Tuesday, December 10, 2013

অগোচরে বিচরণ

মিনহাজ ইসলাম


সিইপি ৩/২


 

 

তোমাদের বিষণ্ণ বিকেলে ঘাসফড়িঙের বন্য কথামালাও হয়তো কোন অর্থ তৈরি করে। করা স্বাভাবিক, যৌবন এমনই। যৌবন সূক্ষ্ম সৌন্দর্যে বিমোহিত করে, বৃষ্টিকে কাব্যে পরিণত করে। রোদে পোড়া পথিকের কালচে দেহ সাম্যবাদকে উস্কে দেয়, মানবতাবোধে জ্বলুনি ধরিয়ে দেয়। সেদিনগুলো আমি পার করেছি অনেক আগেই। এখন বিকেলের বৃষ্টি আমাকে বিরক্ত করে, শিশিরে হাঁটতে গিয়ে আমি ঠাণ্ডা অনুভব করি, আমার পৃথিবী স্থূল এবং অনুভূতি কতিপয় ইন্দ্রিয় নির্ভর। আমাকে জেগে থাকতে এখন মদ্যপান করতে হয়, যৌবনের কোন পুরনো বন্ধুকে খুঁজে নিয়ে কথা বলতে হয় যে আমার ঠোঁটে আটকে যাওয়া কথা শুনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অর্ধশত বছর বয়সে এমন বন্ধু প্রতিদিন খুঁজে পাওয়া ততো সহজ নয়। তবুও মাঝে মাঝে তেমন সৌভাগ্য হয়। ধানমণ্ডি ক্লাবে মাঝে মাঝে যাবার অভ্যাস ছিল। বেশ অনেকদিন যাওয়া হয়নি। গত সপ্তাহে তাই সুযোগ পেয়ে একবার ঘুরে আসতে ইচ্ছা হল। স্বপ্নেও ভাবিনি সেখানে অজিতের দেখা পাবো। ইউনিভার্সিটির তুখোড় ছাত্র অজিতকে কেউ কোনদিন সিগারেটে টান দিতেও দেখেনি। তাই প্রথমে দেখেই ভিমরি খেতে হল। উস্কো-খুস্কো চুল, গায়ে নিতান্ত সাদামাটা জামাকাপড়, আধপোড়া চুরুট হাতে এককোণে চুপচাপ বসে বসে ঝিমচ্ছে। টেবিলের একপাশে শ্যাম্পেনের বোতল পড়ে আছে। আমি প্রথমে ভাবতে পারিনি অজিত আমাকে চিনতে পারবে। কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলাম। অজিত একবার মাথা উঁচিয়ে দেখে আবার নামিয়ে নিলো-

অজিত ঃ    এখনও আসিস এখানে, এতদিনেতো তোর মার্জিত সমাজের প্রতিভু হয়ে যাবার কথা। কালো স্যুটের সাথে নীল টাই পরে বারবার সেটাকে গলার সাথে সেঁটে ধরার কথা। সাথে একটা জার্মান কুকুর থাকাও অস্বাভাবিক না।

আমি ঃ  ওসব আর হল না। তোর সাথে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু সেই যে কোথায় ডুব দিলি।

অজিত ঃ বৃথা চেষ্টা করেছি। এখানে সব হারানো যায়, স্মৃতি, কষ্ট , অনুভূতি সব। শুধু নিজেকে হারানো যায়না, শুধু নিজেকে লুকনো যায়না। যাই হোক কেমন চলছে বল, বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে, চাইলে শ্যাম্পেনে এক চুমুক দিয়ে নে।

শ্যাম্পেনে তেমন অভ্যাস নেই তাও একটু নিতে হল। এসব জিনিস একা একা খাওয়ার মধ্যে মজা নেই।

একটা কথা বলার জন্য মন উসখুস করছিল। শেষে বলেই ফেললাম-

-নীলার খবর জানিস কিছু, শুনলাম ঢাকায় এসেছে।

-বেশ কিছুদিন আগে একবার দেখেছি, দুর থেকে। বেশ বুড়ো হয়ে গেছে মনে হল।কাছে যাবার সাহস হয়নি। সম্ভ্রান্ত মুসলিম মেয়ে, মালাউনের চোখে চোখ পড়লে আবার পাপ হতে পারে। বাদ দে, তার থেকে বরং খন্দকারের কথা শুন।

-কোন খন্দকার, ঐ যশোরের নার্ড টা?

