Wednesday, December 11, 2013

রহিম সাহেবের খুব সাধারন একদিন

১.
সফিপুর হাইস্কুলের গনিতের শিক্ষক রহিম সাহেবের পেটের ব্যাথাটা আবার বেড়েছে। এই ব্যাথাটা অন্যান্য দিনের মত না, কেমন যেন নাড়িভুড়ি মোচড় দিয়ে সব ছিড়ে আসতে চাইছে! কাঁথাটা ভালমত মুড়ি দিয়ে আর কিছুক্ষন শুয়ে থাকতে পারলে বোধকরি ব্যাথাটা চলে যেত।
রহিম সাহেব তাঁর মনের এ কুবুদ্ধিটাকে পাত্তা দিলেন না। তাঁর শরীরের কোন আর্তনাদই তাঁর কাছে তেমন একটা পাত্তা পায় না! ব্যাথাটার কথাই ধরা যাক না কেন, এই ব্যাথাটা তাঁর প্রথম উঠে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার মাঝখানে। পরদিন পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা। বেশি রাত করে পড়ালেখা করাটা কখনই তাঁর অভ্যাসের মধ্যে পরে না। কিন্তু কেন যেন সেবার তাঁর সবকিছু উলট-পালট হয়ে গিয়েছিল। রাত আটটার দিকে তিনি আবিস্কার করলেন, সবে মাত্র তিনটা অধ্যায় শেষ করেছেন তিনি! ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে পাগলের মত পড়া আরম্ভ করলেন তিনি। পড়া প্রায় গুছিয়ে এনেছেন, ঠিক সেই সময়ে তাঁর ব্যাথাটা প্রথমবারের মত উঠে। যেন কেউ একজন ছুরি দিয়ে তাঁর পেট কেটে আবার জোড়া লাগাচ্ছে! প্রায় মধ্যরাতের দিকে যখন তাঁর মা তাকে খাবার খেতে ডাকলেন, বন্ধ দরজার ওপাশে রহিম তখন ব্যাথায় মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে! উঠে গিয়ে দরজা খুলবার মত শক্তি তাঁর থাকার প্রশ্নই আসে না! ছেলের এমন দরজা না খুল্বার মতন আজব কীর্তিকলাপে মা বেশ অভ্যস্ত, তিনি খুব একটা মাথা ঘামালেন না। উঠান পেরিয়ে ঘরের দিকে এগুলেন, মেঘ গর্জন করছে আকাশে, চোখে ঘুম ঘুম ভাব! সেই পেটের ব্যাথাকে উপেক্ষা করে রহিম সাহেব ঠিকই পরীক্ষা দিয়েছিলেন। মাত্র তিন মার্কের জন্য লেটার মিস হয় তাঁর। পরীক্ষা হলের মাঝখানে ব্যাথাটা তাঁর আরেকবার উঠেছিল। পাক্কা দশ মিনিট বসে ছিলেন তিনি! সেই দশ মিনিট বসে থাকতে না হলে হয়ত আজ তাঁর জীবনের কাহিনী অন্যভাবে লেখা হত, কে জানে.....রহিম সাহেব তাঁর মাথার এসব বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলোকে জোর করে ঠেলে দূরে সরিয়ে হাতমুখ ধুতে কলের পারের দিকে এগুলেন, সফিপুর হাইস্কুলের গনিতের শিক্ষকের এমন আজগুবি চিন্তা করাটা বেমানান, পৃথিবীর সবকিছুই যুক্তি দিয়ে বুঝতে হবে, আবেগ আবার কি? ভাবতে ভাবতে টিউবওয়েলে একটা চাপ দিতেই মেজাজটা বিগড়ে গেল রহিম সাহেবের! কলে পানি উঠছে না, ফুটো দিয়ে পানি ঢালতে হবে। কেয়ারটেকার ফিরোজকে কতবার তিনি বলেছেন টিউবওয়েলটা ঠিক করাতে, ছোকরার গায়ে কোন কথাই লাগে না, একদম বাইম মাছ স্বভাবের, খালি পিছলায় বের হয়ে যায়। দাড়া!! মনে মনে ভাবলেন তিনি, এইবার শালার হাতে ছাই মেখে নামবো, দেখি তোর বাইম মাছগিরি কত দূর যায়!! কোনমতে মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়েই ছাতাটা বগলদাবা করে স্কুলের পথে রওয়ানা দিলেন তিনি। ক্লাসে পৌছাতেই তিনি দেখেন ঘড়ির কাটায় ঠিক সাতটা বেজে আটান্ন মিনিট। দিনে প্রথমবারের মত একটা ভালোলাগায় ভরে গেল  তাঁর মনটা। আজ অবধি কোনদিন ক্লাসে এক মিনিট দেরি করে ঢুকেছেন তিনি, তাঁর ঘোর নিন্দুকও এমন কথা বলতে পারবে না!!

