Tuesday, December 10, 2013

প্রাচীন এলিয়েন তত্ত্ব

প্রাচীন এলিয়েন তত্ত্ব


পৃথিবীর ন্যায় অন্য গ্রহে কেন জীবন থাকবেনা? এবং যদি মানব জাতি অন্যান্য গ্রহে ভ্রমণ করতে পারে, কেন অন্য গ্রহের জীব পৃথিবী পরিভ্রমণ করতে পারবেনা? এই শতাব্দী পুরানো প্রশ্ন থেকে সৃষ্টি হয়েছে প্রাচীন এলিয়েন (ভিনগ্রহী নভোচারী) তত্ত্ব।

“প্রাচীন নভোচারী” অথবা “প্রাচীন এলিয়েন” একটি তত্ত্ব যাতে বলা হয় যে বুদ্ধিমান আন্তঃমহাজাগতিক জীব হাজার বছর পূর্বে পৃথিবী পরিভ্রমণ করেছে এবং মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করেছিল। এই তত্ত্বদানকারীদের মতে এই যোগাযোগটি মানবিক কৃষ্টি-সংস্কৃতি, প্রযুক্তির উন্নতিসাধন এবং ধর্ম প্রভাবিত করেছিল। এই ধারনার একটি সাধারণ বিকল্প হলঃ অধিকাংশ দেব-দেবী (যদিও সব ধর্মের না) প্রকৃতপক্ষে আন্তঃমহাজাগতিক জীব, এবং প্রাচীন মানুষ  তাদের অগ্রসর প্রযুক্তিকে স্বর্গীয় অবস্থার প্রমাণ হিসেবে ভুল বুঝেছিল।

কিন্তু কিভাবে এই ধারণাটি বিকশিত হয়েছিল, এবং এটি সমর্থন করতে কি কোন প্রমাণ আছে?

তত্ত্ব-দানকারীদের যুক্তিমতে, ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রাপ্ত অনুমিত ফাঁক থেকে  প্রাচীন ভিনগ্রহী নভোচারীর পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়। এবং ঐতিহাসিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যের অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যা বা অনুপস্থিতি প্রাচীন ভিনগ্রহী নভোচারীর অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়। তারা প্রমাণস্বরূপ সেসব প্রত্নতাত্ত্বিক শিল্পকর্মকে বিবেচনা করে যেগুলোর সঙ্গে তৎকালীন ঐতিহাসিক কৃষ্টি-সংস্কৃতির প্রযুক্তিগত সক্ষমতা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় ("আউট-অফ-প্লেস আর্টিফ্যাক্ট" হিসেবে পরিচিত); এবং সেসব চিত্রকর্ম ও কিংবদন্তী কাহিনী বিবেচনা করে যেগুলো আন্তঃমহাজাগতিক যোগাযোগ অথবা প্রযুক্তি চিত্রিত বা বর্ণিত করে হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়।

বিংশ শতাব্দীর শেষোক্ত অর্ধেকে এই প্রস্তাবসমূহ লেখকবৃন্দ, যেমন এরিখ ভন ডানিকেন, জর্জীয় এ ট্সউকালস,  যেচারিআ সিৎচিন, রবার্ট কে জি টেম্প্ ল, ডেভিড ঈকে, এবং পিটার কোলসিম এর মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কিন্তু অধিকাংশ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানুষের নিকট প্রাচীন নভোচারীর অস্তিত্বের ধারনা গুরুত্বের সাথে গৃহীত হয়নি , এবং পরীক্ষামূলক গবেষণায় খুব বেশি স্থান পায়নি।

১৯৬৮তে, সুইস লেখক এরিখ ভন  ডানিকেনের বেস্ট-সেলিং বই “চ্যারিয়টস অফ দি গডস?” প্রকাশিত হয়। তাকে প্রাচীন এলিয়েন (ভিনগ্রহী নভোচারী) তত্ত্বের প্রবক্তা হিসেবে গণ্য করা হয়।

ভন ডানিকেন সহ বেশীরভাগ প্রাচীন এলিয়েন তাত্ত্বিক তাদের চিন্তাসমূহ সমর্থন করতে  দুই ধরনের প্রমাণের বিবেচনা করেন। প্রথমতো, প্রাচীন ধর্মগ্রন্থসমূহ:- যেখানে মানুষ প্রত্যক্ষ ও মিথস্ক্রিয়া করে দেবতা বা স্বর্গীয় সত্তার সঙ্গে; যারা আকাশ থেকে অবতরণ করে মহাকাশযানের ন্যায় বাহনে করে এবং যারা অসাধারণ শক্তির অধিকারী। দ্বিতীয়ত, ভৌত নিদর্শনসমূহ:- যেমন শিল্পকর্ম, উদাহারনস্বরূপ গুহাচিত্র, প্রস্তর ভাস্কর্য প্রভৃতি যেখানে চিত্রিত হয়েছে অপার্থিব প্রাণী এবং  ইংল্যান্ডের স্টোনহেঞ্জ ও মিশরের পিরামিডের মত বিস্ময়কর প্রাচীন স্থাপত্য।

আপনার কি উত্সাহ জেগে উঠেছে? তাহলে চলুন, সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত উদাহরণের কয়েকটিতে একবার দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিই।

প্রাচীন এলিয়েন(ভিনগ্রহী নভোচারী)র প্রমাণ ?