- হা হা হা। কম্যুনিজমের ভুত এখনো নামেনি। শুনলাম এখন জেলে।

আমি তখনো জানতাম না এর চেয়েও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছে। জীবনের পড়ন্ত বিকেলে এসে হা হয়ে থাকা বৃদ্ধের মুখ সবসময় বয়সের জন্য অমন ঝুলে যায়না, মাঝে মাঝে বিস্ময়ে ঝুলে পড়ে। যে পথ মাড়িয়ে এতো দুর আসা তার বিবর্ণ চিহ্নের দিকে তাকালেই ঘটতে থাকে নতুন বিভ্রম। মনে হয় এ এক অপরিচিত পথ যেখানে কখনোই কারো পদচিহ্ন পড়েনি।

অজিত আরেক পেয়ালা শ্যাম্পেন নিলো। চুরুটে একটা দীর্ঘ টান দিয়ে বলা শুরু করলো-

-গতমাসে গোয়াতে গিয়ে ঘুরে আসলাম। গোয়ার সমুদ্রটাও এখন আর আগের মত বিশুদ্ধ মনে হয়না। কিছুই আর টানছেনা। মনে হয় সব দেখা শেষ, সব পাওয়া শেষ।

-কিছুদিন আত্মীয় স্বজনদের সাথে সময় দিতে পারিস, সংসারতো আর করলিনা।

-গোয়া থেকে কোলকাতায় ফিরেছিলাম। বালিগঞ্জে লিটনের সাথে দেখা। লিটনকে তুই দেখিসনি মনে হয়। ফাহিমের বড় ছেলে।

-ফাহিম এখন কোলকাতায় থাকে? ও তো বিমানবাহিনীতে কাজ করতো বলে জানতাম।

-সে এক দীর্ঘ গল্প। চল উঠা যাক। এখানকার পরিবেশ কেমন গুমোটবাঁধা। বাইরে কোথাও গিয়ে কথা বলি। আর বোতলটা নিয়ে নে, আমি নিশ্চিত সবকিছু শুনে তোর কয়েক পেয়ালা গিলতে হবে।

 

অজিতকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ধানমণ্ডি লেকের ভিতরে ঢুকলাম। একসময় এদিকে প্রায়ই আসা হতো। নেহার হাত ধরে এ পথ দিয়ে সমস্ত বিকেল হেঁটে যেতাম উদ্দেশ্যহীনভাবে। ভালোবাসায় প্রাপ্তি তেমন স্বস্তিকর না। লুকোচুরিতেই হয়তো প্রেমের আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে। প্রথম প্রেমের স্পর্শ চিরদিন টিকিয়ে রাখতে বিচ্ছেদের বিকল্প নেই। এ সত্যটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক।

বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে, গায়ে ভালোভাবে চাদর জড়িয়ে নিতে হল। অজিত আবার শুরু করলো-

-লিটনকে দিদির বাসায় নিয়ে আসলাম। দুপুরে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করার পর ওকে ফাহিমের কথা জিজ্ঞেস করলাম। ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জানালো ফাহিম মারা গেছে। আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না, হতবাক হয়ে রইলাম।

-ফাহিম মারা গেছে? কিভাবে হল?

-বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়ে ফাহিম শান্তিরক্ষা মিশনে নামিবিয়ায় যায়। সেখানে দাঙ্গা দমন করতে গিয়ে ফাহিমের কপটার মর্টারের আক্রমনে পড়ে।

-কিন্তু ৮৯ তে তো আমি সচিবালয়ে ছিলাম। তখন নামিবিয়ায় বাংলাদেশ রেজিমেন্টের প্রধান ফায়জুল করিম মারা যান, কিন্তু ফাহিমের কথা তো শুনি নি।

-না, ফাহিম তখন মারা যায়নি, সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। কিন্তু মর্টারের আঘাতে তার বামহাত উড়ে যায়। এর কিছুদিন পর ফাহিম নামিবিয়া থেকে পালিয়ে যায়।

-পালিয়ে যায়?

