Tuesday, December 10, 2013

ইতিহাসের নামতা

পরপর দুই রাত জাগা। ক্রুপিয়ানায় চুম্বকীয় সিস্টেমের বাজে শব্দ, পৃথিবীর চেয়েও দেড় গুণ আর মঙ্গলের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশী অভিকর্ষজ ত্বরণে এমনিতেই নাজেহাল অবস্থা। নিজের পায়ের ওজন যে এত বেশী এবং এত বিচ্ছিরি এটা ক্রুপিয়ানায় না এলে আদৌ কোনোদিন গায়ে লাগত কিনা কে জানে। অনেকটা প্রয়োজনে আবার অনুরোধে ঢেকি গেলার মতো বাটে পড়ে ডিউক'দের দলকে ক্রুপিয়ানায় আসতে হয়েছে। ক্রুপিয়ানা পৃথিবীর সোলার সিস্টেমের বাইরে সবাচেয়ে কাছের বন্ধুপ্রতিম গ্রহ।

এখানকার অধিবাসীরা বেঢপ সাইজের খাটো হলেও মোটামুটি আবেগ ছাড়া ঘিলুটায় ভালো ফলন ঘটিয়েছে। পৃথিবীতেও নাকি বহু আগে চৌম্বক সভ্যতার গুঞ্জন শোনা যায়, তবে পৃথিবীকে নিয়ে এখন আর কে ভাবে। সাতশ বছর আগেও সবাই নাকি এক সাথে বসবাস করতো। তবে এখন দিন বদলেছে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা মঙ্গলে বসতি নিয়েছে আর মনস্টার শিপে সরিয়ে নিয়েছে সব সামরিক আর গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় গবেষণা। পৃথিবীতে বাস করা আর ত্রিশ বছরের মধ্যে জীবন গুটিয়ে ফেলা এখন একই কথা। তবুও সেখানে নাকি মানুষ বাস করে। আমার জন্ম মঙ্গলে আর শৈশবের পর জি-২৪ শিপে কেটেছে বলে আমি নিজে অবশ্য কখনো যাই নি তবে আর্কাইভে দেখেছি কিছু, অবশ্য আগ্রহও হয়নি তেমন একটা। সেখানকার মানুষেরা অনেকই নাকি এখনো কমপ্লিমেন্ট্রি ক্যাপসুলও পায় না, তারা এখনো সনাতন আগুনের রান্নাই শেষ ভরসা!

শুধুমাত্র চৌম্বকের ব্যবহার করে এই বিশাল ক্রুপিয়ানা গ্রহের অল্প কিছু বামন অধিবাসী যে পরিমাণ উন্নতি করে ফেলেছে তাতে এদের বুদ্ধির গিট্টু আর একটু খুলে গেলে গোটা ইউনিভার্সের পরাক্রমশালী হয়ে উঠতে খুব একটা দেরি লাগার কথা না। এখনি ওদের ১৩টা  মনস্টার শিপ রয়েছে যেখানে প্রায় কয়েকশ বছরে মাত্র ১০টা।

ক্রুপিয়ানায় আসলে কখনো আঁধার হয় না। সবসময় পরিবেশে হালকা সবুজ রঙের আভা। সন্ধায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেড্রিজ এনরোর সাথে দেখা করতে যেতে হলো। সামরিক জায়ান্ট শিপের প্রধান-কে মেড্রিজ বলা হয়। জি-২৪এর পক্ষ থেকে আমার এক বিশেষ চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে এই বামনদেশে আসা...

