারেনা অ্যান্ড্রোমিডার
কেউ। ডেমিয়াগ লিয়েন ফাংশনের মধ্যে যোগ করে দেয় নতুন একটি
প্যারামিটার যাকে নিয়ে প্যারীটি শুরু হয়েছিলো ২৬ বছর আগে।
এর পরের স্টেপ হিসেবে হিসেবে শুধু বাকি থাকে লিয়েনকে মুছে ফেলা।
ডেমিয়াগের প্যারীটি প্রজেক্ট সফল হতে বাধ্য, কারণ এর নিয়ন্ত্রণ কোন
বৈজ্ঞানিকের হাতে নয়। বরং এমন কারো কাছে যাকে কেউ ভাবনায়
আনতে পারেনা। সে হতে পারে ঈশ্বর অথবা অন্য কোন শক্তি !! কে
নিশ্চিতভাবে বলতে পারে ? হয়তো সবকিছুই হতে পারে রেকর্ড করা
কোন ভিডিওটেপ যার ডাইমেনশন চারের থেকেও বেশি মাত্রার। হাজার
অনিশ্চয়তার ভিড়ে একমাত্র নিশ্চিত কে হতে পারে ???

জনি তিয়েনকে নিয়ে আজ সন্ধায় নৌকাভ্রমণে বের হয়েছে, নাতাশা এর
কিচ্ছু জানে না। জানলে হয়তো তিয়েনকে আগেই সাবধান করে রাখত।
কিন্তু জনির সাথে পরিচয়ে তিয়েন কোন অস্বাভাবিকতা টের পায়নি, বরং
জনির সাহচর্যে অনেক ভালোই সময় কাটিয়েছে। জনিও বৃহৎ উদ্দেশ্য
হাসিলের বিনিময়ে অভিনয় করেছে ততটা সুন্দরভাবে যেটুকু না করলে
হয়তো  তিয়েনের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারতো না। কিন্তু
সবকিছুর পরেও আজ নিজেকে অনেক স্পেশাল ভাবছে ও। কারণ আজ
১৩ নভেম্বর,ওর জন্মদিন। ২৬ বছরের জীবনের সবথেকে বড় এক্সপেরিমেন্ট
সফল হতে যাচ্ছে। কুমীরের চোয়ালে যে তিয়েন ঠ্যাঙ দিয়ে বসে আছে তা
ওর  কল্পনাতেও নেই। নৌকার বৈঠা পানিকে আন্দোলিত করছে ঠিক, কিন্তু তা
জনির গুপ্ত উত্তেজনার পাশে ঘেষতে পারছে না। ৭ টা বাজতে বাকি আর ৫০
সেকেন্ড।

ডেমিয়াগের মেমোরিতে এখন আর প্যারীটি লিয়েন নামের কোন ফাংশন
চলমান নেই, তার পাশে লেখা কমপ্লিটেড। সেখান থেকে "রনি" নামের
নতুন এক রিবাওউন্ড ফাংশন স্টার্ট হতে যাচ্ছে , এতদিন এটি রানিং ছিল।
কিন্তু এখন এর উদ্দেশ্য ঠিক হয়ে গেছে। বাকি সব ঠিক আগের মতোই ।
শোনা যায় ডেমিয়াগের কর্কশ কণ্ঠ,
"প্যারীটি প্রজেক্ট, ২১৩২৩১৩২১১২৩, রেডি টু ফাংশন"।

নৌকাটি জনিকে নিয়ে যখন তীরে ফিরে সময় তখন ৮ টার কাছাকাছি।
জনির চোখে মুখে স্পষ্টই ফুটে আছে হিংস্র সেই হায়েনার প্রশান্তির হাসি,
শুধুমাত্র দেখার মতো কেউ নেই। এখন ওর একমাত্র যে কাজটা করা বাকি
তাহলো ওর ডায়রির "টার্মিনেট" টাইটেলটিকে কেটে দেয়া অথবা এই
সেকশনের সবগুলি পাতা পুড়িয়ে ফেলা। সব প্ল্যানমতোই যেখানে হয়েছে
এইটুকু করতে আর কত ক্ষুদ্রই না বেগ পেতে হতে পারে, চিন্তা করতেই
হাসি পায় জনির। নিজের মনে হাসতে হাসতেই লোকালয়ের দিকে এগুতে
থাকে ও।

No comments:

Post a Comment