-হুম। বিষয়টার সাথে সসস্র বাহিনির সম্মান জড়িত। বিমানবাহিনী কিছুদিন খোঁজাখুঁজি করে। খোঁজ না পেয়ে বিষয়টা চেপে যায় এবং পরিবারের কাছে খবর পাঠায় মিশনে কাজ করতে গিয়ে ফাহিম নিহত হয়েছে। ফাহিমের লাশ পাওয়া যায় নি।

-কিন্তু তুই এসব জানলি কিভাবে?

-জেনেছি কারণ তখনো ফাহিম মারা যায়নি। প্রায় দুই বছর পরে ৯২ এর সেপ্টেম্বরে গ্যাবনের কোস্ট গার্ড ফাহিমকে উদ্ধার করে তাদের সমুদ্রসীমায় একটি ছোটো ডিঙ্গি নৌকা থেকে।

-দুই বছর? গ্যাবনে পৌঁছল কিভাবে? এঙ্গোলা , কঙ্গো পার হয়ে গ্যাবন, বেশ দুরইতো মনে হয়। এরপর কি তোর সাথে দেখা হয়েছে?

-আমার সাথে দেখা হয় ঐ বছরের ডিসেম্বরে অস্ট্রেলিয়াতে, মানে দুইমাস পর। গিয়ে যা দেখলাম তা বিশ্বাস করতে পারলাম না।

অন্ধকারেও অজিতের মুখ ফ্যাকাসে মনে হল। বোতল থেকে এক ঢোঁক খেয়ে নিয়ে ঢেকুর তুলল।

-কি দেখলি?

আমি বেশ উতসুক হয়ে উঠলাম।

-সেটা পরেই বলি। আসার সময় ফাহিম আমাকে একটা ডায়েরী ধরিয়ে দিলো আর বলল একটু ভালোভাবে পড়ে দেখতে। নানান ঝামেলার কারণে সেটা এতো বছর পড়া হয়নি। কিন্তু ফাহিমের মৃত্যুর খবর শুনে ডায়েরিটার কথা মনে পড়লো। পুরনো সেলফ থেকে নিয়ে পড়তে লাগলাম। টানা দুদিন পড়ে শেষ করলাম।

-কিন্তু ডায়েরিটা তোকে পড়তে দিলো কেন?

-সম্ভবত আমি জেনেটিকের ছাত্র দেখে। তোকে ঘটনাগুলো বলি তবেই বুঝতে পারবি। ওর ভাষাতেই বলি-

“অনেক স্বপ্ন নিয়েই বিমানবাহিনীতে আসা। কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল পথভ্রষ্টদের অসংখ্য অটোমেটিক অস্রের সামনে একটা কলমের শক্তি যথেষ্ট নয়। ওসব সাহিত্যেই ভালো মানায়। সবসময় চেয়েছি মানবতা যাতে একটা মানচিত্রে আটকা পড়ে না যায়, শান্তিরক্ষা মিশন আমাকে সেই সুযোগ করে দিলো। প্রথমে আমি তেমনটিই ভেবেছিলাম। কিছুদিনের মধ্যেই ভুল ভাঙতে শুরু করে। পৃথিবীর ঘৃণ্য মানুষগুলো কল্পনার চেয়েও শক্তিশালী। আর সামরিক বাহিনী হচ্ছে তাদের দাবার গুটি। অবাক হয়ে দেখলাম কিভাবে একটা দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বলা যায়, কিভাবে দুটি সাংঘরসিক গোষ্ঠীর একটিকে সমর্থন দিয়ে অন্যটিতে গণহত্যা চালানো যায় অত্যন্ত বৈধভাবে। সোমালিয়া থেকে স্বেচ্ছায় নামিবিয়ায় চলে আসলাম। কিন্তু এখানেও সেই একই বাস্তবতার পুনরাবৃত্তি। দক্ষিণ আফ্রিকা বছরের পর বছর ধরে নামিবিয়ার বৈধ স্বাধীনতার দাবিকে ঝুলিয়ে রেখেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত নামিবিয়া জার্মানদের অধিনে ছিল। পরে সেখান থেকে সামরিক ঘাঁটি সরিয়ে নিলেও বিভিন্ন জার্মান কলোনি থেকে যায়। এসব কলোনি নামিবিয়ার স্বাধীনতার ঘোর বিরোধী ছিল কারণ তারা জানতো স্বাধীন হলে নামিবিয়া থেকে তাদের বের করে দেয়া হবে। আফ্রিকান কিছু গোষ্ঠীর সাথে তারাও সসস্র বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়ে। ৮৯ এর আগস্টে আমাদের MIL MI -171 জার্মান মর্টারে বিধ্বস্ত হয় । কিন্তু অবাক ব্যাপার হল আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বলা হয় সেটা বিচ্ছিন্ন স্বাধীনতাকামীদের কাজ।