রুনিডা(এটা সম্ভবত এদের দুঃখ প্রকাশের সম্ভাষণ), আপনাদের কাছে আমাদেরই দেখা করতে যাওয়া উচিৎ ছিলো। কিন্তু কি আর করবো বলুন মঙ্গলের লাল আলো আমাদের ক্রুসিয়ান চোখ সহ্য করতে পারে না।
-আমরা এতে তেমন কোনো অস্বস্তি বোধ করছি না বরং আমাদেরও প্রয়োজন বটে।
কিন্তু ডিউক জি-১৩ আর জি-১৭ তো চাইছে না আমরা পৃথিবীর ক্ষমতা নিয়ে নেই।
-জি২৪ যা বলবে তাই হবে। আর পৃথিবী তো আমাদের তেমন কোনো কাজেও লাগছে না। পৃথিবীর বিনিময়ে আপনাদের ৬টা মনস্টার শিপ আমাদের বেশী দরকারী আর পৃথিবীর সবুজ আবহাওয়া আপনাদের।
সবকিছু যদি ঠিকঠাক থাকে তাহলে আগামীকাল-ই আমাদের ক্রুপ-৭ নিয়ে পৃথিবীটা সরাসরি দেখে আসতে চাই। ক্রুপ-৭ ক্রুরা পৃথিবীর আবহাওয়ার মানানসই প্রশিক্ষণ নিয়েছে। মেসন লেভেল পার হলেই তাতে বিদ্যুৎ শক্তিও ব্যবহার করতে পারবো আমরা। আমাদের জন্য পৃথিবী অনেক দরকার। ক্রুপিয়ানায় যে হারে ইনোঝড় হয় তাতে আমাদের ম্যাগ্নেটিক সিস্টেম দিয়ে চলাও সম্ভব না আবার এখানে ইলেক্ট্রিক সিস্টেমও অচল। পৃথিবী ছাড়া ক্রুপিয়ানরা বিলীন হয়ে যাবে।
-আমি?! আমি কিংবা আমার ক্রু-রা কেউই পৃথিবীতে যায়নি কখনো! এ কিভাবে সম্ভব?
এ ছাড়া সম্ভব নয় ডিউক। চাঁদ আর পৃথিবীর মাঝখানে নিয়মিত টহল দেয় জি-১৭। আপনাদের শিপ ছাড়া আমাদের ঐ বাঁধা পার হওয়া সম্ভব না। আর হাজার হলেও আপনাদের মতো হোমো সেপিয়ান্সরাই ওখানে থাকে। খুব একটা সমস্যা হবার কথা না।
-মেড্রিজ আমি ভেবে দেখি, আমাকেও তো চেইন অফ কমান্ড মেনে চলতে হয়। যদি সম্ভব হয় তো কাল আমরা অবশ্যই যাচ্ছি পৃথিবীতে।

রাস্তার হালকা সবুজ আলোর দিকে তাকিয়ে হঠাত চারিদিকটা সবুজের সয়লাব দেখার ইচ্ছে হলো। এমন কিছু তো আর না, সোলার সিস্টেমের-ই একটা প্রোডাক্ট ঐ ক্লোরোফিলের সবুজের ভান্ডার। তবে কি আজ শেকড়ের টান পড়লো?

আজও ঘুম হবেনা বোঝা গেলো। জি-২৪ সহ বাকি ৭টা মনস্টার শিপ আমাদেরকে সমর্থন দিলো। জি-১৩ তেমন কোনো ঝামেলা করবে না মনে হচ্ছে তবে জি-১৭ কোনোমতেই রাজি নয়। বোর্ড কমিটি আমাকে মেড্রিজ;জি-১৭ এর সাথে পৃথিবীতে একটা সমঝোতা আলোচনার দায়িত্ব দিলো। শেষ পর্যন্ত জি-২৪ এবং ক্রুপ-৭ প্রথম বারের মতো পৃথিবীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। হাইপার ডাইভ আমাদের মতো ক্রু-দের কাছে অপরিচিত নয় তবে আজকের গুলো যেন অদৃশ্য এক মায়ার টানে আড়ষ্ট।

জি-১৭ আমাদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা দিলনা বটে তবে সঙ্গী হলো চাঁদের পর থেকেই। আগে যেটিকে মহাকাশ স্টেশন বলা হতো সেখানে জায়ান্ট শিপ গুলো পার্ক করে ছোট ছোট ক্রু-জেটে করে আমরা এগুতে শুরু করলাম।

অবশেষে আমরা পৃথিবীতে। ল্যান্ড করা হয়েছে পাহাড় ঘেরা একটা যায়গায়। পৃথিবীতে প্রথম চোখ খুলে মনে হলো "সবুজ কখনো এত সুন্দর হতে পারে???" কেমন জানি একটা ঘোর লেগে গেলো তখন থেকে। জি-১৭ এর মেড্রিজ লিনিওর সাথে আজই প্রথম দেখা আমার। লোকটার ব্যবহার যতটা কাঠখোট্টা মতে করেছিলাম ঠিক ততটাই উল্টা! আর এদিকে আমার লাল রঙ্গে সয়ে যাওয়া চোখে সবুজের যে ঘোর লেগেছে সেটা কাটানোর জন্য ভাবলাম একটা কমপ্লিমেন্ট্রি ক্যাপসুল খাওয়া উচিৎ। বাঁধা দিলেন লিনিও-

পৃথিবীতে এসেছেন প্রথম। পৃথিবীর খাবার খাবেন না?
-কখনো এভাবে খাব ভাবিনি। তবে এসেছি যখন খেয়ে দেখা যায়। ওদিকে মেড্রিজ এনরোও ঘুরতে বেরিয়েছেন। খেয়ে দেখা যায়।

