আসিফ হালিম দীপন
আইপিই ২/২
২০০৭ সালে MIT-র গবেষকদের একটা দল বিদ্যুৎ উৎস থেকে সাত মিটার দূরে তারহীনভাবে বিদ্যুৎ সঞ্চারণ করতে সক্ষম হয়। সারা বিশ্বে হৈচৈ পড়ে যায় এ নিয়ে। কতো সম্ভাবনার কথা আসতে থাকে চারদিক থেকে, কতো অভিবাদন। অত্যাধুনিক এবং সূক্ষ্ম সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে আর সুপারকম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে কতো বিশাল বিশাল হিসাবনিকাশ আর কষ্টের ফল ওই সফল পরীক্ষণ। অথচ, নিকোলা টেসলা নামের এক ‘পাগলা বিজ্ঞানী’ সেই আদ্দিকালে, ১৮৯৯ তে, ২৬ মাইল দূরের শক্তির উৎস থেকে ধূ ধূ মরুভূমির মাঝখানে রাখা ২০০ লাইট বাল্ব জ্বালিয়ে দেখিয়েছিলেন! তাও ভাঙাচোরা, পুরনো জিনিসপত্র দিয়ে তৈরি যন্ত্রপাতি দিয়ে!
আধুনিক বিজ্ঞানের বাঘা বাঘা সব বিজ্ঞানী, গবেষকদের নামের ভিড়ে ফ্লুরোসেন্ট লাইটিং, টেসলা কয়েল, ইনডাকশন মোটর, অল্টারনেটিং কারেন্ট ইলেক্ট্রিক্যাল সাপ্লাই সিস্টেমের (একটি মোটর, একটি ট্রান্সফরমার আর থ্রি-ফেইয ইলেক্ট্রিসিটির সাহায্যে) আবিষ্কর্তা টেসলার নামটা কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে। যদিও বিজ্ঞানের ইতিহাসের দিকে তাকালে এরকম চরিত্র দ্বিতীয়টি চোখে পড়বে কিনা সন্দেহ।
নিকোলা টেসলা
ক্রোয়েশিয়ার খুব সাদামাটা একটা পরিবারে জন্ম টেসলার, ১৮৫৬ সালের ১০ই জুলাই। বাবা ছিলেন স্থানীয় গির্জার যাজক। পাঁচ ভাইবোনের মাঝে তিনি ছিলেন চতুর্থ। টেসলা অস্ট্রিয়ান পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেন এবং শুরুতে বুদাপেস্টে একটা টেলিগ্রাফ কোম্পানিতে কিছুদিন কাজ করেন। মূলত, ওই সময়টাতেই টেলিফোনির ওপর আগ্রহ আর অভিজ্ঞতা হয় তাঁর। তারপর ১৮৮৪ সালে পাড়ি জমান আমেরিকায়। সেখানে থমাস আলভা এডিসনের ‘এডিসন মেশিন ওয়ার্কস’ এ কাজ করার সুযোগ পান। বছরখানেক বাদে জর্জ ওয়েস্টিংহাউস নামক এক ব্যবসায়ির বিনিয়োগে নিজেই কোম্পানি খুলে বসেন। পরবর্তীতে, অল্টারনেটিং কারেন্ট সিস্টেম নিয়ে কাজ করার সময়ও ওয়েস্টিংহাউস তাঁর নিজের নামে প্যাটেন্টের লাইসেন্স নিয়ে টেসলাকে কাজ করার সুযোগ দেন। জে.পি. মর্গান নামক আরেক ব্যবসায়ি টেসলার ওয়ার্ডেনক্লিফ টাওয়ার প্রজেক্টের সময় বেশ বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেন, কিন্তু মার্কনির রেডিও ট্রান্সমিশন প্রযুক্তি আবিষ্কারের পরে তিনি টেসলার সাথে কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
পুরো কর্মজীবনে টেসলার রয়েছে ৭০০ টির বেশি সংখ্যাক প্যাটেন্ট। পদার্থবিদ্যা, রোবটিক্স, ষ্টীম টার্বাইন ইঞ্জিনিয়ারিং আর চৌম্বকবিদ্যা নিয়ে তাঁর অসংখ্য যুগান্তকারী কাজ রয়েছে। পরীক্ষণমূলক কাজগুলোর মধ্যে ছিলো - নিউইয়র্ক এবং কলোরাডো স্প্রিংসে উচ্চ-ভোল্টেজ এবং উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন পরীক্ষণ (যার মধ্যে রেডিও আবিষ্কারের তত্ত্বীয় কাজও ছিলো); রঞ্জন-রশ্মি নিয়ে পরীক্ষণ (একবার এক ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টের এক হাত গলিয়ে ফেলেছিলেন অতিরিক্ত রঞ্জনরশ্মি প্রয়োগের ফলস্বরূপ!); নায়াগ্রা ফলসে বিশ্বের প্রথম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন; স্রেফ বিদ্যুৎ ব্যবহার করে মানবদেহের জীবাণু ধ্বংসকরণের চিন্তা; ওয়ার্ডেনক্লিফ টাওয়ার প্রজেক্ট (বিদ্যুতশক্তির আন্তঃমহাদেশীয় তারহীন সঞ্চারণ); সবচেয়ে আলোচিত আর বিতর্কিত ‘টেলিফোর্স বীম’, মানবসৃষ্ট কৃত্রিম বজ্রের ইতিহাসে দীর্ঘতম বজ্রটা ছিলো তাঁর সৃষ্টি, প্রায় ১৩০ ফুট।