নাযকা লাইনস

প্রাচীন নাযকা লাইনস হচ্ছে দক্ষিণ পেরুর উচ্চ মরুভূমিতে অংকিত  শতশত ভূমি-চিত্র। এখানে কিছু আছে প্রাণী, পাখি এবং মানুষের ড্রয়িং, কিছু আছে জ্যামিতিক আকৃতি এবং বাকিগুলা শতশত মিটার দীর্ঘের নিছক সরলরৈখিক লাইন । তাদের প্রকাণ্ড আকৃতির কারণে চিত্রগুলো কেবল উপর থেকে যথাযথভাবে বোঝা যায়-  এবং নাযকা জনগণ, যারা ৩০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ৮০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ওই অঞ্চলে বসবাস করেছিল, উড়ন্ত যান উদ্ভাবন করেছিল বলে কোনও সম্ভাব্যতা বা প্রমাণ নেই। যেহেতু চিত্রগুলো অধিক উচ্চতা থেকে দেখার জন্যে তৈরি করা হয়েছিল, সেজন্যে  তাদেরকে প্রাচীন ভিনগ্রহী মহাশূন্যচারী তত্ত্বের সঙ্গে সংযোগ করা হয়েছে। ভন ডানিকেন (১৯৭০) বলেন যে নাযকা লাইন এবং চিত্রগুলো  কেবলমাত্র "উড়োজাহাজ থেকে নির্দেশাবলী অনুসারে" তৈরি করা হয়েছে এবং দীর্ঘতর এবং প্রশস্ততর লাইন গুলো মহাকাশযানের জন্য রানওয়ে হিসেবে ইঙ্গিত করেন।

প্রকাণ্ড প্রস্তরখণ্ডের স্থান

প্রাচীন স্মৃতিসৌধ এবং প্রকাণ্ড প্রস্তরখণ্ডের অস্তিত্ব, যেমন মিশরে গিজার পিরামিড, পেরুর মাচু-পিচু, লেবাননের বাল-বেক, ইস্টার দ্বীপের মোয়াই এবং ইংল্যান্ডের স্টোনহেঞ্জ  প্রভৃতিকে প্রাচীন ভিনগ্রহী মহাশূন্যচারী তত্ত্বের প্রমাণ বলে দাবী করা হয়। সমর্থনকারীরা দাবী করে যে, তৎকালীন মানুষের যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি-প্রকৌশল দ্বারা এই প্রস্তর কাঠামোসমূহ নির্মাণ করা সম্ভব না, এমনকি কিছু কিছুর প্রতিলিপি আজও তৈরি করা অসম্ভব। কাঠামোসমূহের পাথর-খণ্ডের আকারের বিশালতা, সেগুলো স্থাপনের কারিগরি নির্ভুলতা এবং অধিকাংশ যে অনেকটুকু দূরত্ব বহন করা হয়েছিল, তা অবশ্যই এই প্রশ্ন তৈরি করে যে কে এবং কিভাবে এগুলো তৈরি করল? এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন:- কেন এগুলো তৈরি করল?

ইস্টারদ্বীপের মোয়াই

পলিনেশিয়ান দ্বীপের বিখ্যাত মোয়াই হল প্রকাণ্ড মাথার ৮৮৭টি দৈত্যাকার মানব-মূর্তি যেগুলো দ্বীপের উপকূলরেখা প্রহরা দেয়।  মোটামুটি ৫০০ বছর পুরনো এই একক প্রস্তরখণ্ডের মূর্তিগুলি ১৩ ফুট উঁচু এবং ওজন ১৪ টন, কিন্তু কিছু আছে দ্বিগুণ উঁচু এবং অধিকতর ওজনদার। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি বা প্রকৌশল জ্ঞান ব্যতীত কিভাবে প্রাচীন মানুষ এমন অবিশ্বাস্য কাঠামো নির্মাণ এবং বহন করতে পারে? প্রাচীন এলিয়েন তাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করে যে এটি পরিভ্রমণকারী আন্তঃমহাজাগতিক জীবের কীর্তি, যারা দ্বীপে তাদের নিদর্শন রেখে গেছে।

পুমা পুঙ্কু

পুমা পুঙ্কু বলিভিয়ার উচ্চভূমিতে অবস্থিত একটি প্রস্তরখণ্ডের প্রান্তর, যেখানে সূক্ষ্মভাবে খোদাইকৃত প্রকাণ্ড প্রস্তরখণ্ডসমূহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি  ব্যতীত এত বিরাট জায়গা-জুড়ে এত নিখুঁত দক্ষতার নিদর্শন তৈরি প্রায় অসম্ভব, যা কিনা আবার ১, ০০০ বছরের চেয়েও বেশি পুরনো । প্রাচীন এলিয়েন তাত্ত্বিকদের মতে উন্নত প্রকৌশলবিদ্যা ও প্রযুক্তিসম্পন্ন আন্তঃমহাজাগতিক জীব এই স্থানটি তৈরি করেছিল অথবা যে জাতি এটি নির্মাণ করেছিল তাদেরকে নির্দেশনা দিয়েছিল ।