 

 

২.
নয়নের মাথায় জোরেসরে একটা গাট্টু মারতে যাবে ফরিদ, ঠিক এমন সময়ে সময়ে চোখের কোণ দিয়ে সে দেখতে পেল রহিম স্যার ক্লাসে ঢুকছেন। সোজা হয়ে বসতে বসতে ফরিদ ভাবল, শালা বুইড়া দিল মজাটা নষ্ট কইরা!
:ওই ফরিদ, কারে বুইরা কস? কানের পাশে ফিসফিস শুনতে পেয়ে পিলে চমকে উঠল ফরিদ। এত স্যারের গলা! কিন্তু স্যার কিভাবে তাঁর মনের ভেতরের কথা শুনবে! মনে মনে আরও দুয়েকটা গালি দিতে যাবে, ঠিক এই সময়ে ঠাস করে এক চড় খেল সে। কিন্তু আসে পাশে চড় দেবার মত কেউ নাই, শুধু স্যার দরজার কাছে থেকে তাকিয়ে আছেন। ভয়ে দাতে দাঁত লাগাটা বাকি রইল ওর।

রহিম সাহেব ক্লাসে ঢুকে পেছনে তাকাতেই তাঁর মেজাজটা আবার গেল চরে। দুইটা কলম নিয়ে এমন অনর্থক খেলা খেলবার মানে তিনি বুঝেন না, নামও দিয়েছে একখান, পেন ফাইট!! কেন রে ভাই? ওই পেণ দিয়েই কি সুন্দর পিথাগোরাসের উপপাদ্যটার প্রমাণ একটু লেখা যায়, যায় না? আর এই ফরিদ ছেলেটাকে তো দেখেলেই মনে হয় দেই এক থাপ্পড়!এই ভাবতেই ফরিদের দিকে তাকালেন তিনি। ছেলেটা কেমন যেন একটু কেপে উঠে চুপ করে গেল! সেই চিন্তা বাদ দিয়ে বইটা হাতে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে আগালেন তিনি, নতুন একটা উপপাদ্য পরাবেন আজ। প্রিয় গনিত বইটাও বিরক্তিকর লাগছে কেন আজ?

3. কোনমতে প্রথম দুই পিরিয়ডের ক্লাস শেষ করে টিচার্স রুমে গিয়ে বসলেন রহিম সাহেব। একটু পরেই দরজায় উকি দিলেন বাংলার শিক্ষক আক্তার আলী। মুখ ভর্তি পানের পিক নিয়ে রহিম সাহেবের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলানো একটা হাসি দিতেই রহিম সাহেবের মেজাজটা আবার খারাপ হতে লাগল। এই লোক আবার বকবকানি শুরু করবে, যদি এর গলাটা কেউ চেপে ধরত? কিন্তু এ কি! আক্তার সাহেব এমন করছেন কেন!!
:স্যার, স্যার! কি হল স্যার? ও আক্তার স্যার! ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আক্তার আলী তাকিয়ে আছেন রহিম সাহেবের দিকে। তিনি অনুভব করছেন, কেউ একজন তাঁর গলা চেপে ধরেছে, কিন্তু ভয়ের বিষয় হল চোখে দেখা যাচ্ছে না সামনে কাউকে!!
হেডস্যারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বাসা যাবেন, ঠিক করলেন রহিম সাহেব।