লঙ আইল্যান্ডে স্থাপিত ১৮৭ ফুট উঁচু ওয়ার্ডেনক্লিফ টাওয়ার
একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী হওয়ার সুবাদে এবং প্রতিনিয়ত আশ্চর্য সব আবিষ্কারের ফল হিসেবে টেসলার খ্যাতি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর প্যাটেন্টগুলো থেকে একদিকে যেমন তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন, অন্যদিকে বিভিন্ন আজব পরীক্ষা-নিরীক্ষার পেছনে খরচও করেছেন দু’হাতে। আমেরিকার জীবনের বেশ বড় একটা অংশ তিনি কাটিয়েছেন নিউইয়র্কের হাতে গোণা কয়েকটা হোটেলে। প্যাটেন্ট থেকে পাওয়া অর্থ আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যেতে থাকে এবং একটা সময় তিনি হয়ে পড়েন দেউলিয়া। এতকিছুর পরেও টেসলা তাঁর জন্মদিনের পার্টিগুলোতে শহরের সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানাতেন এবং সেখানেই প্রতি বছর নিত্যনতুন আবিষ্কার আর চলমান কাজের (মাঝেসাঝে উদ্ভটও বটে) কথা ঘোষণা করতেন। উদ্ভট-আজব এসব কাজের সুবাদে সভ্যসমাজে “পাগলা বিজ্ঞানী” (“mad scientist”) নামে তিনি খ্যাত হয়ে গেলেন।
মজার এক চরিত্র ছিলেন এই টেসলা। জীবনটা তাঁর কেটেছে কখনও উদাসীনতায়, আবার কখনও চরম স্নায়ুযুদ্ধে। গুগলিয়েমো মার্কনির রেডিও সিস্টেম আবিষ্কারের পর ওটিস পণ্ড নামের একজন সহকর্মী ইঞ্জিনিয়ার একবার টেসলাকে ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিলেন, ‘মার্কনি দেখি তোমার ওপর দিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে গেলো হে!’ জবাবে টেসলা বলেছিলেন, ‘লোকটার উদ্দেশ্য তো খারাপ না। যা করছে করতে দাও। আমার সতেরোটা প্যাটেন্ট অন্তত ওর কাজে তো লাগছে!’
একসময়কার সহকর্মী থমাস এডিসনের সাথে জীবনের শেষ অংশটা কাটিয়েছেন জাত-শত্রুর মতো। কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না। এডিসন যেমন একদিকে প্রথম লাইট বাল্বের আবিষ্কর্তা, অপরদিকে টেসলাও কিন্তু কম যান না, তাঁর এসি পাওয়ার ট্রান্সমিশন সিস্টেমেই ওই লাইট বাল্ব জ্বলে-নেভে। দু’জনের মধ্যে এই পাওয়ার ট্রান্সমিশন সিস্টেম নিয়ে যুদ্ধ চলতেই থাকলো। অতঃপর, অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ঘটনা ঘটে গেলো; নোবেল কমিটি এদের দুজনকেই নোবেল পাওয়ার অযোগ্য ধরে নিলো।
বিজ্ঞানের ইতিহাসের অন্যান্য চরম প্রতিভাবানদের মতো টেসলারও কিছু অনন্য খাপছাড়া চোখে পড়ার মতো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিলো, যেমন- নিয়মিত নার্ভাস ব্রেকডাউন, মধ্যরাতের স্বপ্নে উল্টোপাল্টা জিনিস দেখে সকালে বৈজ্ঞানিক থিওরি দেয়া, পাখিদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা এবং প্রায়ই মঙ্গল থেকে তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গ ধরার কথা ঘোষণা। ব্যাক্তিগত জীবনে বেশ অন্তর্মুখী ছিলেন; পছন্দ করতেন গোলক বা গোলকাকৃতির যেকোনো বস্তু (যদিও শেষ বয়সে এসে গোলকাকৃতির প্রতি ভীতি সৃষ্টি হয় তাঁর)। মানুষের চুল, গয়নাগাটি, মানুষের সাথে হাত মেলানো আর তিন দিয়ে অবিভাজ্য কোনো কিছুই সহ্য করতে পারতেন না। দাবা, বিলিয়ার্ড আর তাস খেলতে ভালোবাসতেন। অদ্ভুত একটা দাবী করতেন, জীবনে নাকি কখনই দু’ঘণ্টার বেশি ঘুমাননি! টেসলা কথা বলতে পারতেন আটটি আলাদা ভাষায়, আইডেটিক বা ফটোগ্রাফিক মেমোরি বলা হতো তাঁর স্মৃতিশক্তিকে। মার্ক টোওয়াইনের খুব কাছের একজন বন্ধু ছিলেন টেসলা। বিজ্ঞান সাধনার নামে শেষমেশ আইবুড়ো হিসেবেই কাটিয়ে দিয়েছেন সারাটা জীবন।
