এরশাদ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে পড়ে। কম্পিউটার সাইন্সে পড়ার পরও সে কোন কাজেই আনন্দ খুজে পায় না। সে জীবনকে উপভোগ করতে চায়। কিন্তু জীবন তাতে সায় দেয় না। দারিদ্রতা আর অলসতা ওর সবচেয়ে বড় বাধা। বড় কিছু হবার স্বপ্ন থাকলেও সে তার আগ্রহ ধরে রাখতে পারে না। যখন দেখে তার ওই স্বপ্ন পূরণ হওয়া সম্ভব নয়, তখন সে নতুন স্বপ্ন দেখতে থাকে। কোন স্বপ্নই তার স্থায়ী থাকতে পারে না। প্রতিনিয়তই জীবনের লক্ষ্য পরিবর্তন হতে থাকে। ওর বন্ধুরা ওর আচরণে সবসময়ই হতাশ থাকে। বন্ধুদের মতে, এরশাদের মত মেধাবি খুব কমই দেখেছে, আইকিউ খুবই ভাল, চেষ্টা করলে খুব ভাল প্রোগ্রামার হতে পারবে। এরশাদ নিজেও জানে সে খুব মেধাবি। যে কোন কাজই সে শুরু করে শতভাগ উদ্যম নিয়ে। কিন্তু তার চেষ্টা থাকে সর্বোচ্চ দুই দিন কি তিন দিন, বেশি গেলে এক সপ্তাহ। এরপরই আগ্রহ শূণ্যের কোঠায়। যতই সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে এরশাদের হতাশার ডাল-পালা ততই বিস্তৃত হচ্ছে। তার কাছে দুনিয়াটাকে অন্ধকার মনে হয়। পৃথিবীর সব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য তার কাছে কৃত্রিম মনে হয়, আলো গুলো ঝাপসা মনে হয়। একসময়ের দুরন্ত , হাসিখুশি এরশাদ হতাশার অন্ধকার দূর করার জন্য নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। জীবনে প্রথম যেদিন সে বন্ধুদের সাথে নেশা করে, তখনই সে নতুন এক জগতের সন্ধান পায়। তার চিন্তা-চেতনা, মস্তিষ্কের সব কিছুই উলট-পালট করে দেয় মাদকদ্রব্য গুলো। তার সমস্ত কাল্পনিক চিন্তাধারাই বাস্তব মনে হতে থাকে। নেশার ঘোর কেটে গেলে আবার সে দেখতে পায় পৃথিবীর দুঃখ-কষ্ট, সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার চিত্র। এভাবেই কিছু দিন পর পর সে নেশাগ্রস্ত হয় । নেশার জগতটাকেই তার কাছে আলোকিত, উজ্জ্বল মনে হতে থাকে। তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে থাকে। নেশার মধ্যেই সে নিজের জন্যই একটা নতুন জগত তৈরী করে নেয়। যে জগতের অস্তিত্ত্ব শুধু তার মস্তিষ্কের কোন এক কোণেই আছে। এখানে পৃথিবীর সমস্ত অপূর্ণতাগুলোকে সে পূর্ণতা দেবার চেষ্টা করে। কাপুরুষের মত পৃথিবীর সমস্ত ব্যর্থতাকে সফল করার চেষ্টা করে।
এরশাদের এই চিন্তার জগতে যখন যে উপাদানের প্রয়োজন, সবই সে দিতে পারে। সে যেগুলো চিন্তা করে, সেগুলো সে অনুভবও করতে পারে।নেশার পর প্রতিদিনই সে অচেতন ভাবে এমন হাজার রকমের কাল্পনিক চিন্তায় নিজেকে গভীরভাবে মগ্ন রাখে। এরশাদের পৃথিবীতে লড়াই করে টিকে থাকার সমস্ত আগ্রহ লোপ পেতে থাকে। এ জগতে সে শুধু আনন্দই খুঁজে পায়, কোন দুঃখ-কষ্ট নেই। এই রাজ্যের রাজা শুধু এরশাদ নিজেই। তার কোন প্রতিপক্ষ নেই, স্বপ্ন গুলোকে বাস্তবে পরিণত করতে যুদ্ধ করতে হয় না। তার কাছে সবকিছু কেমন যেন মনে হয়। অল্পতেই সব পেয়ে যাবার আনন্দ আর তার ভাল লাগে না। বাধাহীন পথে বিতৃষ্ণা লাগতে থাকে। তাই তার চিন্তার