প্রাচীন শিল্পকর্ম এবং আর্টিফ্যাক্ট

ভন ডানিকেন দাবী করেন যে, বিশ্ব জুড়ে প্রাচীন শিল্প এবং খোদাই-শিল্প  উড়ন্ত বাহন, মানুষ নয় কিন্তু বুদ্ধিমান জীব, প্রাচীন নভোচারী প্রভৃতি চিত্রিত করে, এবং আর্টিফ্যাক্টসমূহ সংশ্লিষ্ট সময়ের চেয়ে অগ্রসর প্রযুক্তির। তিনি আরও দাবী করেন যে, ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন ঐতিহাসিক কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে শৈল্পিক সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়, যেটি সব সংস্কৃতির একটি সাধারণ উৎস ইঙ্গিত করে। ভন ডানিকেন, পালেঙ্ক এর “ক্ল্যাসিক-এরা” মায়া শাসক মহান পাকালের সমাধি থেকে উদ্ধারকৃত পাথরের শবাধারের ঢাকনার রহস্য পুনরুদ্ধার করেছেন, যা তার দাবীর স্বপক্ষের ১টি উদাহারন। তার মতে, এখানে একটি মহাকাশযানের ককপিটে একজন মহাশূন্যচারী চিত্রিত হয়েছে।

ভৌত প্রমাণস্বরূপ মিশর এবং কলাম্বিয়া-ইকুয়েডরে আবিষ্কৃত আর্টিফ্যাক্টসমূহ বিবেচনা করা যায়, যেগুলো আধুনিক বিমান এবং উড়োজাহাজের মত বলে দাবী করা যায়।

প্রাচীন ভিনগ্রহী নভোচারী অনুমানের শিল্পসম্মত সমর্থন প্যালিওলিথিক গুহা চিত্রে পাওয়া গেছে। অস্ট্রেলিয়ার ওনজিনা এবং ইতালির ভ্যাল্কেমনিকার প্রস্তর-চিত্রের সাথে বর্তমানকালের নভোচারীর সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীন এলিয়েন তত্ত্বের সমর্থকদের মতে, গম্বুজাকৃতির মাথার সাথে স্পেস-হেলমেটের সাদৃশ্য প্রমাণ করে যে আগেও মানুষ মহাশূন্যচারী দেখেছে। মধ্যযুগীয় এবং রেনেসাঁ শিল্পে ফ্লাইং-সসারের প্রতিনিধিত্ব হতে  এই অনুমানটির পক্ষে আরও বেশি সমর্থন পাওয়া যায়।

প্রাচীন ধর্মগ্রন্থসমূহ

তত্ত্ব-দানকারীরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে প্রাচীন পুরাণের উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। তাদের ধারনার ভিত্তি হচ্ছে প্রাচীন পুরাণের দেব-দেবী, যারা স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে মানবতার কল্যাণের জন্যে অবতীর্ণ হয়, প্রকৃতপক্ষে ভিনগ্রহী ভ্রমণকারীর প্রতিনিধিত্ব করে, যাদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি তাদেরকে দেবতার রূপ দেয়। তত্ত্ব-দানকারীগণ এর সাথে সাদৃশ্য স্থাপন করেন বর্তমানকালের সেসব ঘটনার, যখন কোন একক বা বিচ্ছিন্ন সংস্কৃতি পশ্চিমা প্রযুক্তির নিকট উন্মুক্ত হয়। যেমন- বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে দক্ষিণ-প্রশান্তে “কার্গো-কালট” আবিষ্কৃত হয়; এরা বিশ্বাস করত দেবতাদের প্রত্যাবর্তনের ভবিষ্যতবাণীর সত্যতাস্বরূপ বিভিন্ন পশ্চিমা জাহাজ এবং মালামাল তাদেরকে পাঠানো হয়।

যদি ভিনগ্রহী প্রাণী অতীতে পৃথিবীতে এসে থাকে, তাহলে কি তারা ভবিষ্যতেও আসতে পারে? প্রাচীন এলিয়েন (ভিনগ্রহী নভোচারী) তাত্ত্বিকদের জন্যে এর উত্তর হচ্ছে অবশ্যই, “হ্যাঁ”।

 

তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট ও হিস্টরি চ্যানেল

 


লেখক: সাবিহা তাসনীম (জেসি)।


রেজি: নং : ২০১২১২২০০৩


 বর্ষ : এম-২


বিভাগ : পদার্থবিজ্ঞান


মোবাইল নং : ০১৭৪৬১৪৯৪২৬

No comments:

Post a Comment