প্রণব কুমার বিশ্বাস
আইপিই ৩/২
গ্রীক শব্দ ‘জিও’ ও ‘থার্মোস’ শব্দদ্বয় থেকে ‘জিও-থার্মাল’ শব্দের উৎপত্তি। ‘জিও’ অর্থ পৃথিবী এবং ‘থার্মোস’ অর্থ তাপ ; অর্থাৎ ‘জিও-থার্মাল’ শব্দের অর্থ হচ্ছে পৃথিবী হতে প্রাপ্ত তাপ বা “ভূ-তাপ”, ভূ-তাপীয় শক্তির যোগানদাতা স্বয়ং আমাদের পৃথিবী। পৃথিবীর পৃষ্ঠভাগের ঠিক নিচে, যাকে বলা হয় ভূ-স্তর বা ক্রেস্ট, তাপীয় শক্তির আধারটি রয়েছে সেখানে। এই শক্তির ত্রিশ শতাংশ আসছে পৃথিবী সৃষ্টির প্রাক্কালে উদ্ভূত তাপ থেকে, আর বাকি সত্তর শতাংশের উৎস পৃথিবীর কেন্দ্রে নিরন্তর ক্ষয়প্রাপ্ত তেজস্ক্রিয় খনিজ থেকে। পৃথিবীর কেন্দ্রে তেজস্ক্রিয় ক্ষয়জনিত তাপমাত্রার পরিমাণ ৯০০০° ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে। ফলে, পৃথিবীর কেন্দ্রের বিশাল পরিমাণ তাপ চারপাশের অপেক্ষাকৃত শীতল শিলায় ছড়িয়ে পড়ছে। এই বিশাল পরিমাণ তাপ ও চাপে কঠিন শিলা গলে তরল শিলায় পরিণত হচ্ছে আর এই তরল শিলা জন্ম দিচ্ছে ম্যাগমা নামক আরেক পদার্থের । ম্যাগমা কঠিন শিলার চেয়ে হালকা বলে বিশাল চাপের কারণে উপরের দিকে ঠেলে উঠে আসে । ম্যাগমার তাপমাত্রা কখনো কখনো ৭০০° ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। পৃথিবীর ভূ-স্তরের শিলা ও জলকে ম্যাগমা তাই অনায়াসে উত্তপ্ত করে তোলে। এই উত্তপ্ত তাপই ভূ-তাপীয় শক্তি । ভূ-তাপীয় শক্তির সহজসরল দৃষ্টান্ত হলো উষ্ণ প্রস্রবণ বা হট-স্প্রিং। কখনোবা উষ্ণ প্রস্রবণের বদলে পৃথিবীর বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে ধোঁয়ার কুণ্ডলী । ধারণা করা হয় যে ভূ-স্তর এর নিচে ১০,০০০ মিটার অঞ্চলে যে পরিমাণ ভূতাপীয় শক্তি সঞ্চিত আছে তা তেল ও গ্যাস অপেক্ষা ৫০,০০০ গুণ বেশী ।
আমাদের পৃথিবীর ভূ-স্তর একাধিক পাত বা প্লেটের আবরণে মোড়ানো, যাকে বলা হয় টেকটোনিক প্লেট। ভৌগোলিক অবস্থানের জন্যই বাংলাদেশে জিও-থার্মাল এনার্জির সম্ভাবনা এতোটা উজ্জ্বল। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের চূড়ায় অবস্থিত। দুইটি বড় নদী গঙ্গা (পদ্মা) ও ব্রহ্মপুত্র (যমুনা) তার কোল ঘেঁষে যাওয়ায় এখানে একটি ব-দ্বীপের উদ্ভব হয়েছে। জুরাসিক যুগের প্রারম্ভে অথবা ক্রেটাসিয়াস যুগের শেষের দিকে গন্ডোয়ানা মহাদেশ ভেঙ্গে যাওয়ার সময়ে উত্তর দিকে সরে যাওয়া ইন্ডিয়ান টেকটোনিক প্লেটের সাথে সংঘর্ষের ফলে হিমালয় পর্বত শৃঙ্গের উচ্চতা বেড়ে যায়। কালক্রমে এখান থেকেই নদীগুলোর উৎপত্তি। আর সরে যাওয়া প্লেটের ফলে এখানকার কিছু কিছু স্থানে (প্লেটের পাশ ঘেঁষে) হটস্পটের সৃষ্টি হয়েছে । এইসব স্থানে ভূপৃষ্ঠ থেকে নিচের দিকে কিছুটা খনন করলেই তাপমাত্রার উল্লেখযোগ্য তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। সীতাকুণ্ড থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে “লবণাক্ষ” নামে একটি নোনা গরম জলের আধার পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা ঠাকুরগাঁও-এর বরুণাগাঁওয়েও রয়েছে একেবারে প্রাকৃতিক ভাবে উত্তপ্ত এক পানির ধারা। জয়পুরহাটের কুচমায় ৪ হাজার ফুট মাটির নিচে গড়ে ১৪৫° সেলসিয়াস তাপমাত্রা রয়েছে। আর এই তাপমাত্রার তরল হতে প্রাপ্ত বাষ্প থেকে সহজেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশে অবস্থানভেদে ভূপৃষ্ঠ হতে ভূ-অভ্যন্তরস্থ উত্তপ্ত তরল পর্যন্ত পৌঁছাতে ৪০০০ মিটার (কোন কোন ক্ষেত্রে এথেকেও অনেক কম) থেকে ৫০০০ মিটার খনন করতে হতে পারে।
