আমাদের পৃথিবীসহ পুরো মহাবিশ্ব কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে নানা ধরনের ব্যাখ্যা দেখা যায়। বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা ভিন্ন ভিন্ন মতামত দিয়ে থাকেন। মহাবিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যেও সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য একটি মত রয়েছে। মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব হলো মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের দেওয়া একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। আর এই মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বই হল বিগ ব্যাঙ।
আজকের দুনিয়ায় বিগ ব্যাঙ তত্ত্ব সর্বজন বিদিত ও বিজ্ঞানী মহলে সমাদৃত ও স্বীকৃত। তবে শুরুতে কেউই বিগ ব্যাঙ তত্ত্বকে পাত্তা দেয় নি, উড়িয়ে দিয়েছিল। যে কজন এই তত্ত্বকে সমর্থন করেছিল, তারা ভবিষ্যতবাণী করে যে বিগ ব্যাঙের বিষ্ফোরনের ফলে তাপ থেকে সৃষ্ট মাইক্রো- ওয়েভ তরঙ্গের বিকিরন এখনো অবশিষ্ট আছে। আমাদের এ মহা বিশ্ব সৃষ্টি হয় আনুমানিক সারে তের বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাঙ এর মাধ্যমে। বিগ ব্যাঙ এর ধারনাটা অনেকটা এরকম- মহাবিশ্ব জন্মের আগে খুবই কম আয়তনের এবং বেশি ঘনত্বের এবং অনেক বেশি তাপমাত্রার ক্ষুদ্র একটি বস্তু ছিল যাতে বিষ্ফোরণ ঘটে এবং সেই বিষ্ফোরনের মাধ্যমে নক্ষত্ররাজী, গ্রহ উপগ্রহ ইত্যাদির সৃষ্টি হয় এবং দিন দিন এই মহা বিশ্ব সম্প্রসারিতই হচ্ছে।
১৯৬৫ সালে নিউ জার্সীতে বেল ল্যাবরেটরীর দুজন বিজ্ঞানী প্রায় হঠাৎ করেই একটা বড় রেডিও ডিশ- এন্টেনার মাধ্যমে এই তাপ থেকে সৃষ্ট মাইক্রো- ওয়েভ তরঙ্গের সন্ধান পেয়ে যান। পৃথিবীর সবচেয়ে সুক্ষ পরিবর্তন নির্ণয়ে সক্ষম রেডিও ডিশ- এন্টেনাকে টিউনিং করার সময় একটি ঝির ঝির শব্দ আর্নো পেন্জিয়াস ও রবার্ট উইলসনকে জ্বালাতন করছিল। কারন এন্টেনাকে আকাশের যেদিকেই ঘুরান না কেন, সকল দিক থেকেই ঝির ঝির শব্দটি আসছিল। তারা প্রথমে ভেবেছিলেন, এটা পাখির বিষ্ঠা। তাদের এন্টেনাটি এতই সুক্ষ ছিল যে, ডিশ এন্টেনার উপরে পাখি বিষ্ঠা ত্যাগ করলে, সদ্য নির্গত সেই বিষ্ঠা গরম থাকার ফলে ওটার তাপ থেকে সৃষ্ট বিকিরনকে ও এই এন্টেনাটি ধরতে পারত। ডিশ- এন্টেনা থেকে সেই বিষ্ঠা পরিস্কার করার পরে ও দেখা গেল ঐ ঝির ঝির শব্দ আসা বন্ধ হচ্ছে না। এর ফলে তারা পড়ে গেল মহা বিপাকে! তারা এই ঝির ঝির করা ডাটা নিয়ে গবেষণা শুরু করল। প্রায় একবছর ধরে এই ঝির ঝির শব্দের ডাটা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পরীক্ষা করে তারা এই স্বীদ্ধান্তে উপনীত হন যে এই ঝির ঝির শব্দটিই হলো ১৩০০ কোটি বছর পূর্বে বিগ ব্যাঙের বিষ্ফোরনের ফলে তাপ থেকে সৃষ্ট মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গের বিকিরন। তাকে বলা হয় কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বা সিএমবি (CMB)। আমরা টেলিভিশনের চ্যানেল