শরীরের কোন অঙ্গ হারিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন। প্রচণ্ড মানসিক চাপ নিয়ে দুঃসহ জীবন যাপন করছিলাম। উপর থেকে স্বেচ্ছায় অবসরের জন্য চাপ দিতে লাগলো। যাদের জন্য এতো কিছু করলাম তাদের এমন মুখ ফিরিয়ে নেয়া সহ্য করতে পারলাম না। ঠিক করলাম এদের শিক্ষা দিয়ে মরবো। সোমালিয়ার গণহত্যা তখনো আমি মেনে নিতে পারিনি। ঠিক করলাম সোমালিয়ায় ফিরে যাব কিছু অস্র-সস্র আর খাবার দাবার নিয়ে। পরিকল্পনা মতই কাজ হচ্ছিল। ৮৯ এর ডিসেম্বরে অস্র আর খাদ্য বোঝাই BELL-212 কপটার নিয়ে উড়াল দিলাম সোমালিয়ার উদ্দেশ্যে। পরিকল্পনা ছিল গ্যাবনে গিয়ে জ্বালানী ভরে নেব। নামিবিয়া আর এঙ্গোলার উপকুল ধরে চলতে লাগলাম। কঙ্গো উপকুল পার হয়ে গ্যাবনের কাছাকাছি আসতেই  গ্যাবনের নৌবাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়লাম। দ্রুত উপকুল ছেড়ে গ্যাবনের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে হল। ততোক্ষণে জ্বালানির অভাবে দুটো ইঞ্জিনই প্রায় বিকল হয়ে গেছে। গ্যাবনের এ অংশে ঘন বনাঞ্চল। দুর্গম পাহাড়ি বনাঞ্চলের কারণে অনেক অংশেই রাষ্ট্রীয় কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। গভীর বনের মঝের একটা জায়গায় সমতল ঘাসের ভূমি দেখে ভাবলাম এখানে নামাই সুবিধাজনক। ভয় হচ্ছিল হয়তো এখান থেকে জনপদ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে না। ততোক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে এলো। এ ধরনের রেইন ফরেস্টে রাতে থাকা বেশ বিপজ্জনক। তখন কে জানতো এখানেই আরও দুবছর কাটাতে যাচ্ছি। রাতটা কপটারের ভিতরেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। মাঝরাতের দিকে হঠাত ঘুম ভাঙে কাঁচ ভাঙার শব্দে। আকস্মিক মাথায় ভারী কিছুর আঘাতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

জ্ঞান ফিরে দেখি একটা কাঠের খাঁচার মধ্যে আটকে আছি। ভাবলাম হয়তো কোন বন্য উপজাতির হাতে পড়েছি। সারাদিন এভাবেই আটকে থাকলাম।  কারো দেখা মিলল না। সন্ধ্যা গড়িয়ে যখন রাত হল হঠাত কাছেই কারো গুঞ্জন শুনতে পেলাম। খুব কাছ থেকে কেউ ভিতরে কিছু গাছের মূল ছুঁড়ে মারল। ক্ষুধায় তখন মুমূর্ষু অবস্থা আমার। যা ফেলাম তাই খেয়ে সাবাড় করলাম। এভাবে বেশ কিছুদিন চলে গেলো কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলাম না।”

