Tuesday, December 10, 2013

হোমো ইরেক্টাসদের কথা

পৃথিবী নামক এই ছোট গ্রহে মানুষ নামক প্রাণীর আগমন ঠিক কবে কিভাবে তা নিয়ে আজও বিতর্কের শেষ নেই। মানুষ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ব্যবহারের চরম শিখরে আরোহণ করলেও এখনও তার রয়েছে অনেক সীমাবদ্ধতা। ঠিক কবে কি হয়েছিল তা জানতে হলে আমাদের চাই ইতিহাসের একেবারে গোড়া থেকে শুরু করা। জানতে হবে পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে শুরু করে মানব জাতির সৃষ্টি ও ক্রমবিবর্তন,আদি মানব জাতির বিভিন্ন নবতর নৃজাতিতে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার ইতিবৃত্ত। সৃষ্টিগতভাবেই মানুষ তার শেকড়ের সন্ধান লাভ করার জন্য সর্বদা তাগিদ লাভ করেছে। জানতে চেয়েছে তাদের আদি পুরুষদের ইতিহাস। কোনো পূর্বনির্ধারিত কথা বা কোনো অলৌকিক ধারণা তাকে ক্ষান্ত করতে করতে পারেনি। জানার জন্য সে আশ্রয় নিয়েছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা এবং তার বুদ্ধিবৃত্তিকে।

আগের যুগের মানুষরা কিন্তু পুরোপুরি বর্তমান আধুনিক মানুষের মত ছিল না। যুগে যুগে নানা পথ পরিক্রমার মাধ্যমেই আমরা আজকের আধুনিক মানবে পরিণত হয়েছি। যার ইতিহাস পাওয়া যায় লক্ষ লক্ষ বছরের পুরানো ফসিল থেকে। ক্রোমাগননকেই আধুনিক মানুষের সাথে সবচেয়ে মিল আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এরও আগে ছিল নিয়ান্ডা্রথাল,হাইডেলবার্গ,জাভা,পিকিং এবং হোমো ইরেক্টাসরা। মানব বিবর্তনের এ ইতিহাস এতো দীর্ঘ আর জটিল যে কেবল একটি লেখা দিয়ে সমগ্র মানব বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। আমি এই লেখাটিতে হোমো ইরেক্টাসদের নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করব।

হোমো ইরেক্টাসের উৎপত্তিস্থল এতদিন ধরে আফ্রিকাকে বলা হলেও সাম্প্রতিককালে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ভিন্নমত দেখা যায়। অধুনা বিজ্ঞানীদের মাঝে কেউ কেউ মনে করেন যে, হোমো ইরেক্টাসের কোনো পূর্বপুরুষ সুদূর অতীতে আফ্রিকা ত্যাগ করে। সেখান থেকে তারা জাভা এবং আফ্রিকায় গমন করে। যদিও জর্জিয়া থেকে শুরু করে চীন এমনকি ইসরায়েলেও হোমো ইরেক্টাসদের নিদর্শন পাওয়া যায়। অনেক বিজ্ঞানীই আফ্রিকান আর এশিয়ান হোমো ইরেক্টাসের মাঝে অনেক অমিল আছে বলে দাবি করেন। সে কারণে তারা আফ্রিকান ইরেক্টাসদের একটি বিশেষ নাম প্রস্তাব করেন। সেটি হল ‘হোমো আরগাস্টার’। কথাটার অর্থ হল কর্মক্ষম মানুষ।

আফ্রিকা,এশিয়া,ইউরোপ জুড়ে একসময় বাস কতো এই হোমো ইরেক্টাসরা। এদেরকে খাঁড়া মানুষও বলা হত।প্রায় ২.৫ মিলিয়ন বছর আগেরকার অস্ট্রালো পিথেকাসদেরকে এদের আদিপুরুষ হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। এদের মগজ ছিল বেশি এবং দেহও ছিল সুগঠিত। বেশ কয়েক ধরণের ইরেক্টাস আছে। এদের মাঝে অন্যতম হচ্ছে পিথিকানথ্রপাস ইরেক্টাস।

পিথিকানথ্রপাস ইরেক্টাস ইন্দোনেশিয়া থেকে আবিষ্কৃত হয়েছিল। এই প্রজাতি আবিষ্কারের কৃতিত্ব ইউজিন দুবোয়ার। দুবোয়া ১৮৫৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৪০ সালে মারা যান।আমস্টারডাম ইউনিভার্সিটির এনাটমির প্রভাষক থাকার সময় তার মাথায় পুরা মানবের ফসিল নিয়ে কাজ এবং ফসিল আবিষ্কারের ঝোঁক চাপে।জার্মান প্রকৃতিবিদ আর্নস্ট হেকেল এবং ইংরেজ পন্ডিত ডারউইনের লেখা পড়ে প্রভাবিত হন দুবোয়া। মাত্র ৩০ বছর বয়সে অন্ধ হয়ে যাওয়া বিজ্ঞানী হেকেল মানুষের বিবর্তন,জীবদেহের গঠন তত্ত্ব, ও সৃষ্টির ইতিহাস নিয়ে ১৮৭০ থেকে ১৮৮০ সালের মাঝে তিনটি বই লিখে সাড়া ফেলে দেন। তিনি জীবজগতের সূচনাকারী হিসাবে ফেনেরন নামক একটি আনুবীক্ষণিক জীবের কথা বলেন। নাম যাই হোক না কেন আধুনিক বিজ্ঞানও কিন্তু স্বীকার করে যে,বিবর্তনের সূচনা হয়েছে আনুবীক্ষণিক জীব থেকেই। হেকেল নরবানর আর মানুষের মধ্যবর্তী যে প্রানীটিকে মানুষের পূর্বপুরুষ বলে কল্পনা করে নিয়েছিলেন তার নামই ছিল পিথিকানথ্রপাস। আর দুবোয়া এই পিথিকানথ্রপাস আবিষ্কারের নেশাতেই পাড়ি জমিয়েছিলেন সমুদ্রের ওপাড়ে।

ওরাং ওটাং অধ্যুষিত পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন দুবোয়া। সামরিক বাহিনীর একজন ডাক্তার হিসেবে ওলন্দাজ শাসিত ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় ১৮৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি পৌছান।১৮৮৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে একটি গুহায় অনুসন্ধান চালিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর একই বছরের জাভার ওয়াদিয়াক এলাকা থেকে একটি প্রাচীন খুলি আবিষ্কার করেন তিনি। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের পূর্ব ভাগে ত্রিনীল নামের একটি গ্রাম ছিল তখন।প্রশান্ত মহাসাগরের নিকটবর্তী হওয়ায় এই এলাকায় ছিল আগ্নেয়গিরির ছড়াছড়ি।কিছু কিছু আগ্নেয়গিরি জীবিত হলেও বাকিরা ছিল মৃত। এলাকার ধার ধরে ছিল সোলো নামের একটি নদী।এই নদীর তীরবর্তী গ্রাম থেকেই দুবোয়া আবিষ্কার করেছিলেন পিথিকানথ্রপাসের ফসিল।

No comments:

Post a Comment