জগতেও সে তৈরী করে নিতে চায় প্রতিপক্ষ, কিন্তু পারে না। তাই বাস্তব জীবনেই সে তার চিন্তার জগত প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। সে তার বাস্তব-অবাস্তব কল্পনা গুলো দিয়ে গেম বানাবে ভাবে, যেখানে সব ক্যারাক্টার এরশাদের ইচ্ছা মত চলবে, এখানের বিজ্ঞান হবে ওর ইচ্ছামত, ঘটবে অনেক রোমাঞ্ছকর ঘটনা। আস্তে আস্তে সে চেষ্টা করতে থাকে নেশার জীবন থেকে বের হতে। সে তার গেম তৈরীর কাজে মন দিতে থাকে। সে তার কল্পিত জগতটাকেই গেমে বাস্তব রূপ দিতে চায়।
একটা মাত্র পরমাণু। পুরো মহাবিশ্বের সৃষ্টি ই এই পরমাণু থেকে। সৃষ্টি রহস্য আসলে এই পরমাণুর মধ্যেই। এর নাম লুসিকা। মহাবিশ্বের সমস্ত শক্তি ই এই লুসিকার মধ্যে পুঞ্জীভূত। লুসিকার কেন্দ্রে প্রোটন ও নিউট্রন আছে। বাইরে ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রন ছাড়াও আরও অনেক ধরনের কণা আছে। এই লুসিকারর একপ্রান্তে "টাইজ্যাক" নামক অসংখ্য চার্জহীন নিরপেক্ষ কণা আছে। কণা গুলো পরস্পরের কাছাকাছি থেকে একটা ঘন অঞ্চল সৃষ্টি করে আছে। বাইরে থেকে এই ঘন অঞ্চলটা দেখতে অবতল লেন্সের মত এবং এই অঞ্চলটা অবতল লেন্সের মত কাজও করে। লুসিকার অভ্যন্তরের সব কণা গুলো থেকে আলো এই লেন্সে প্রতিসরিত হয়ে লুসিকার বাইরে বিম্ব সৃষ্টি করে। কিন্তু এটি শুধু বিম্বই না, যেন লুসিকাটির একটি বিবর্ধিত ডুপ্লিকেট কপি। নতুন এই সৃষ্টি হওয়া লুসিকার আয়তন মূল পমাণুর চেয়ে বড়। লুসিকার প্রতিটি কণার অস্তিত্বই বুঝা যায় নতুন সৃষ্ট লুসিকাতে। এই লুসিকার শেষ প্রান্তেও টাইজ্যাক কণা গুলো অবতল লেন্স তৈরী করে। এই লেন্সে দ্বিতীয় লুসিকাটি প্রতিসরিত হয়ে আরেকটি লুসিকার সৃষ্টি করে। এই লুসিকাটি আরও বৃহৎ।এখানে মূল লুসিকার অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা গুলোকে দেখা যায়। আর একেকটা ইলেকট্রনের আয়তন এতো বড় হয় যে এর ভিতরেও নতুন বিভিন্ন ধরনের কণা দেখা যায়। এভাবে লেন্সে প্রতিসরিত হয়ে হয়ে প্রতিনিয়তই আরও বিশাল বিশাল লুসিকা সৃষ্টি হতেই থাকে, এর শেষ নেই। এরশাদের কল্পিত বিশ্ব-ব্রক্ষান্ডের বৈজ্ঞানিক থিওরি গুলো আমাদের পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক থিওরির সাথে কিছুটা সাদৃশ্যপূর্ণ হলেও ওখানের মূল বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সম্পূর্ণ আলাদা। একটা, দুইটা, তিনটা......... এক হাজার, দুই হাজার...... করে আলো যত এগিয়ে যাচ্ছে ততই লুসিকার সৃষ্টি হচ্ছে ।
এরশাদ নয় শূন্য সাত (৯০৭) নাম্বার পরমাণুকে আমাদের এই মহাবিশ্বের সাথে তুলনা করে কল্পনা করে। বাস্তবের আমাদের এই মহাবিশ্বটাই যেন সেই নয় শূন্য সাত নাম্বার লুসিকা। এই মহাবিশ্বের একপাশে আছে আরও নয়শত ছয় টি লুসিকা আর আরেক পাশে অসংখ্য। মূল পরমাণুর কোন ইলেকট্রনের মধ্যকার কোন কণার ভিতরেও আরও অনেক কণা আছে, সেই কণার ভিতরের আরো কণার মধ্যের কোন একটাই আমাদের এই সৌরজগত। মূল সেই লুসিকাটি এখানে এতোটাই বৃহৎ যে এর শেষসীমা