প্রাণীজগতের অন্যান্য প্রাণীদের আচার-আচরনে আমরা প্রায়ই মানবসদৃশ বুদ্ধিমত্তার এবং সামাজিক আচরণের ছাপ দেখতে পাই। এর কতগুলো নিদর্শনের উপর একটু নজর দেয়া যাক। দক্ষিণ জাপানের একটি দ্বীপে একবার ম্যাকাকদের (এক প্রজাতির বানর) মধ্যে খাদ্য সংকট দেখা দিলে গবেষকরা তাদের জন্য বালুভর্তি সমুদ্র-সৈকতে অনেকগুলো গমের শীষ ছুঁড়ে দেয়। ম্যাকাকগুলো গম খেতে যথেষ্ট উৎসুক থাকলেও বালু হতে গম আলাদা করাটা তাদের জন্য একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। একদিন ইমো নামের একটি ম্যাকাক একটি চমৎকার উপায় বের করে দেখালো। সে এক মুঠ বালি মিশ্রিত গম পানিতে ফেলে দিলো। এরপর সে লক্ষ্য করল যে বালুগুলো পানিতে ডুবে যাচ্ছে কিন্তু গমগুলো ভেসে থাকছে। খুব সহজেই সে এবার গমগুলো হাত দিয়ে তুলে নিতে পারলো। এরপর আরেকটি আশ্চর্যজনক বিষয় গবেষকরা লক্ষ্য করলেন। তুলনামূলক বয়স্ক বানরেরা এই পদ্ধতিটি গ্রহণ না করলেও কম-বয়েসি বানরদের মধ্যে ইমোর নতুন উদ্ভাবন বেশ সাড়া জাগায় এবং তারাও একই পদ্ধতিতে এরপর কাজ চালাতে থাকে। ধীরে ধীরে এটা অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে এবং বর্তমানে দেখা যায় যে, ওই দ্বীপের সকল ম্যাকাকই বালু থেকে গম আলাদা করতে পানি ব্যবহার করে। ঠিক যেমনটা আমাদের মানব সমাজে দেখা যায়। যে কোনো নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হলে আমাদের তরুনদেরকেই আগে প্রভাবিত করে। এরপর ধীরে ধীরে সেটা বয়স্করা গ্রহণ করে।
[চিত্রঃ জাপানি ম্যাকাক বানর]
জেন গুডল নামক এক ব্রিটিশ প্রাইমেট গবেষক তাঞ্জানিয়ার কিছু শিম্পাঞ্জির উপর গবেষণা চালিয়ে তাদের বিভিন্ন সামাজিক আচরণ ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি সেখানে ফ্লো নামের একটি স্ত্রী শিম্পাঞ্জি ও তার ফ্লিন্ট নামের বাচ্চার একে অন্যের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। ফ্লোর মৃত্যুর কয়েকদিন পরই ফ্লিন্টের মৃত্যু হয় এবং ময়নাতদন্তে তার মৃত্যুর কোনো শারীরিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় নি। ফ্লোএর মৃত্যুর শোকেই ফ্লিন্টের মৃত্যু হয়ে ছিল।
[চিত্রঃ বনেট বানর]
প্রাণীদের এই আবেগ নির্ভর করে তাদের প্রজাতির উপর। যেমন একটা বনেট বানরের বাচ্চার কাছ থেকে তার মাকে সরিয়ে নিলে সে সেটার চেঁচামেচি করে সেটার প্রতিবাদ করবে। আবার তার পরিবারেরই কোনো বয়স্ক বানরের হাতে তাকে তুলে দিলে সে তাকেও নিজের মা হিসেবে একসময় মেনে নিবে। কিন্তু একটা পিগটেইল বানরের বাচ্চার কাছ থেকে তার মাকে সরিয়ে নিলে সে আর কোনো বানরের কাছেই যেতে চায় না। দেখা যায় সে খাঁচার এক কোণায় গিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকে। আর কোনো বয়স্ক বানরও তার দায়িত্ব নিতে আগ্রহ দেখায় না।
[চিত্রঃ পিগটেইল বানর]
ডাচ প্রাইমেটোলজিস্ট ফ্রান্স দা ওয়াল তার গবেষণায় প্রাইমেটদের মধ্যে সমবেদনা, সহযোগিতাবোধ এমনকি বিচার বিবেচনার ছাপও দেখতে পেয়েছিলেন এবং সেগুলো নিয়ে আলোচনাও করেছিলেন -
১. দুটি পাশাপাশি থাকা খাঁচায় থাকা দুটি বানরের একটিকে আপেলের টুকরা এবং অন্যটিকে শসার টুকরা খেতে দেয়া হয়েছিলো। গবেষক এরপর দেখেন যে বানর দুটির প্রত্যেকেই নিজের ভাগে থাকা খাবারের অর্ধেক খাঁচার ভিতর দিয়েই একে অন্যের সাথে বিনিময় করে। যাতে তারা উভয় খাবারের স্বাদই আস্বাদন করতে পারে।