পৃথিবীর খাবার সম্পর্কে যে ভুল ধারণা ছিলো তা একদিনে চলে গেলো। জিভ আর দাঁত থাকতে এতদিন পানসে ক্যাপসুল চিবিয়েছি ভাবতেই নিজেকে অভাগা মনে হচ্ছে।
লিনিওর সাথে ছোট ককপিটের স্লাইড জেটে করে ঘুরতে বের হলাম দুই জন। মঙ্গলে এতো বড় সমুদ্র, সবুজের পাহাড় আর এত বৈচিত্র্য কখনোই দেখি নি! তবে আর্কাইভে এসব নেই কেন??? কোনো প্রশ্নেরই উত্তর মিলছে না। যতই দেখছি ততই পৃথিবীতে মুগ্ধ হচ্ছি!

ডিউক কোনো কথা বলছেন না যে? কেমন লাগছে পৃথিবী?
-মাথায় প্রশ্ন ঘুরছে শুধু! পৃথিবীর বেশিরভাগ তথ্যই আর্কাইভে নেই!
এটা ঠিক সাতশ বছর আগে পৃথিবীতে শেষ মহাযুদ্ধ হয়েছিলো তারপরই মূলত সবাই মঙ্গল আর জায়ান্ট শিপে নিজেদের নিরাপদ আস্রয় গুটিয়ে নেয়। তবে এখন আর সেই আগের অবস্থা নেই! পৃথিবী এখন নিজেই স্বয়ংসম্পুর্না! আমরা বহুবার চেষ্টা করেছি। তবে জি-১৭ এর প্রায় সবই ব্লক করা! এতোদিনেও কি আপনারা বোঝেন নি শুধু ইউনিভার্সে ক্ষমতার জন্য পৃথিবীকে বেঁচে দেয়া হচ্ছে???
-কিন্তু ক্রুপিয়ানরা ত আমাদের বন্ধু! আর পৃথিবী ছাড়া ওরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে!
মোটেও না! ওদের ইনোঝড় নিজেদেরই করা যাতে পৃথিবীর দখল আপনাদের মতো ক্ষমতা লোভীদের কাছে মাত্র ৬টা জায়ান্ট শিপের বিনিময়ে নিয়ে নেয়া যায়! আর একবার এটা হলে ওরা দু-দিক থেকে আক্রমণ করে আমাদের শেষ অস্তিত্বও রাখবে না!
-এটা কি করে সম্ভব???
বোর্ড ডিরেক্টর নিজে একজন মংগ্রেল ক্রুপিয়ান! এটা ক্রুপিয়ানদের কুল হেডেড গেম! ডিরেক্টর লিও-কে না থামাতে পারলে গোটা হিউম্যান স্পিসিসের শেষ রক্ষা হবে না! আমাদের চলাচল আর কথাবার্তা যতদূর জানি ট্র্যাক করা হচ্ছে। আমার যদি কিছু হয়েও যায় তবে আপনি হয়তো এতক্ষনে বুঝে গিয়েছেন কি করতে হবে।

মুহুর্তেই ককপিট দুটি আলাদা হয়ে গেল। দূরে একটা বিকট বিস্ফোরণ দেখা গেল। লিনিও মারা গেলেন, ডিউক গ্যাব্রিয়েলো ফ্লিন্টের কারণে সে যাত্রায় বেঁচে গেলো।

স্লাইড ককপিট গিয়ে থামলো জি-১৭ এর সদর দপ্তরে। ক্রু সুপিরিয়র ডিউকের মাথায় তখন জীবনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। জি-২৪ তখনো পুরোপুরি ব্লকড হয়নি। জায়ান্ট জি-২৪থেকে এডমিন রুট চেঞ্জ করে হেডকোয়ার্টার ছাড়া প্রত্যেকটা মনস্টারে জি-১৭ এর ড্রাফট আপ্লোড হতে থাকলো। সেই সাথে শুরু হলো নতুন এক বিপ্লব।

এর পরের ইতিহাস আমাদের সবার জানা। ক্রু সুপিরিয়র ডিউকের প্রচেষ্টা আর দক্ষতায় মানব সমাজের আবারো নতুন করে গোড়া পত্তন হলো পৃথিবীতে। শুধু শেষ পর্যন্ত জীবন দিতে হয়েছিলো ডিউককে।
কিভাবে?
না! ইতিহাস বীরদেরকে মৃত বলতে অস্বীকার করে এসেছে সেই সূচনালগ্ন থেকেই...

No comments:

Post a Comment