Tuesday, December 10, 2013

বিবর্তনে সান্ধ্যভ্রমন

মিনহাজ ইসলাম


সিইপি ৩/২


 

 

সুদূর নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে মানুষের কাব্যিক মন প্রায়ই উদাস আর স্তম্ভিত হয়ে থাকে। আমাদের দেহের প্রতিটি পরমানু একসময় এরকম কোন নক্ষত্রের অভ্যন্তরে আলো তৈরি করতো অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে। নক্ষত্র হতে ছুটে আসা গ্যাসীয় মণ্ড একসময় শীতল হয়ে তরল লাভা এবং সেই তরল লাভা বুড়িয়ে গিয়ে তৈরি হয় আমাদের চারপাশের পরিচিত পৃথিবী। কিন্তু এর মাঝেও মহাবিশ্ব এক দীর্ঘ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। বিগ ব্যঙ্গের একেবারে প্রাথমিক দিকে শুধুমাত্র কয়েকটি হালকা পরমানুর অস্তিত্ব ছিল। যেমন হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, ডিউটেরিয়াম,লিথিয়াম ইত্যাদি। পরবর্তীতে নক্ষত্রের মধ্যে অতিউচ্চ তাপমাত্রায় ফিউশন ঘটতে থাকে এবং তৈরি হয় কার্বন , অক্সিজেন,আয়রনের মত ভারী মৌল। কিন্তু এর থেকেও ভারী মৌল প্রকৃতিতে দেখতে পাওয়া যায় যাদের তৈরি হয় একটু ভিন্নভাবে, সুপারনোভা বিস্ফোরণে নিউট্রন ক্যাপচার বিক্রিয়ায়। এভাবেই ধাপে ধাপে এক মৌল থেকে অন্য মৌলের বিবর্তনের মাধ্যমে মহাবিশ্ব আজকের অবয়ব লাভ করে। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপারটি ঘটে আমাদের পরিচিত পৃথিবীতে। এখানে উদ্ভব ঘটে পরমানুর নতুন কম্বিনেশন যারা সম্মিলিতভাবে কিছু নির্দিষ্ট কার্য সম্পাদনে সক্ষমতা লাভ করে যাকে জীব অনু বলা হয়। এখানে বিচরণ করে হিংস্র বাঘ, সিংহ , হায়েনার মত প্রাণী; সুনীল সাগরের বুকে ভেসে বেড়ায় তিমি , হাঙরের মত প্রকাণ্ড জলচর; সর্বোপরি দাবড়ে বেড়ায় মানুষের মত উন্নত মস্তিষ্কের কোন সত্ত্বা। বছরের পর বছর ধরে মানুষ খুঁজে বেড়িয়েছে যৌক্তিক কারণ। কিন্তু এ যেন থেকে যাচ্ছিল স্বপ্নের রাজকন্যার মতই অস্পৃশ্য। তবুও মানুষের অনুসন্ধিৎসু মন থেমে থাকেনি। অবশেষে ঘটে সেই যুগান্তকারী ঘটনা। প্রকৃতির প্রতি অমোঘ আকর্ষণে ২২ বছরের এক তরুন প্রকৃতিবিদ বাবার অমতেই করে বসে একটি সাহসী কাজ। দক্ষিণ এমেরিকার সম্পূর্ণ ভৌগোলিক মানচিত্র তৈরি করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি সমুদ্রযাত্রার ব্যাবস্থা করা হয় যেখানে তরুন গবেষক হিসেবে তাকে নেয়া হয়। তরুন ডারউইন যখন বীগলে করে সমুদ্রের বুকে যাত্রা করলেন তখন হয়তো কেউই জানতোনা মানব সভ্যতাও ছুটে চলেছে বিগলের পিছুপিছু। সমুদ্র অভিযানে বিগল অসংখ্য দ্বীপ এবং উপকূলীয় এলাকা পরিদর্শন করে। সেই সাথে ডারউইন সংগ্রহ করেন অসংখ্য প্রাণীর ফসিল এবং সতর্কতার সাথে দ্বীপএলাকা পর্যবেক্ষণ করে কিছু বিস্ময়কর তথ্য খুঁজে পান।

** সমুদ্র থেকে ৩০০ কিলোমিটার বা তার অধিক ভিতরের কোন দ্বীপে তিনি কোন স্থলজ ম্যামেল(বাঘ, সিংহ সহ উষ্ণ রক্তের এবং লোম আবৃত প্রাণী) খুঁজে পাননি যদিও সে সকল দ্বীপ অত্যন্ত প্রাচীন ছিল।

** বিভিন্ন দ্বীপে এমন কিছু এনডেমিক জীবের সন্ধান পাওয়া যায় যা পৃথিবীর অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়না।