৪.সেইরাতে ফরিদ তাঁর জীবনের সবচাইতে সাহসী কাজটা করল। সে জানেনা কেন, তবে মধ্যরাতে সে রহিম স্যারের বাসার দিকে রওয়ানা দিল। গ্রামের এক কোণে মোটামুটি ভুতুড়ে এক পোড়োবাড়ি। আজ সাড়া রাস্তায় নেই কোন কুকুর কিংবা ঝিঝি পোকার ডাক, কেন কে জানে! বাড়ির ভেতর থেকে কেমন একটা অদ্ভুত সাদাভ আলো আসছে। সাথে চাপা গোঙানির আওয়াজ, উঠানে চাপকলে কেউ না থাকলেও সেখান থেকে অনবরত পানি পরেই যাচ্ছে!
:স্যার, ও স্যার। বাড়িত আছেন?
দরজা ধাক্কা দিতেই প্রচণ্ড আলোতে চোখ ঝলসে গেল ফরিদের। অবাক বিস্ময়ে সে রহিম স্যারকে আবিস্কার করল ঘরের চালের খুব কাছে!! উড়ন্ত অবস্থায়, মুখে একটা রহস্যময় হাসি!! প্রচণ্ড মানসিক ধাক্কায় জ্ঞান হারাল ফরিদ।

৫.
প্রতিরাতে ঘরে ফিরে দুটো চাল ফুটিয়ে খাবার অভ্যাস রহিম সাহেবের। আজ খিদে নেই, তাই রুটিনের ব্যাতয় ঘটল। দিনে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনাগুলো নিয়ে তিনি বড্ড চিন্তিত। প্রথমে ফরিদ, এর পরে আক্তার স্যার। বিকালে বাড়ি এসে পানি খেতে চাইলেন, চাপকলে অনবরত পানি পরে জেতে লাগল!! আজ যেন তাঁর ইচ্ছাপুরনের দিন। ভাবতে ভাবতে বিছানার দিকে এগুলেন তিনি. ঘরের বাতি নেভানো হয় নি। মনে হল, যদি উরে গিয়ে বাতিটা বন্ধ করা যেত! মুহূর্ত পরেই তিনি তিনি নিচে তাকিয়ে দেখতে পেলেন তিনি শূন্যে ভাসছেন! ঠিক এই মুহূর্তে তাঁর ব্যাথাটা শুরু হল। তীব্র ব্যাথায় জ্ঞান হারাবার পূর্বে তিনি চোখের কোন দিয়ে দেখতে পেলেন ফরিদকে। ফরিদ!!! ও এইখানে কি করছে? জ্ঞান হারাবার পূর্বে এই ছিল তাঁর শেষ চিন্তা!