২. বনোবোদের (প্রাইমেটদের আরেকটি প্রজাতি) মধ্যে অনেকটা ‘কানামাছি’ ধরনের একটা খেলার প্রচলন রয়েছে। এখানে একটি বনোবো নিজের দুই হাত অথবা কলার খোসা দিয়ে নিজের চোখ ঢেকে ফ্রেমের উপর হাঁটতে থাকে। যখন সে ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যায় তখন অন্য একজন খেলা শুরু করে।
৩. কোনো শিম্পাঞ্জির মন খারাপ হলে তা সনাক্ত করা খুব সহজ। তারা কখনো ঠোঁট ফুলিয়ে বসে থাকে, কখনো ফোঁপাতে থাকে আবার কখনো স্থির হয়ে বসে মাথা দুদিকে নাড়াতে থাকে। এসময় অন্য শিম্পাঞ্জিরা তার দিকে এগিয়ে যায় এবং তার গায়ে হাত রেখে, তাকে জড়িয়ে ধরে তার মন ভাল করার চেষ্টা করে।
প্রশ্ন হলো, এসব কথা উল্লেখ করে আমি কি বোঝাতে চাচ্ছি। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমরা ডিএনএ সিকোয়েন্স সম্পর্কে অতটা গভীরভাবে জানতে পারি নি। এই ডিএনএ সিকোয়েন্সই আমাদের আচার-আচরনকে নির্ধারণ করে। যেহেতু প্রাণীদের আচরণ বিশ্লেষণ করে তাদের বুদ্ধিমত্তা বিচার করা হয় তাই তাদের আচরণ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এখানে আরেকটি বিষয় আসে। প্রাণীগুলো কি করছে, আর ওই সময় কি চিন্তা করছে এদুটো কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। যেমন ধরুন, পিঁপড়ারা একটা কলোনিতে একত্রিত হয়ে বাস করে। কোনো পিঁপড়া মারা গেলে তার সঙ্গীরা তার লাশ নিয়ে দূরে ফেলে দিয়ে আসে। অনেকেই এক্ষেত্রে বলে উঠতে পারে, ‘দেখো দেখো, কি বুদ্ধিমান! ওরা জানে ওই লাশ ওদের মাঝে রাখলে সেটা থেকে রোগজীবাণু ছড়াতে পারে তাই তারা সেটা দূরে ফেলে দিয়ে আসছে’। কিন্তু আসলে কি তাই? পিঁপড়া মারা গেলে তাদের শরীর থেকে এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়। যার নাম ‘ফিউনারেল ফেরোমোন’। যার গন্ধ পেলে পিঁপড়ারা মৃত পিঁপড়াকে দূরে নিয়ে ফেলে আসে। বিজ্ঞানীরা ওই রাসায়নিক দ্রব্যকে সিন্থেসাইজ করে জীবিত একটি পিঁপড়ার উপর এক ফোঁটা ফেলে দিয়েছিল। ফল যেমনটা ভাবা হয়েছিল তেমনটাই হয়। পিঁপড়ারা ওই জীবিত পিঁপড়াকেই তুলে নিয়ে দূরে ফেলে দিয়ে আসে। অর্থাৎ প্রাণীরা অনেক সময় মানুষের মতো আচরন করে তবে তার মানে এই না যে তারা আসলেই মানুষের মত চিন্তা করে।
আবেগ ও বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শনের ক্ষমতা প্রাইমেট ছাড়া অন্যান্য প্রাণীদেরও আছে। বন্য হাতিরা সবাই একটা নির্দিষ্ট চেইন অব কমান্ড মেনে চলে (নিয়মানুর্বর্তিতা), আফ্রিকার বুনো মহিষেরা শিকারীর গুলিতে আহত হলে অনেক সময় দৌড়ে না পালিয়ে সেখানেই শুয়ে পড়ে থাকে। যাতে শিকারী কাছে সে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে আঘাত করে পারে (প্রতিশোধ), জাপানের শহরের কাকেরা রাস্তায় কোনো খাবার পড়ে থাকতে দেখলে তারা ট্রাফিক সিগনালের অপেক্ষায় থাকে, গাড়ি থামার সিগনাল দেখলে তবেই তারা খাবার নিতে রাস্তায় নেমে আসে (বিচক্ষনতা), ক্লার্ক’স নাটক্র্যাকার নামক এক প্রকার পাখি প্রতি বছর প্রায় ১০০০০ টি স্থানে নিজেদের খাদ্যশস্য মজুদ করে রাখে। আর কোথায় কোথায় শস্যগুলো রাখা আছে সেগুলোও তারা ঠিক মনে রাখতে পারে (স্মরণশক্তি)।