এ পর্যন্ত বলে অজিত থামল। দুজন পুলিশ পাশ দিয়ে যাবার সময় এদিকে আসলো। জিজ্ঞেস করলো এতরাতে কি করছি। পরিচয় জানার পর একরাশ উপদেশ দিয়ে বিদায় হল। অজিতকে বেশ চিন্তিত মনে হল। তারপর বলল-

-কিছুদিনের মধ্যেই ফাহিম সেই খাবার সরবরাহকারী প্রাণীগুলোর দেখা পেলো।

মানুষ মানুষই সে যেখানেই থাকুক। অজিতের মুখে প্রাণী শব্দটা শুনে খুব খারাপ লাগলো। না বলে পারলাম না।

-প্রাণী? পাহাড়ি হলেও তাদের মানুষ বলাই উচিৎ মনে হয়।

-প্রাণী বলাটাই সঙ্গত। ফাহিম প্রথমে তাদের মানুষই ভেবেছিলো। কিন্তু সময়ের সাথে বুঝতে শুরু করে তাদের বেশকিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন তারা রাতে দেখতে পায় অনেকটা নিশাচর প্রাণীর মত, গায়ের প্রায় সবটাই লোমে ঢাকা, স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে মাথা অনেক বড়, দেহের তুলনায় হাত অনেক লম্বা যা প্রায় মাটি স্পর্শ করে। দুপায়ে দাঁড়াতে পারলেও হাঁটার সময় অনেকটা গরিলার মত চারপায়ে হাঁটে। এছাড়া তারা সম্পূর্ণ তৃণভোজী।

-এটি ভৌগোলিক কারনেও হতে পারে। তাই বলে মানুষ না বলার তো কোন কারণ নেই। ফাহিম কি বলেছে তারা কথা বলতে পারে?

-হুম, তাদের নিজস্ব ভাষা আছে এবং মানুষের মতই বুদ্ধিমান। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয়টাই বলা হয়নি। তা হল তারা শরীরের যেকোনো অংশ পুনরুৎপাদনে সক্ষম। অর্থাৎ কোন কারণে পা কাটা গেলে তা পুনরায় গজাতে সক্ষম। কিংবা ফুসফুস অকেজো হয়ে গেলে নতুন ফুসফুস তৈরি করতে সক্ষম।

-কিন্তু এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? কোন প্রাণীতে এমন ঘটা সম্ভব?

-মানুষের মত বুদ্ধিমান কোন প্রাণীতে এমন ক্ষমতা খুবই সীমিত। কিছু কিছু প্রাণীতে এমন বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। লিজার্ড তাদের লেজ কাটা গেলে পুনরায় গজাতে সক্ষম, প্লানারিয়াস নামে একধরনের প্রাণীকে যতভাগ করা হয় তা থেকে ততগুলো নতুন প্রাণীর উদ্ভব ঘটে। কিছু মাকড়সা তাদের হারানো পা বা পায়ের অংশ পুনরুৎপাদন করতে পারে। স্টারফিস এবং কিছু হাঙ্গরেও এমন বৈশিষ্ট্য আছে। মানুষ যকৃতের অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্থ হলে তা পুনরায় ঠিক করে নিতে পারে।

-কিন্তু এমন প্রাণীর সন্ধান বা ফসিলও খুঁজে পাওয়া গেছে বলে শোনা যায় নি কেন?