৬.
ঘরের ভেতর আবছা নীলাভ একটা আলো। চোখ খুলতেই রহিম সাহেব দেখতে পেলেন পাতলা পলিথিনের মত কিছু একটা দিয়ে মোড়ানো তিনি, চিৎ হয়ে সুয়ে আছেন। ঘরজুড়ে কেমন একটা তীব্র গন্ধ। কোথায় তিনি? তিনি কি মারা গেলেন? মরবার পরে কি তাহলে এরকম?
: না, আপনি মরেন নি, এটা মৃত্যু পরবর্তী কিছু নয়।
চমকে উঠে এদিক ওদিক তাকালেন রহিম সাহেব।
:রহিম সাহেব, বৃথা চেষ্টা করবেন না, আমাদেরকে আপনি দেখতে পারবেন না!
:আপনারা... কে আপনারা?
:আমরা ক্রি, টি-৬ গ্রহের বাসিন্দা বলতে পারেন। পৃথিবী থেকে ৬ ট্রিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে আপনি।
কি সব উল্টা পাল্টা ভাবছি, আমার হ্যালুসেলিশন নাকি?
:না! এটা বাস্তব, হ্যালুসিলেশন না। হ্যাঁ, আমরা আপনার মনের কথা জানতে পারি।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রহিম সাহেব প্রশ্ন করে বসলেন, :আপনাদের দেখা যায় না কেন?
: পৃথিবীর মানুষ ত্রিমাত্রিক। আমরা বহুমাত্রিক, আমাদেরকে আপনি কোনোভাবেই দেখতে পারবেন না রহিম সাহেব।
:ও, আচ্ছা! আপন মনেই মাথা ঝাকালেন রহিম সাহেব। তাহলে... তাহলে... আপনি কই?
: আমি? আমরা? হাহ হা! বলতে পারেন আমরা সবখানে, আপনার শ্বাস নেবার বাতাস হতে আপনার লোমকূপ, সবখানেই আমরা আছি!
: কিন্তু... কিন্তু, আমি এখানে কেন?
: আমরা কয়েকশত বছরে পৃথিবীর মানুষের সাথে যোগাযোগ করবার চেষ্টা করি। সবচাইতে বুদ্ধিমান মানুষগুলোকে বেছে নেই আমরা। কিন্তু আমাদের সাথে পৃথিবীর সবচাইতে বুদ্ধিমান মানুষও যোগাযোগ করতে পারে না। মাঝে মধ্যেই তারা অপ্রকিতস্থ হয়ে পরে। আপনিই যেমন ভুগেছেন পেটের ব্যাথায়!!
:কিন্তু, আমাদের সাথে যোগাযোগের কি দরকার?
:আমাদের টি-সিক্স গ্রহের আছে কয়েকশত ট্রিলিয়ন বছরের অভিজ্ঞতা, তবে সময়ের সাথে সবকিছুই ধ্বংস হতে হয়, আমাদের আয়ু আছে খুব বেশি হলে আর হাজার খানেক বছর। কিন্তু আমাদের এত জ্ঞান বিজ্ঞান কি আমাদের সাথেই হারিয়ে যাবে? তা কি হতে দেয়া যায়? আবার সঠিক হাতে না পরলে, এই জ্ঞান হয়ে উঠবে ভয়ংকর! অনেক গ্যালাক্সি ঘুরে আমাদের মনে হয়েছে পৃথিবীর মানুষই পারে আমাদের এই জ্ঞানকে ব্যাবহার করতে। তবে তারা এখনো প্রস্তুত নয় এজন্য, হয়ত আর কয়েক বিলিওন বছর পরে! তাই আমরা পৃথিবীর কোটি কোটি বুদ্ধিমান মানুষদের মাঝে আমাদের জ্ঞান ছরিয়ে দিচ্ছি। এ জ্ঞান শত কোটি মস্তিষ্কে জমা থাকবে। রহিম সাহেব!
: জি!
: আপনার ঘুমানোর সময় হয়েছে, আগামি কয়েক কোটি বছর আপনি ঘুমাবেন। এরপরে যখন দরকার হবে আপনাদের সবাইকে জাগিয়ে তোলা হবে, তখন সবাই মিলে জ্ঞানকে আরও বাড়াবেন। কি পারবেন না?
: জি, পারব। বলতেই গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পরলেন রহিম সাহেব।

৭.
প্রচণ্ড পেটের ব্যাথায় জ্ঞান ফিরল ফরিদের। এই ব্যাথার মধ্যেই সে নিজেকে দেখতে পেল রহিম স্যার এর বাসায়। এইখানে সে কখন আসল? কিভাবে আসল? কি জানি!! স্যার দেখবার আগে আগেই কেটে পড়া উচিত। প্রচণ্ড পেটের ব্যাথা নিয়ে সে দৌড়াতে লাগলো, রহিম সাহেবের বাড়ি থেকে দূরে... আরও দূরে...... তাঁর পেটের ব্যাথাটা বেরেই চলেছে...

"শেষ"

নামঃ শাহরিয়ার রহমান
রেজিস্ট্রেশন নাম্বারঃ ২০১১৩৩৭০১৯
ডিপার্টমেন্টঃ ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টি টেকনোলোজি
সেল ফোনঃ ০১৭৬৭২৫৮৫৫২

No comments:

Post a Comment