তন্ময় দাস
সিইই ১/২
আজ মতিন সাহেবের জন্য একটি বিশেষ দিন। তার হৃৎপিন্ডের ব্লক ধরা পড়ার পরে ডাক্তার তাকে ধরে বেধে অপারেশনের জন্য নিয়ে এসেছে। ডাক্তাররা তাকে বললেন যে তার গায়ে সুইয়ের খোঁচা পর্যন্ত পড়বে না। তিনি বিশ্বাস করেননি বটে কিন্তু নিরুপায় হয়ে আজ হাসপাতালে এসেছেন। অনেকক্ষন হয়ে গেছে কিন্তু ডাক্তারদের কাউকেই ছুরি কাঁচি নিয়ে আসতে দেখলেন না তিনি। মাঝে এক ডাক্তার শুধু তরল পানীয় খেতে দিয়েছে। কিছুক্ষন পর ডাক্তার এসে বললেন তার অপারেশন শেষ হয়ে গেছে। মতিন সাহেব অবাক!!!
পাঠক মতিন সাহেবের মত অবাক হলেও কিছু করার নেই। ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক কিছুই সম্ভব যা আগে ছিল কল্পনার অতীত। ন্যানো হল কোন এককের 10-9 গুন ক্ষুদ্র। ন্যানো জিনিসটা কত ছোট তা বোঝানোর জন্য উদাহরণ দেয়া যেতে পারে DNA হেলিক্স মডেলের। DNA হেলিক্স 0.5-2nm মূলত অনুর কাঠামো তথা পরমানু নিয়ন্ত্রনই অর্থাৎ অনুতে পরমানুর অবস্থান, এদের মধ্যবর্তী দুরত্ব ইত্যাদি নিয়ন্ত্রনই হল ন্যানো প্রযুক্তি। এর বিস্তার হল ১-১০০ nm আর এর প্রয়োগ একটি মাত্রায় (One Dimension) অবশ্যই থাকতে হবে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কিভাবে এল এই ন্যানো প্রযুক্তি? ১৯৫৯ সালে বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী রিচার্ড ফিনম্যান বলেন, “অনুর মাঝেই রয়েছে অনেক খালি জায়গা” এর বহু বছর পরে নোরিও টানিগুচি নামের একজন বিজ্ঞানী ১৯৭৪ সালে “ন্যানোটেকনোলজি” শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর জনপ্রিয়করণ করেন বিজ্ঞানী এরিখ ড্রেক্সলার। তার লেখা বেশ কয়েকটি বই বিজ্ঞানীদের মনোযোগ কেড়ে নিতে সক্ষম হয়। পরবতীতে নব্বইয়ের দশকের দিকে এ নিয়ে বেশ গবেষণা শুরু হয়। ন্যানো প্রযুক্তির বিশাল অবদানের কারণে ১৯৯৬ ও ২০০৭ সালে ন্যানোটেকনোলজির উপর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী এর উপর গবেষণা চলছে। এর গুরুত্ব যে কত তা বোঝানোর জন্য একটি অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান দেওয়া যেতে পারে। শুধুমাত্র গবেষণা কাজেই যুক্তরাষ্ট এই বিষয়ের উপর ৩.৭ বিলিয়ন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ১.২ বিলিয়ন ও জাপান প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এর পেছনে ব্যয় করেছে।
এখন জানা যাক, কিভাবে তৈরী হয় ন্যানো প্রযুক্তি দিয়ে তৈরী অনু। ন্যানো প্রযুক্তি দিয়ে পরমানু বিন্যস্ত করার জন্য দুই ধরনের পদ্ধতি রয়েছে:
১. টপ ডাউন ফ্যাব্রিকেশন এবং ২. বটম আপ ফ্যাব্রিকেশন
টপ ডাউন পদ্ধতিতে মূলত AFM (Atomic Force Microscope), STM (Scanning Tunneling Microscope), মলিকিউলার অ্যাসেম্বলার ব্যবহার ও লিথোগ্রাফির মাধ্যমে পরমানুগুলোকে বাহ্যত কোন রাসয়ানিক বিক্রিয়া ছাড়াই বিন্যস্ত করা হয়। এ পদ্ধতিতেই মূলত ৬০ কার্বন বিশিষ্ট ফুলারিন তৈরী করা হয়েছে। তবে এর অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাছাড়া পদ্ধতিটি বেশ ব্যায়বহুল।
অন্যদিকে বটম আপ পদ্ধতিতে মূলত রাসয়ানিক সংশ্লেষ এর মাধ্যমে পরমানুগুলো বিন্যস্ত করা হয়। “করা হয়” বললে ভুল হবে মূলত এরা নিজেরাই বিন্যস্ত হয়। তাই এ পদ্ধতিতে পরমানুর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রন পাওয়াটা বেশ কষ্টকর। তবে আশার কথা এই যে, বিজ্ঞানীরা এ সম্পর্কিত সমস্যাগুলো অনেক দ্রুত কাটিয়ে উঠেছেন। ন্যানো প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার ব্যপারে সবচেয়ে বেশী এগিয়ে রয়েছে যুক্তরাজ্য, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের লরেন্স বার্কলে ল্যাব ও UC বার্কলে ল্যাবের বিজ্ঞানীরা পরমানুর সম্বন্ধয়ে ন্যানোমোটর, গিয়ার এমনকি ন্যানো ইলেক্ট্রোমেকানিকাল রিলাক্সেশন অসিলেটর পর্যন্ত আবিস্কার করে ফেলেছেন। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা ন্যানোগিয়ার দিয়ে তৈরী ন্যানোবট্ বানানোরও আপ্রান প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। ইতি মধ্যে তারা অনেকখানি সফলও হয়েছেন। তাছাড়া বায়োলজিকাল মলিকুলার মেশিন ও সিলিকন টেকনোলজির মাধ্যমে বায়ো-মেশিনারী ন্যানোঅনু বানানোর প্রচেষ্টাও চালানো হচ্ছে।
এখন আসা যাক এর ব্যবহারের উপর। কোথায় নেই এর ব্যবহার। ৬০ কার্বন পরমানু নিয়ে তৈরী করা ফুলারিন থেকে শুরু করে ন্যানোটিউব, কার্বন ন্যানো ফাইবার অনেক কিছুই তৈরী করা সম্ভব হয়েছে এ ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে। এ ন্যানো ফাইবার দিয়ে বর্তমানে বিজ্ঞানীরা স্পেস এলিভেটর বানানোর চিন্তা ভাবনা করছেন। কারণ কার্বন ন্যানো ফাইবার ইস্পাতের চাইতে ১০০ গুন বেশি স্থিতিস্থাপক বলে এটি দিয়ে তৈরী সামগ্রী অনেক বেশি শক্তিশালী, মজবুত ও ক্ষয়রোধী হয়। ভবিষ্যতে স্পেস এলিভেটর তৈরী করা সম্ভব হলে তা একমাত্র এই ন্যানো ফাইবারের মাধ্যমেই সম্ভব।
ন্যানোফাইবার ছাড়াও বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের ন্যানোবট তৈরী করেছেন। এ ন্যানোবট দিয়ে হৃৎপিন্ডের অস্ত্রোপ্রচার থেকে শুরু করে বিভিন্ন জটিল রোগ এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত নিরাময় করা সম্ভব। ইতিমধ্যে ন্যানোবট দিয়ে বিজ্ঞানীরা কোন ধরনের অপারেশন ছাড়াই টিউমার অপসারনে সক্ষম হয়েছেন। ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে স্পেসক্রাফট অনেক হালকা ও কার্যকর করা সম্ভব হয়েছে। এর মাধ্যমে বেশ কয়েকটি কৃত্রিম উপগ্রহও তৈরী হয়েছে।
আমরা অনেকে জি.আই.জো. সিনেমাটি দেখেছি। সিনেমার গল্প হলেও বাস্তবে এর মত শক্তিশালী ও হালকা অস্ত্র বানানো সম্ভব। এর মাধ্যমে কম্পিউটারের প্রসেসরের শক্তি অনেক খানি বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। এর একটি বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। এটি সাধারণ কম্পিউটার থেকে অধিক শক্তিশালী।
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা ন্যানোটেকনোলজির মাধ্যমে সেলফ্ হিলিং কম্পাউন্ড বানাতে সক্ষম হয়েছেন। যার মাধ্যমে যে কোন যন্ত্র ক্ষতিগ্রস্থ হলেও আপনা আপনি সারিয়ে নিতে পারবে।
নিত্য ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিস পত্র যেমন বুলেটপ্র“ফ পোশাক, হালকা এবং ক্ষয়রোধী সাইকেল এমনকি উন্নতমানের সান্সক্রিমও তৈরী করা সম্ভব হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে হালকা পদার্থ অ্যারোজেল তৈরী করা সম্ভব হয়েছে এই ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমেই।
প্রকৃতির মাঝেও রয়েছে ন্যানোস্ট্রাকচার। এবপশড় নামে এক প্রকার গিরগিটি জাতীয় প্রাণীর দেয়ালে ভালভাবে আটকে থাকার ক্ষমতা তৈরী হয়েছে এই ন্যানোস্ট্রাকচার এর মাধ্যমে। এমনকি আমাদের ব্রেনের নিউরনও এই ন্যানোস্ট্রাকচারের একটি উদাহরণ।
মশাই এতক্ষণ অনেক বক্ বক্ করলাম। শেষ করব একটি পংক্তি দিয়ে-
“ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালু কণা বিন্দু বিন্দু জল
গড়ে তুলে মহাদেশ সাগর অতল”
ন্যানো প্রযুক্তি যেন এভাবেই আমাদের জন্য তৈরী করে দেবে নতুন যুগের সুচনা।
তথ্যসূত্র:
- Engine of Creation- Coming era of nanotechnology by Eric Drexler
- Wikipedia- The Free encyclopedia
ভাল । শুরুটা চমৎকার
ReplyDeleteHmm asolei khudro khudro
ReplyDelete