-ধারণা করা হয় বিবর্তনের প্রাথমিক দিকে আফ্রিকা থেকেই মানুষ পৃথিবীর অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ হমিনয়েড গোত্র থেকে উদ্ভুত। কিন্তু প্রসিমি সহ আরোকিছু সাব অর্ডারের বিবর্তনেও কিছু বুদ্ধিমান প্রানের উদ্ভব ঘটার কথা। সম্ভবত ঘটেছেও। স্বাভাবিকভাবেই দুটো বুদ্ধিমান প্রানের মধ্যে টিকে থাকার দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং তা রক্তক্ষয়ী আকার ধারণ করে। এতে সম্ভবত হোম সেপিয়েন্সরা ব্যাপকহারে এ প্রাণীদের হত্যা করে। ফলে তারা আফ্রিকা থেকে বের হবার সুযোগ পায়নি। ফাহিমের ভাষ্যমতে তারা অশুভ শক্তির উৎসরুপে মানুষের মূর্তিকে পুজো করে।

-কিন্তু তারা ফাহিমকে হত্যা করেনি কেন?

-এর কারণ ফাহিমের এক হাত না থাকা। তারা প্রথমে চেয়েছিল ফাহিমকে পুড়িয়ে মারতে কিন্তু যখন দেখে ফাহিমের হাত মাত্র একটা তখন তারা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে তাকে নিয়ে। তারা ভেবেছে ফাহিম হয়তো তাদের মতই অন্য কোন প্রাণী। ফাহিম একসময় তাদেরকে হাত না থাকার কারণ খুলে বললেও তারা ফাহিমকে থাকতে দেয় কিন্তু এর মাঝেই চলে দীর্ঘ ষড়যন্ত্র। ৯২ এর সেপ্টেম্বরে তারা যখন ফাহিমকে একটা নৌকায় করে আটলান্টিকে ভাসিয়ে দেয় তখনো তারা জানতো ফাহিমকে কোস্টগার্ড খুঁজে পাবে এবং সে বেঁচে থাকবে।

-কিন্তু এতে তাদের কি লাভ বা ষড়যন্ত্রই বা কোথায়?

-সিডনীতে যখন ফাহিমের সাথে দেখা হয় তখনকার কথা তোকে বলেছিলাম। ফাহিম তখন প্রায় শয্যাশায়ী। তার অন্য হাতটিতে ধীরে ধীরে মাংস পচে যাচ্ছিল। বৈধ কাগজপত্রের অভাবে কোন ভালো ডাক্তার দেখাতেও পারছিল না। ফাহিমকে এ অবস্থায় দেখে খুবই অসহায় বোধ করলাম। ওর রক্তের স্যাম্পল এনে একজন পরিচিত ডাক্তারকে দেখতে দিলাম। প্রায় দশদিন পর রিপোর্ট এলো। ফাহিমের রক্তে একধরনের নতুন মাইক্রোবায়ালের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হল এরা স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষের দেহের কোন ক্ষতি করতে সক্ষম নয়। কিন্তু মানবদেহের দ্রুত অবস্থা পরিবর্তনশীল অঙ্গ যেমন ফুসফুসে ঢুকে এরা কয়েকমাসের মধ্যে নিজেদের জেনেটিক বিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। একসময় এ বিবর্তিত রূপ কোষকে আক্রমন করে এবং কোষীয় অঙ্গাণু ভক্ষন করে পুষ্টি যোগায়। একসময় কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এদের বিবর্তন নির্ভর করে ফুসফুসীয় অবস্থার উপর এবং বিবর্তিত রূপ বাতাসের মাধ্যমে অতিমাত্রায় সংক্রমন ঘটাতে পারে।

-বন্য পরিবেশে এমন জীবাণুর সংক্রমন তো অস্বাভাবিক কিছু না। এতে সেই প্রাণী বা যাই হোক তাদের উপর অভিযোগ আনাকি ঠিক?

-আমিও প্রথমে তা ই ভেবেছিলাম। রিপোর্ট পাওয়ার পর ফাহিমকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য আবার তার বাসায় যাই। বাসায় থাকলে তার দ্বারা যে কেউ সংক্রমিত হতে পারে এবং বিষয়টা মহামারীর আকার ধারণ করতে পারতো। কিন্তু অবাক ব্যাপার হচ্ছে ফাহিম রাজি হচ্ছিল না। ফাহিম স্ত্রী-সন্তানকে দেশে পাঠিয়ে দিলো। আমিও বসে থাকতে পারছিলাম না, কারণ ক্রমেই সময় শেষ হয়ে আসছিলো। একবার ছড়িয়ে পড়লে আর রক্ষা নেই। অনেক পীড়াপীড়ির পর ফাহিম সত্যটা বলতে বাধ্য হল। সেই প্রাণীদের সাথে মিলে ফাহিম লেগেছিল মানুষকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে। খাবারের মাধ্যমে ক্রমাগত ফাহিমকে মাইক্রোবায়াল দিয়ে সংক্রমিত করা হয়।