কোথায় তা এখনো পৃথিবীর মানুষ বের করতে পারে নি। পৃথিবীতে যা ঘটছে তা আসলে লক্ষ-কোটি আলোক বর্ষ আগেই আমাদের পূর্ববর্তী লুসিকা তে ঘটে গেছে। টাইজ্যাক কণার লেন্সে শুধু যে আলোই প্রতিসরিত হয় তা নয়, প্রতিসরিত হয় মানুষের আবেগ, অনুভূতি গুলোও। আমি এখন যা করছি, যা ভাবছি , যা দেখছি সবই আমার আগে আরও নয়শত ছয়বার ঘটেছে আমার মতই কারোর সঙ্গে। এই মহাবিশ্বের সব কিছুই পূর্ব ঘটিত। ৯০৬ নাম্বার লুসিকাতে যা ঘটেছে তা প্রতিসরিত হয়ে লক্ষ-কোটি আলোক বর্ষ পর আমাদের এই লুসিকাতে তাই ঘটছে। এরশাদ ভাবতে থাকে আমরা প্রযুক্তিতে এখন অনেক এগিয়ে আছি। আর আমাদের পূর্ববর্তী লুসিকা তার চেয়েও অনেক আলোক বর্ষ এগিয়ে। তাহলে না জানি তারা আরও কত আধুনিক! এখনও কি সেখানে মানব সভ্যতা টিকে আছে! আর আমাদের পরবর্তী লুসিকা গুলোতেই না জানি সভ্যতা কতটা পিছিয়ে আছে! এমন হাজারও প্রশ্ন এরশাদের মাথায় আসতে থাকে। আমরা যদি আমাদের পূর্ববর্তী ৯০৬ নাম্বার লুসিকার কর্মকান্ডের ইতিহাস জানতে পারি, তাহলেই আমাদের মহাবিশ্বের ভবিষ্যত আমরা বলতে পারব। অবতল লেন্সে প্রতিসরিত হওয়ার ফলে একটি লুসিকা থেকে আরেকটি সম্পূর্ণ উল্টিয়ে যায়, মানে একটা লুসিকার যেই প্রান্ত উপরে থাকে, পরবর্তী লুসিকায় সেই প্রান্ত উল্টে নিচে চলে যায়। পজিটিভ চার্জ গুলো নেগেটিভ হয়ে যায় আর নেগেটিভ চার্জ গুলো পজিটিভ হয়ে যায়। এর মানে আমাদের মহাবিশ্বের পুর্ববর্তী ও পরবর্তী লুসিকা বা জগতের সাইন্স সম্পূর্ণ ভিন্ন ও উল্টো। এক সাথে কয়েক হাজার লুসিকাকে যদি দেখা সম্ভব হত তাহলে মূল পরমাণুতে ঘটা কোন ঘটনা কে দেখা যেত উপর-নিচ, উপর-নিচ করে তরঙ্গাকারে প্রবাহিত হচ্ছে।
এরশাদ ভাবতে থাকে এতো বৃহৎ ভাবে সে পুরো মহাবিশ্বের গঠন কল্পনা করে ফেলতেসে। আইনস্টাইনও তো মহাবিশ্বের আপেক্ষিক তত্ত্ব এমন বৃহৎ ভাবে কল্পনা করেই সফল হয়েছিল। সে কি তাহলে আইনস্টাইনকেও ছাড়িয়ে যাবে !!!! সে যদি প্রমাণ করতে পারে যে টাইজ্যাক এর মতো কণার উপস্থিতি বিদ্যমান, তাহলে তার এই কাল্পনিকতাই বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পাবে। সে তার সমস্ত থিওরী গেমে প্রয়োগ করে। একসময় গেমটা তৈরী সম্পন্ন হয়। গেমের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সমস্যার সমাধান করা বা নতুন নতুন যুক্তি দিয়ে এরশাদের লুসিকা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা। এরশাদের গেমের নতুন এই জগতের আইডিয়া লক্ষ লক্ষ গেমারের মন জয় করে নেয়। জোতির্বিজ্ঞানিরাও ভাবতে থাকে এরশাদের তত্ত্ব কি কোন ভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব কিনা। বিগ ব্যাং হয়তো হয়েছিল এই মহাবিশ্বে (এই লুসিকায়), কিন্তু পূর্ববর্তী লুসিকায় যে হয়নি তা কিভাবে বলা যায়। নাসার বিজ্ঞানীদেরও ভাবিয়ে তুলে এই তত্ত্ব। কয়েক মাস পর নাসার বিজ্ঞানীরা তাদের স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেখতে পায় এই বিশ্ব-ব্রক্ষান্ডের ছোট্ট একটা