পরিবর্তন করার সময় অনেক সময় দেখতে পাই, কোন কোন চ্যানেলে কোন প্রোগ্রামই নাই এবং সেই চ্যানেল গুলো থেকে ঝির ঝির শব্দ শোনা যায়। আসলে এটাই এক প্রকার সিএমবি(CMB)। সিএমবি আবিষ্কারকদের নোবেল পুরস্কার দেয়া হল, যদিও এই বিকিরণের ভাবীকথন অনেক তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা আগেই করেছিলেন এবং সেই সাথে বিগ ব্যাঙ নিয়ে বিজ্ঞানীদের সকল অবিশ্বাস ও সন্দেহ দুর হলো।
কুইন মেরী বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ণাড কার ও ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ের এলান কলে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হন যে এই বিগ ব্যাঙ এর আগেও অন্য কোন মহাবিশ্বের উপস্থিতি ছিল। সেখানকার ব্লাক হোল অন্য কোন বিগ ব্যাঙ এর মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে যা আমাদের মহাবিশ্বের চেয়ে পুরানো। তারা বিগ ব্যাঙ এর আগের অবস্থার নাম দেন বিগ ক্রাঞ্চ এবং বিগ ক্রাঞ্চের আগে মহা বিশ্বের অবস্থা কি ছিল তা অবশ্য বলতে পারেন নি। কুইনসল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতিবিদ তামারা ডেভিস অবশ্য ভিন্ন কথা বলেন। তিনি মনে করেন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে যদি ভিন্ন ভিন্ন মহা বিশ্ব সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে সেখানকার আলোর গতি, তাপমাত্রা, এমন কি পদার্থ সমুহের আকর্ষণও ভিন্ন হতে পারে। এমন কি সেখানের পারমানবিক গঠণও ভিন্ন হবে। যেহেতু আমরা আমাদের মহাবিশ্বের বাইরে যেতে পারি নাই এবং তাই এই গবেষণা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তবে তিনি এই গবেষণাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।
আবার অনেকের মনে প্রশ্ন রয়ে যায়, মহাবিশ্ব যেমন বিগ ব্যাঙ দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু মহাবিশ্ব ধ্বংস হবে কিভাবে? এই প্রসঙ্গে অনেক বিজ্ঞানী অনেক মতবাদ দিয়েছেন, কেউ বলেছেন মহাবিশ্ব সৃষ্টির মত মহাবিশ্ব ধ্বংসও হবে বিগ ব্যাঙ এর মাধ্যমে। তবে অনেকে আবার বলেছেন মহাবিশ্ব বিগ ব্যাঙ এর মাধ্যমে নয়, মহাবিশ্ব ধ্বংস হবে সময় স্থবির হয়ে যাওয়ার কারনে। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি স্পেনের গবেষকরা জানিয়েছেন, মহাবিশ্ব একদিন স্থবির হয়ে দাড়িয়ে যাবে। কারন সময় নাকি ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুতই। তাদের মতে, মহাবিশ্ব বিগ ব্যাঙ এর মাধ্যমে শেষ হবে না বরং তা সময়ের শেষ হবার মাদ্ধমেই ধ্বংস হবে। ইউনিভার্সিটি অফ বাস্ক কান্ট্রি এবং ইউনিভার্সিটি অফ সালামানকায়ের গবেষক হোসে সেনোভিলা, মার্ক মার্স এবং রাউল ভেরা সময়ের মৃত্যু ঘটার এই তত্ত্বটির উপর একমত
পোষন করেন। মহাবিশ্ব যেমন সৃষ্টি হয়েছে ঠিক তেমনি একদিন তা ধ্বংসও হবে। হয় তা পুনঃ বিগ ব্যাঙ এর মাধ্যমে অথবা তা সময়ের শেষ হওয়ার মাধ্যমে, কিন্তু বিজ্ঞান বলে একদিন তা ধ্বংস হবেই।
No comments:
Post a Comment