-কিন্তু এমন পাহাড়ি প্রাণীগুলো মাইক্রোবায়ালের ধারণা পেলো কিভাবে?

- না , তারা এভাবে কিছুই জানতো না। তোকে বলেছিলাম তারা তৃণভোজী। কোন সময় তাদের আশেপাশে অনেক মানুষের গোত্র বাস করতো। গ্যাবনের বনাঞ্চলে একধরনের বড় আকারের কাঁকড়া পাওয়া যায় । ঐ কাঁকড়াগুলোকে যখন মানুষ খাবার হিসেবে নিতে লাগলো তখন তারা সংক্রমিত হয়েছিল। অসংখ্য মানুষের গোত্র নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো তা তৃণভোজী প্রাণীগুলো লক্ষ্য করেছিলো এবং সেভাবেই ফাহিমকে সংক্রমিত করে। যাই হোক এর কিছুদিন পর আমি দেশে ফিরে আসি। শুনেছি পরের মাসেই ফাহিম গাড়ী দুর্ঘটনায় মারা যায়। বিষয়টা মর্মান্তিক হলেও এক দিক দিয়ে ভালোই হল। মাইক্রোবায়ালগুলো পোষকের অভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো।

সব শুনে হা হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। বোতল থেকে কয়েক ঢোক গিলে নিলাম কিন্তু তাও যেন হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিলো। অজিত বলল –

-চল , উঠা যাক।

-এতো রাতে বাসায় কিভাবে যাবি, আমার বাসাতো কাছেই। রাতটা এখানেই থেকে যা।

অজিত আমতা আমতা করেও শেষে রাজি হল। ওকে নিয়ে বাসায় আসলাম। নেহা তখনো জেগেই ছিল। এতো রাতে অজিতকে দেখে খুব যে খুশি হল তা না। রাতের খাবার শেষে অজিতকে শোবার ব্যাবস্থা করে দিতে গেলাম। কিন্তু হঠাৎ একটা বিষয় খটকা লাগলো। অজিতকে জিজ্ঞেস করলাম-

-আচ্ছা , ফাহিম মারা গেলো কি মাসে যেন?

-৯৩ এর জানুয়ারিতে।

-কিন্তু আমার আর নেহার বিয়ে হয় ঐ একই মাসের ২৬ তারিখ। তোকে খবর পাঠিয়েছিলাম, মনে পড়ে?

-হুম। সেটা কি জানুয়ারি ছিল?

-নিজের বিয়ের দিনটাও কি ভুলতে পারি !  তুই পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিলি সিডনী থেকে। কিন্তু একটু আগে তুই বললি তুই দেশে ফিরে আসছিলি তখন।

অজিতের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল-

-এমন অবস্থায় তুই কি করতি বল, আমার সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল না।

-মানে, মানে ফাহিমকে তুই ই মেরেছিলি?

আমার সামনে যেন পৃথিবীটা ঝাপসা হয়ে আসছিলো। বাস্তবতার মাদকতা মাঝে মাঝে মাদকের প্রভাবকেও ছাড়িয়ে যায়। অজিতকে কিছু না বলে বেরিয়ে আসলাম, যেন বেরিয়ে আসতে চাইলাম বিষণ্ণ সভ্যতার প্রান্ত থেকে। ইচ্ছে হচ্ছিল ঘাসফড়িঙের মত লাফিয়ে লাফিয়ে হারিয়ে যাই সবুজের আচ্ছাদনে, অস্বস্তিকর সত্য হল মানুষের এতগুলো পা কখনোই ছিলোনা, আমারতো না ই।

No comments:

Post a Comment