১৯২০ এর দিকে তিনি দুম করে একদিন একটা মারণাস্ত্র তৈরির ঘোষণা দিয়ে ফেললেন। জিনিসটা একটা টাওয়ার, যেটা থেকে একটা নির্দিষ্ট দিকে প্রচণ্ড রকম উচ্চমাত্রার ভোল্টেজ পার্থক্য প্রয়োগের মাধ্যমে আয়নিত পদার্থের একটা বিশাল আকারের রশ্মি ছুঁড়ে দেয়া যায়, যেটা কিনা ২০০ মাইল দূর থেকে একটা যুদ্ধবিমানকে টুকরো টুকরো করে ফেলতে সক্ষম; জলজ্যান্ত একটা রাশিয়ান ট্যাঙ্ককে গলিয়ে ফেলতে আর চোখের পলকে শত্রুপক্ষের সৈন্যদলকে হাওয়ায় বাষ্পীভূত করে দিতে এর কোন জুড়ি নেই। ২০০ মাইলের পরেও এর কার্যক্ষমতা যে নষ্ট হয়ে যাবে তা কিন্তু না, ভূপৃষ্ঠের বক্রতার জন্যেই কেবল এটা ২০০ মাইলের পরে তেমন প্রভাব ফেলতে পারবেনা। পৃথিবীর সুপারপাওয়ারগুলো স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো, কোথায় কোথায় তারা এটা ব্যবহার করবে; সাধারণ মানুষ হয়ে পড়লো আতঙ্কিত। তবে খুশির ব্যাপার এই যে, এই জিনিস বানানোর আগেই টেসলা ১৯৪৩ সালের ৭ জানুয়ারি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, আর এই প্রজেক্টের বেশিরভাগটাই ছিলো টেসলার উর্বর মস্তিষ্কের ভেতর লিপিবদ্ধ; একেবারে নগণ্য একটা অংশ কাগজপত্রে লেখাজোকা হিসেবে ছিলো। ‘পৃথিবীর মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে’ টেসলার মৃত্যুর পর FBI তাঁর সমস্ত ল্যাবনোটস, বিভিন্ন প্রজেক্টের কাগজপত্র, প্যাটেন্টের দলিল, এমনকি তাঁর ব্যাক্তিগত ডায়রিটাও সরকারি বলে জব্দ করে।
টেসলার মৃত্যুর পরপরই তাঁর কাজগুলো হুমকির মুখে পড়ে যেতে লাগলো, ঠিক মেন্ডেলের মতো। কোথাও তাঁর কাজগুলো নিয়ে আলোচনা হয় না, লেখালেখি হয় না; অসম্ভব রকম আধুনিক এবং দূরদর্শী হওয়ার পরও ইলেক্ট্রিসিটি ট্রান্সমিশন সিস্টেমে তাঁর অল্টারনেটিং কারেন্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছিলো না। অবশেষে ৯০ এর দশকের শুরু থেকে তাঁর কাজগুলোর ওপর বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের চোখ পড়ে; ফলস্বরূপ রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ে তাঁর আবিষ্কারগুলোর কথা। ১৯৬০ সালে টেসলাকে সম্মান দেখিয়ে General Conference on Weights and Measures এ এস. আই. পদ্ধতিতে চৌম্বকক্ষেত্রের শক্তির পরিমাপের একক হিসেবে ‘টেসলা’ শব্দটি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সত্যি বলতে কি, নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা এবং কাজের মাধ্যমে পুরো দুনিয়াটাকে কাঁপিয়েছেন, আক্ষরিক এবং রুপক অর্থে, এমন মানুষ একজনই আছেন ছিলেন, নিকোলা টেসলা। এক হাতে দুনিয়াটাকে ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা ছিলো এমন মানুষ একজনই ছিলেন, তিনি নিকোলা টেসলা। শুধু এটাই তাঁকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে অমর করে রাখার জন্য যথেষ্ট।
দোস্ত ! বুঝি কম ! তবে জানলাম অনেক কিছু সল্প জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও ! আশা করি চালায়া যাবি ! ভালোইসে ! :)
ReplyDeleteটেসলার একটা পার্ট দেখসিলাম Prestige মুভি তে । হি ইজ গ্রেট
ReplyDelete