বর্তমান পৃথিবীতে সব কিছু ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতর হয়ে আসছে। ক্ষুদ্র বস্তু গুলো নিয়ে গবেষনার জন্য বিজ্ঞানের একটি শাখা হলো ন্যানোসায়েন্স। ন্যানোসায়েন্সের মাধ্যমে ন্যানোটেকনোলজির উতকর্ষ সাধনের চেষ্টা চলছে। ন্যানোটেকনোলজিতে গুরুত্বের সাথে বিবেচিত ২ টি কাঠামো হল ফুলারিন এবং কার্বন ন্যানোটিউব। ফুলারিন ৬০ টি কার্বন দ্বারা গঠিত ফুটবল আকৃতির যৌগ। আর কার্বন ন্যানোটিউব সিলিন্ডার আকৃতির যৌগ যা কার্বনের অতি ক্ষুদ্র একটি রুপভেদ। এটি অসংখ্য কার্বন অনু দ্বারা তৈরী যা লম্বা টিউবের ন্যায় অবস্থান করে। এদের দৈর্ঘ্য ও ব্যাসের অনুপাত হতে পারে সর্বোচ্চ ১৩২,০০০,০০০:১ পর্যন্ত। এদের অনন্য বৈশিষ্ট্য ন্যানোটেকনোলজি, ইলেক্ট্রনিক্স, অপটিকস এবং অন্যান্য ধাতব বিদ্যার জন্য মুল্যবান। ন্যানোটিউব গুলো এস পি ২ সংকরায়ন দ্বারা তৈরী, গ্রাফাইটের মত। ন্যানোটিউব সাধারনত ২ ধরনের হয়। সিঙ্গেল ওয়াল ন্যানোটিউব এবং মাল্টি ওয়াল ন্যানোটিউব।
১৯৫২ সালে রাশিয়ান বিজ্ঞানী রাডুশকেভিচ এবং লুকইয়ানোভিচ সোভিয়েত জার্নালে প্রথম ৫০ ন্যানোমিটার ব্যাস যুক্ত ফাপা কার্বন ফাইবারের কথা প্রকাশ করেন। ১৯৮৫ সালে ফুলারিন আবিষ্কৃত হয়। ১৯৯১ সালে কার্বন গুড়া মাখানো গ্রাফাইট ইলেক্ট্রোডে আর্ক ডিসচার্জ পদ্ধতিতে ফুলারিন তৈরীর সময় সর্ব প্রথম কার্বন ন্যানোটিউব পর্যবেক্ষন করেন জাপানি গবেষক সুমিও ইজিমা জাপানের এন ই সি কর্পোরেশনের রিসার্চ ল্যাবে। তার ঠিক পরের বছরই পর্যেবেক্ষন যোগ্য যথেষ্ট পরিমান ন্যানোটিউব তৈরি করেন এন ই সির ২ জন গবেষক। সেই বছরই সিঙ্গেল ওয়াল ন্যানোটিউবের তড়িত বৈশিষ্ট্য গুলোর তাত্ত্বিক অনুমান প্রকাশ করে আমেরিকার ন্যাভাল রিসার্চ একাডেমি, ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলোজি এবং এন ই সি কর্পোরেশন।
ন্যানোটিউব তৈরীর অনেক পদ্ধতি রয়েছে। প্রথম ন্যানোটিউব তৈরী হয় আর্ক ডিসচার্জ পদ্ধতিতে। এছাড়াও লেজার অপসারন, রাসায়নিক বাষ্প অপসারন ও প্লাজমা টর্চ কয়েকটি উল্ল্যেখযোগ্য পদ্ধতি। রাসায়নিক বাষ্প অপসারন পদ্ধতি দ্বারা বানিজ্যিক ভাবে ন্যানোটিউব তৈরী করা হয়। লেজার অপসারন পদ্ধতি অনেক ব্যয় বহুল। সবচেয়ে ক্ষুদ্র কার্বন ন্যানোটিউব হল জৈব যৌগ সাইক্লো প্যারাফিনাইল। ২০০৯ সালের প্রথম দিকে এটা তৈরী করা হয়। পরে একই বছর রাসায়নিক বাষ্প অপসারন পদ্ধতি দ্বারা ১৮.৫ সেন্টি মিটার লম্বা ন্যানোটিউব তৈরী করা হয় যা এখন পর্যন্ত সব চেয়ে লম্বা ন্যানোটিউব।
কার্বন ন্যানোটিউবের কাঠিন্য ও দৃঢ়তা অস্বাভাবিক বেশি। একটি ন্যানোটিউবের দৃঢ়তা ১০০ গিগা প্যাসকেলের চেয়েও বেশি হতে পারে। একটি আদর্শ সিঙ্গেল ওয়াল কার্বন ন্যানোটিউব ২৫ গিগা প্যাসকেল পর্যন্ত চাপ সহ্য করতে পারে কোনো ধরনের বিকৃতি ছাড়া। মাল্টি ওয়াল ন্যানোটিউবের প্রসারনশীলতার সামর্থ্য ৬৩ গিগা প্যাসকেল পর্যন্ত। অর্থ্যাত এটি প্রায় ৬৪২২ কেজি ভার বহন করতে সক্ষম। ন্যানোটিউবের সুনির্দিষ্ট দৃঢ়তা ৪৮,০০০ কিলো নিউটন-মিটার/কেজি, যে খানে ইস্পাতের মাত্র ১৫৪ কিলো নিউটন-মিটার/কেজি। এদের কাঠিন্য ইস্পাত অপেক্ষা বেশি হওয়া সত্ত্বেও এদের বাকানোর পর আগের অবস্থানে ফিরে আসার প্রবনতা ইস্পাত অপেক্ষা বেশি। অর্থ্যাত এরা অনেক স্থিতিস্থাপক। অবাক করার বিষয় হলো, এদের কাঠিন্য, প্রসারনশীলতা ও স্থিতিস্থাপকতা এত বেশি হওয়া সত্ত্বেও এদের ঘনত্ব কিন্তু খুব ই কম। প্রায় ১.৩-১.৪ গ্রাম/সে.মি.৩ পর্যন্ত। এই সব যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারনে এদের পলিমার ম্যাট্রিক্স সংমিশ্রনে ব্যাবহার করা হয়।