[চিত্রঃ ক্লার্ক'স নাটক্র্যাকার]
বিতর্ক থেকে যায়। আমরা মানুষকে ‘শ্রেষ্ঠ প্রজাতি’র আসনে অধিষ্ঠিত রাখব? না কি অন্যান্য প্রাণীদের বুদ্ধিমান আচরনগুলোকে তাদের প্রাপ্য সম্মান দিব? প্রথম পক্ষটিকে বলা হয় ‘ইন-কাইন্ড’ ও দ্বিতীয় পক্ষটিকে বলা হয় ‘ইন-ডিগ্রী’। ‘ইন-কাইন্ড’পক্ষে থাকা ডিসকাভারি ইন্সটিউটের ডেভিড বার্লিনস্কি সবসময়ই মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের বুদ্ধিমত্তার মধ্যে ব্যবধান রাখার পক্ষে। তিনি বলেন-
“পার্থক্য নাই মানে? একটা শিম্পাঞ্জি লিখতেও পারে না, পড়তেও পারে না। তারা ছবি আঁকতে পারে না, অংক করতে পারে না, মিউজিকও কম্পোজ করতে পারে না। তারা জন্ম নেয়, কিছুদিন বেঁচে থাকে, এরপর অসুস্থ হয় তারপরই মারা যায়”।
আমরা আগেই বলেছি যে শুধুমাত্র প্রাণীর আচরণের উপর নির্ভর করে তাদের বুদ্ধিমত্তা বা চিন্তার পরিধির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। আবার ডেভিড বার্লিনস্কি যেভাবে তার অবস্থানকে ব্যখ্যা করেছেন অতটা কট্টর অবস্থানে চলে যাওয়াটাও বুদ্ধিদীপ্ত আচরন প্রদর্শন করে না। কারন মানুষ আজকের এই অবস্থানে একদিনে আসে নাই। আজ আমরা যেভাবে চিন্তা করি, আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগের মানুষেরা, মানে আমাদের পূর্বসুরিরা কিন্তু এভাবে চিন্তা করতেন না। এই মূহুর্তে আমি উপরের দুই ‘ইন-কাইন্ড’ ও ‘ইন-ডিগ্রী’ পক্ষের কোনো পক্ষেই প্রবেশ করছি না। এবং আপনাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার ভারও আমি আপনাদের উপরেই ছেড়ে দিচ্ছি।
শুধু মানুষেরাই নিজেদের বিবর্তনীয় ইতিহাসে প্রকৃতিতে টিকে থাকার প্রয়োজনে উপযুক্তভাবে নিজেদের চিন্তা করার ক্ষমতার উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছে। মানুষের মস্তিস্ক অন্য সকল প্রাণী হতে উন্নততর ও জটিলতর। তবে এর প্রয়োগ কি আমরা আদৌ কখনো দেখাতে পেরেছি? আমরা মানুষেরাই নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদে অন্যান্য প্রাণীদের আবাসস্থল তাদের থেকে কেড়ে নিচ্ছি। আমাদের কারণেই প্রকৃতি থেকে তাদের খাদ্য সামগ্রীরও পরিমাণও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। যা তাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে বিলুপ্তির পথে। নিজেদের উন্নত মস্তিষ্কের কারনে সৃষ্ট ইগো নিয়ে চলা নয়, আমাদের উচিত আমাদের কাজের মাধ্যমে নিজেদের উন্নত মস্তিষ্কের পরিচয় দেয়া। কারণ, প্রকৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা আর দশটি সাধারণ প্রাণীর মতই প্রাণীজগতের একটি সদস্য মাত্র।
সহায়ক গ্রন্থপুঞ্জিঃ
• The Thin Bone Vault: The Origin of Human Intelligence - Fredric M. Menger
• Descent of Man – Charles Darwin
• Good Natured: The Origins of Right and Wrong in Humans and Other Animals – Frans de Waal
• Black Mischief – David Berlinski
----
অভীক দাস
ব্যবসায় প্রশাসন
৪র্থ বর্ষ ২য় সেমিস্টার
শাবিপ্রবি
[...] ৪. প্রাণীদের সামাজিক আচরণ ও বুদ্ধিমত্তা [...]
ReplyDeleteGood
ReplyDelete