অংশ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। মহাবিশ্বের বিভিন্ন জায়গাতেই ব্ল্যাকহোল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সেখানে বিজ্ঞানীরা ধারণা করে অত্যন্ত শক্তিশালী ব্ল্যাকহোলের অবস্থান আছে। ব্ল্যাক হোলের আকর্ষণে আশপাশের অনেক গ্রহ, গ্রহাণুপুঞ্জই বিলীন হয়ে যেতে থাকে। এভাবে আস্তে আস্তে মহাবিশ্বের এক প্রান্তের বৃহৎ অংশই বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু ব্যাপারটি জোতির্বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলে। এভাবে চলতে থাকলে সমগ্র মহা বিশ্বই এক সময় ধ্বংস হয়ে যাবে। ব্যাপারটা এরশাদকেও ভাবিয়ে তুলে।
নাসার বিজ্ঞানীরা এর কারণ অবশেষে বের করে এরশাদের লুসিকা তত্ত্ব থেকেই। বিজ্ঞানীদের মতে এরশাদ যে টাইজ্যাক কণার সমন্বয়ে অবতল লেন্সের বর্ণনা দিয়েছে, সেই টাইজ্যাক কণার মধ্যে ছোট ছোট ছিদ্রের সৃষ্টি হবার কারণেই এমনটি ঘটছে। পূর্ববর্তী লুসিকা থেকে আলো আসার সময় লেন্সে প্রতিসরিত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ওইসব ছিদ্র দিয়ে আলো প্রতিসরিত না হয়ে আসার কারণে আমরা ওই সব অন্ধকার অংশ আর দেখতে পাচ্ছি না। টাইজ্যাক কণার এই লেন্সে আরও অনেক সূক্ষ সূক্ষ ছিদ্র সৃষ্টি হবার কারণেই বিভিন্ন জায়গায় ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ত্ব অনুভূত হয়। বিজ্ঞানীরা ভাবে লেন্সের এই ছিদ্র যত বাড়তে থাকবে, মহাবিশ্ব ততই ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাবে এবং আমাদের এই পৃথিবীও ধ্বংস হয়ে যাবে। এরশাদের লুসিকা তত্ত্ব তখন অনেক বিজ্ঞানীই গ্রহণ করে নেয়। এরশাদের এই তত্ত্ব থেকে তখন অনেক বৈজ্ঞানিক থিওরী স্বীকৃতি পায়। পৃথিবীর মানুষরা এরশাদকে সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী বলে স্বীকার করে নেয়। পরের বছর এরশাদকে পদার্থ বিজ্ঞানে অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। কিন্তু এরশাদ এই পুরস্কার নিতে অপারগতা প্রকাশ করে। এরশাদের লুসিকা তত্ত্ব থেকে এখন বিশ্ব - ব্রক্ষান্ড যে ধ্বংস হবে তা অনেকটাই নিশ্চিত। এটাই এরশাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায় । এরশাদ ভাবে সে যদি তার তত্ত্ব না দিত তাহলে এই পৃথিবীর মানুষ নিশ্চিত হত না যে মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে শীঘ্রই। মানুষের মনে এখন নতুন ভীতির জন্ম নিয়েছে। সে অনুশোচনায় ভুগতে থাকে। তার আচরণে সে নিজেই হতাশ হয়ে পড়ে। মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দে ক্ষত বিক্ষত হতে থাকে। তাই এর থেকে মুক্তির জন্য আবার সে নেশাগ্রস্থ হয়। কিন্তু তাতেও তার মুক্তি মিলে না। জীবনটাকেই এখন সে সবচেয়ে বিরক্তির মনে করে। তাই সে জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটি নিতে প্রস্তুতি নেয়। এই জীবন ও জগত থেকে পরিত্রানের জন্য সে আত্নহত্যাটাকেই বেছে নেয়।
No comments:
Post a Comment