চিত্র : বাংলাদেশের ভূ-তাপীয় এবং গঠন তাত্ত্বিক মানচিত্র ।
ভূ-তাপ সাধারণত দুই ভাবে ব্যবহার করা যায়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং সরাসরি কোন কিছু উত্তপ্ত করার কাজে । যেমন শীত প্রধান দেশের বাসিন্দারা তাদের ঘরকে উত্তপ্ত রাখতে ভূ-তাপ ব্যবহার করে । জিও-থার্মাল এনার্জি দিয়ে সর্বপ্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় ১৯০৪ সালে ইটালিতে ৷ এ থেকে উৎপাদিত জলীয় বাষ্প দিয়ে একটি ছোট্ট টারবাইন ঘুরিয়ে, উৎপাদন করা হয়েছিল বিদ্যুৎ ৷ আর সেই উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়েই পাঁচটি বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো হয়েছিল ৷ তবে বাণিজ্যিকভাবে জিও-থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট প্রথম স্থাপিত হয় ১৯১১ সালে, ইটালির সাউদার্ন টুয়ামির লার্ডোলোতে ৷ বর্তমানে এই পাওয়ার প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাচ্ছেন প্রায় এক মিলিয়ন বাড়ির বাসিন্দা ৷ বর্তমানে পৃথিবীর সাতাশটি দেশে ভূ-তাপীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে । পৃথিবীর অভ্যন্তরে এই উত্তপ্ত তরল পর্যন্ত পৌছাতে একটি নল পৃথিবীপৃষ্ঠ হতে ৫০০০ থেকে ৭০০০ ফুট লম্বভাবে খনন করতে হয়।
পৃথিবীর কেন্দ্রে প্রচন্ড চাপের প্রভাবে নলের মাধ্যমে উত্তপ্ত তরল পৃথিবী পৃষ্ঠের উপরের দিকে উঠে আসতে থাকে। পৃথিবী পৃষ্ঠে পৌছানোর পর পাইপ লাইনের মাধ্যমে তা একটি সিলিন্ডারে প্রবেশ করানো হয়, যেখানে উত্তপ্ত তরল ও উচ্চ চাপের বাষ্পকে পৃথক করা হয়। পৃথককৃত তরল পাইপ লাইনের মাধ্যমে অপর একটি সিলিন্ডারে প্রবেশ করানো হয়, যেখানে স্ট্যান্ডার্ড প্রেশার স্টিম (প্রমাণ চাপের বাষ্প) ঐ তরল থেকে পৃথক করা হয় এবং পৃথক করা তরল পুনরায় একটি সিলিন্ডারে প্রবেশ করানো হয়, যেখানে তরল থেকে লো-প্রেশার স্টিমকে (নিম্ন চাপের বাষ্প)আলাদা করা হয়। পরবর্তীতে, হাই-প্রেশার, স্ট্যান্ডার্ড ও লো-প্রেশার, এই তিন ক্যাটাগরির স্টিমকেই একটি টারবাইনে প্রবেশ করানো হয়, এর ফলে টারবাইনে ঘূর্ণন গতির সঞ্চার হয়,টারবাইন একটি জেনারেটরের সাথে সংযুক্ত থাকার ফলে সেখানে বৈদ্যুতিক চার্জের উদ্ভব হয়। এই বিদ্যুৎ শক্তি কপার তারের মাধ্যমে একটি স্টেপ-আপ ট্রান্সফর্মারে পাঠানো হয়, সেখানে ভোল্টেজ বাড়ানোর মাধ্যমে তা বাণিজ্যিক ও ঘরোয়া কাজের জন্য ব্যবহার উপযোগী বিদ্যুতে পরিণত করা হয়। অন্যদিকে, উত্তপ্ত তরল পরিশোধনের মাধ্যমে পুনরায় অপর একটি নলের মাধ্যমে তা পৃথিবীর কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যেন সেখানকার তরলের ভারসাম্য ঠিক থাকে।
চিত্র : একটি ভূতাপীয় বিদ্যুৎ প্লান্টের লেআউট ।
ভূতাপীয় শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় প্রচলিত ৩ পদ্ধতিতে-
১. ড্রাই স্ট্রিম
২. ফ্ল্যাশ স্ট্রিম
৩. বাইনারি সাইকেল
ড্রাই স্ট্রিম: ড্রাই স্ট্রিম প্লান্ট গুলো সরাসরি ভূগর্ভস্থ হতে আসা স্ট্রিম কে ব্যবহার করে টারবাইন ঘুরানোর কাজ করে। স্ট্রিম ঘনীভবন প্রক্রিয়ায় পানিতে পরিনত হবার পর একে পুনরায় ভূগর্ভে ফেরত পাঠানো হয় ।
চিত্র : ড্রাই স্ট্রিম পাওয়ার প্লান্ট