ন্যানোটিউবের তড়িত পরিবাহীতা অসাধারন। গঠন ও ব্যাসের উপর নির্ভর করে এরা কখনো পরিবাহী এবং কখনো অর্ধপরিবাহী। এদের তড়িত পরিবাহীতা অনেক ধাতুর(যেমন কপার) চেয়েও বেশি। শুধু তড়িত পরিবাহীতাই নয়, এদের তাপ পরিবাহীতাও অনেক বেশি। কক্ষ তাপমাত্রায় এর অক্ষ বরাবর তাপ পরিবাহীতা প্রায় ৩৫০০ ওয়াট/মিটার-কেলভিন, যা কপারের(৩৮৫) তুলনায় বেশি। এদের তাপ পরিবাহীতা বেশি হওয়ায় উচ্চ তড়িত প্রবাহের সময় এরা ধাতুর মত ততটা উত্তপ্ত হয় না। কারন এরা তাপ অন্যত্র পরিবহন করে দেয়। এদের এই অনন্য তড়িত ও তাপীয় বৈশিষ্ট্যের কারনে কম্পিউটার ও ইন্টেগ্রেটেড সার্কিটে এদের ব্যাবহারের চেষ্টা চলছে। ন্যানোটিউব দিয়ে তৈরী প্রসেসর সিলিকন চিপের প্রসেসরের চেয়ে উচ্চ গতিসম্পন্ন হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
ন্যানোটিউব দিয়ে ট্রানজিস্টার তৈরী করা হচ্ছে। ২০১৩ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক দল কার্বন ন্যানোটিউব ভিত্তিক ট্রানজিস্টার দ্বারা একটি কম্পিউটার তৈরী করেছেন। কার্বন ন্যানোটিউব দ্বারা প্রথম তৈরীকৃত কম্পিউটারের নাম রাখা হয়েছে “সেড্রিক”। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তে তাদের গবেষনা পত্র বিখ্যাত “নেচার” জার্নালে প্রকাশিত হয়।
ন্যানোটিউবের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ন ব্যাবহার রয়েছে। রাডার, মাইক্রোওয়েভ কম্পাঙ্কে কাজ করে। এই মাইক্রোওয়েভ কম্পাঙ্ক ন্যানোটিউব শোষন করে নিতে পারে। ফলে যে কোনো উড়োজাহাজে এটা ব্যাবহার করলে তা রাডারে অদৃশ্য থাকবে। যুদ্ধের সময় শত্রু পক্ষের রাডার ফাকি দেয়ার জন্য এটি একটি ভাল উপায়। মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে স্টেলথ প্রযুক্তিতে ন্যানোটিউবের ব্যাবহার নিয়ে গবেষনা চলছে। মেডিকেল প্রযুক্তিতেও এর ব্যাবহার চলছে। কানজিনাস ক্যান্সার থেরাপিতে সিঙ্গেল ওয়াল ন্যানোটিউব ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের চারপাশে প্রবেশ করানো হয়। তারপর এদের রেডিও তরঙ্গ দ্বারা উত্তেজিত করা হয়। তখন এরা গরম হয়ে উঠে এবং আশে পাশের ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ গুলোকে ধ্বংস করে।
ন্যানোটিউবে হাইড্রোজেন জমা করে রেখে সেটা জ্বালানী হিসেবে ব্যাবহারের জন্য গবেষনা চলছে। ছোট ছোট কার্বন ন্যানোটিউব গুলোর কৈশিকতার কারনে এই গুলোর মধ্যে উচ্চ ঘনত্বের গ্যাসকে চাপের মাধ্যমে আয়তনে কমিয়ে সংরক্ষন করা সম্ভব। এই কাজের জন্য সিঙ্গেল ওয়াল ন্যানোটিউব ব্যাবহৃত হয়। হাইড্রোজেন জ্বালানী ভিত্তিক গাড়ি তে এর ব্যাবহারের চেষ্টা চলছে। এই সব গাড়িতে যে হাইড্রোজেন জ্বালানী ব্যাবহার করা হয় তা প্রথমে ঠান্ডা করে হাইড্রোজেন গ্যাসকে তরলে পরিণত করে। তারপর