ফ্ল্যাশ স্ট্রিম : ফ্ল্যাশ স্ট্রিম প্লান্ট গুলো ৩৫০ ডিগ্রী ফারেনহাইট এর উপর তাপমাত্রায় পানিকে ব্যবহার করে। উচ্চচাপের এই পানি পৃথিবীপৃষ্ঠের উপর উঠে আসার পর দ্রুত চাপ কমার ফলে এর কিছু অংশ বাষ্পে পরিনত হয়। তাই এর নাম ফ্ল্যাশ স্ট্রিম। এই বাষ্পকে ব্যবহার করে টারবাইন ঘুরানো হয়।
চিত্র : ফ্ল্যাশ স্ট্রিম পাওয়ার প্লান্ট
বাইনারি সাইকেল: বাইনারি সাইকেল প্লান্ট গুলো ২২৫ ডিগ্রী ফারেনহাইটের কম তাপমাত্রায় ব্যবহার করা হয়। এখানে সরাসরি ভূগর্ভস্থ গরম পানি ব্যাবহার করার পরিবর্তে এ পানিকে Heat Exchanger এর মাধ্যমে অন্য একটি তরলকে বাষ্পীভূত করা হয় যার স্ফুটনাঙ্ক কম যেমন ( Iso-butane or Iso-Propane ) এবং এ বাষ্প দ্বারা টারবাইন ঘুরানো হয়। বাইনারি প্লান্টে ব্যবহৃত এ তরলদ্বয় কখনো পরস্পর পরস্পরের সংস্পর্শে আসে না, তাই এর নাম বাইনারি বা দুই ভাগ বিশিষ্ট সাইকেল ।
চিত্র : বাইনারি সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট
ভূ-তাপ একটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি কারন পৃথিবীর অভ্যন্তরে তেজস্ক্রিয় কণাগুলো প্রতিনিয়ত স্বল্পমাত্রাই ক্ষয় হচ্ছে যা কিনা চলবে পৃথিবী ধ্বংসের পূর্ব পর্যন্ত । আর সবুজ জ্বালানি বলা হচ্ছে এ কারণে যে ভূ-তাপীয় পাওয়ার প্লান্ট গুলো গড়ে ৪০০ কেজি CO2 নির্গমন করে প্রতি ২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এর জন্য, এটি হলো ১ থেকে ৪ দশমিক অংশ,যা একটি কয়লা দ্বারা বা জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে চালিত পাওয়ার প্লান্ট এর নির্গত CO2 থেকে ।
ভূতাপীয় শক্তি ব্যবহারের সুবিধা অনেক । প্রথমত, এটি একটি নবায়নযোগ্য সবুজ জ্বালানি, ফলে বিশ্বউষ্ণায়ন ও পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে সাহায্য করে । দ্বিতীয়ত, এটি একটি নির্ভরযোগ্য শক্তির উৎস কারন সৌরশক্তি বা বায়ু-শক্তির মত এটি আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল নয় । তৃতীয়ত, ভূতাপীয় শক্তি সরাসরি ব্যবহার করা যায় যেমন : কৃষিকাজে, তাপ পাম্পে, শীত প্রধান দেশে ঘর গরম রাখতে। অপরদিকে ভূতাপীয় শক্তি ব্যবহারের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে শুধুমাত্র যে সকল অঞ্চলে হটস্পট আছে সেখানেই এই শক্তি ব্যবহার করা যাবে ।
সম্প্রতি পাওয়া তথ্য অনুসারে ‘Anglo MGH Energy’ নামে একটি ঢাকা কেন্দ্রিক বেসরকারী প্রতিষ্ঠান দেশে প্রথমবারের মত ঠাকুরগাঁওয়ে ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন একটি ভূ-তাপীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা ২৮ টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে উত্তপ্ত বাষ্পকে উত্তোলন করে টারবাইন ঘুরানোর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে।
সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ভূ-তাপীয় শক্তির দ্বারা উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা নিবারণে ভূমিকা রেখে এক নব দিগন্তের সূচনা করতে পারে......
তথ্যবহুল একটি রচনা । ভাল লাগল
ReplyDeleteValo e hoisa. Tobe aro sundor kora jeto.......
ReplyDeleteহাঁ , চাইলে আরো অনেক সুন্দর করা যেত । কিন্তু শব্দ সংখ্যার লিমিট তো ১০০০
ReplyDelete