একে চাপের মাধ্যমে আয়তনে কমিয়ে ব্যাবহার করা হয়। কিন্তু ন্যানোটিউবে হাইড্রোজেনকে তরল করার প্রয়োজন হয় না। গ্যাসীয় অবস্থায় রেখেই একে চাপের মাধ্যমে আয়তন কমিয়ে ব্যাবহার করা যায়। ফলে প্রায় ২৫%-৪০% শক্তি অপচয় রোধ পায়। এছাড়া সোলার প্যানেলে ন্যানোটিউবের ব্যাবহার নিয়ে গবেষনা চলছে। নিউ জার্সি ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির একটি পরীক্ষায় তারা সৌর কোষে কার্বন ন্যানোটিউবের জটিল যৌগ (ন্যানোটিউব ও ফুলারিনের মিশ্রনে তৈরী সাপের ন্যায় কাঠামো) ব্যাবহার করে। সূর্যের আলো তে এদের উত্তপ্ত করা হলে তারা উত্তেজিত হয়। ফুলারিন ইলেক্ট্রন আটকে ফেলতে পারে কিন্তু তা ইলেক্ট্রনের প্রবাহ ঘটাতে পারে না। অন্য দিকে ন্যানোটিউবের তড়িত পরিবাহীতা বেশি হওয়ায় তা খুব সহজেই সৌর কোষে ইলেক্ট্রনের প্রবাহ ঘটাতে পারে। সৌর কোষে ন্যানোটিউবের ব্যাবহারের ফলে তাদের ক্ষমতা প্রায় ৮.৫% এর উপর বৃদ্ধি পেয়েছে।
ন্যানোটিউবের আরো কিছু ব্যাবহার রয়েছে। এর মাঝে উল্ল্যেখযোগ্য কিছু হলঃ পানিরোধী কাপড় তৈরীতে, যুদ্ধে ব্যাবহার উপযোগী গুলি প্রতিরোধী জ্যাকেট তৈরীতে, কংক্রীটের সাথে মিশ্রিত করে এর ক্ষমতা বৃদ্ধিতে, টাংস্টেন ফিলামেন্টের পরিবর্তে বাল্বে, ইনফ্রারেড ডিটেক্টরে এবং চৌম্বক ক্ষেত্রে। মাল্টি ওয়াল ন্যানোটিউব শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরী করতে পারে। সুপার কনডাক্টর এবং আল্ট্রা ক্যাপাসিটর তৈরী তে এদের ব্যাবহার করা হচ্ছে। ন্যানোটিউব মেমব্রেন বাতাস হতে কার্বন ডাই অক্সাইড ফিল্টার করে বায়ুকে দূষন মুক্ত করতে পারে।
বহুমুখী ব্যাবহার থাকায় ন্যানোটেকনোলজি তে কার্বন ন্যানোটিউবের গুরুত্ব অনেক। তাই বর্তমানে একে নিয়ে অনেক গবেষনা চলছে। দৃঢ়, শক্ত, স্থিতিস্থাপক, তড়িত পরিবাহীতা, তাপ পরিবাহীতা সহ নানা রকম গুন ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে এর। তাই নানা রকম জিনিস তৈরীতে একে ব্যাবহার করা হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর ব্যাবহার গবেষনাগারে সীমাবদ্ধ। তবে আশা করা যায় পূর্নাংগ গবেষনা শেষে এর পরিপূর্ণ ব্যাবহার শুরু হবে এবং এর বহুমাত্রিক ব্যাবহার আমাদের মুগ্ধ করবে।
তথ্যসূত্রঃ
1. Wikipedia, http://en.wikipedia.org/wiki/Carbon_nanotube
2. R. Saito, G. Dresselhaus and M. S. Dresselhaus, “Physical Properties of Carbon Nanotube”, Imperial college press.
3. Maser, W., Benito, A.M., Munoz, E., and Teresa Martinez, M. (2008) Carbon Nanotubes: From Fundamental Nanoscale Objects Towards Functional Nanocomposites and Applications, p. 101 Springer, Netherlands.
4. Smith, B., Monthioux, M., and Luzzi, Encapsulated C60 in carbon nanotubes, (1998) Nature, 396, 323.
5. Reich, Thomsen and Maultzsch, “Carbon Nanotubes, basic concepts and physical properties”, Wiley (2004)
ভাল লাগল
ReplyDeleteVua
ReplyDeletePerhaps You should write one. And By the way, it was selected for voting by the judges.
ReplyDelete[...] ২. কার্বন ন্যানোটিউব [...]
ReplyDelete