** পাখি এবং বাদুড় যেহেতু উড়তে পারে ফলে বিভিন্ন দ্বীপের মধ্যে তাদের বিনিময় ঘটে কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হল প্রত্যেকটি দ্বীপের নিজস্ব আবহাওয়ার ভিত্তিতে তাদের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য তৈরি হয়েছে যদিও তারা একই জীব।

এ সকল পর্যবেক্ষণের একটাই অনুসিদ্ধান্ত থাকতে পারে আর তা হচ্ছে স্থলভূমি থেকে পৃথক এসব স্থানে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে জীবের বিকাশ ঘটেছে এবং জীবের গঠন সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে স্থানীয় পরিবেশ পরিস্থিতির উপর। একই আদিম পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভুত না হলে তাদের শরীরবৃত্তীয় বিস্ময়কর সামঞ্জস্য থাকা সম্ভব হতো না। ডারউইনের সময়ে বংশগতিবিদ্যা অথবা জীনতত্ত্ব নিয়ে তেমন ধারনাই ছিল না। ফলে ডারউইন তার পর্যবেক্ষণ এবং ফসিল রেকর্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্য প্রকাশ করতে বেশ সন্দেহ প্রকাশ করেন। কিন্তু ১৮৫৬ সালে ওয়ালেস যখন ডারউইনের কাছে একই সিদ্ধান্ত নির্ভর প্রবন্ধ পাঠান তখন ডারউইন তার বিখ্যাত গ্রন্থ  “on the origin of species by means of natural selection”  প্রকাশ করেন। যেখানে ব্যাখ্যা করা হয় কিভাবে একটি জীব তার পূর্ববর্তী প্রজাতি থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে উদ্ভুত হয় আর সেই জীবের প্রকৃতিতে টিকে থাকা নিয়ন্ত্রিত হয় প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে। যদিও পর্যাপ্ত কোষীয় তথ্যের অভাবে ডারউইন অনেক কিছুই ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি এমনকি তিনি প্রজাতিকে সংজ্ঞায়িত করতেও ব্যর্থ হন। তবে জীবজগতকে বোঝার ক্ষেত্রে ডারউইন যে পাজল বক্সকে উন্মোচন করেন তার জন্য তিনি মানব সভ্যতায় টিকে থাকবেন একজন শক্তিশালী প্রকৃতিবিদ হিসেবেই।

এর পরের ইতিহাস শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়া। শারীরবিদ্যা , বংশগতিবিদ্যা, জীনতত্ত্ব, চিকিৎসাশাস্র , অণুজীববিদ্যা সহ জীববিজ্ঞানের সকল শাখার অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটে আর বিবর্তনের প্রকৃতি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিবর্তনের সূচনা ঘটে জেনেটিক পর্যায়ে। মিউটেশন, জেনেটিক রিকম্বিনেশন, DNA প্রতিলিপি তৈরির সময় জীবের জীনগত পরিবর্তন ঘটতে পারে। জীবের দেহের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষন ও তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে নিয়ে যায় DNA র একটি নির্দিষ্ট অংশ যাকে জিন বলে। জিনের মধ্যে তথ্য সংরক্ষিত হয় নিউক্লিওটাইডের সজ্জাক্রমের উপর ভিত্তি করে। একটি নিওক্লিওটাড তিনটি অংশে বিভক্ত থাকে, একটি পেনটোজ সুগার, একটি নাইট্রোজেন ক্ষার এবং একটি ফসফেট। মোট চার ধরনের নাইট্রোজেন ক্ষার থাকে নিওক্লিওটাইডে । এ চারপ্রকার ক্ষার একটি নির্দিষ্ট  জিনে নির্দিষ্ট সজ্জাক্রম অনুসরণ করে। দুটি পাশাপাশি নিওক্লিওটাইডের ক্ষার অংশ হাইড্রোজেন বন্ধন দ্বারা যুক্ত থাকে। DNA প্রতিলিপি তৈরির সময় এ হাইড্রোজেন বন্ধন ভেঙ্গে যায় এবং ডাবল হেলিক্সের দুটো অংশে নতুন ক্ষারীয় সংযোগ ঘটে কিন্তু সজ্জাক্রম একই থাকে। মাঝে মাঝে ডিএনএ প্রতিলিপি তৈরির সময় ভুল সজ্জাক্রম তৈরি করে । এতে সমগ্র জিনের কার্যাবলী পরিবর্তিত হয়ে যায়। এছাড়া রেডিয়েশনের প্রভাবে ডিএনর ফসফেটের মধ্যে বন্ধন ভেঙ্গে যায় এবং ডিএনএ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। জীবকোষ এসকল অংশ পুনরায় যুক্ত করার কাজ করে এতে কিছু ভুল সংযোগ প্রতিষ্ঠা পায়। এভাবে একটি জিন থেকে সম্পূর্ণ নতুন জিনের উদ্ভব ঘটে।এ প্রক্রিয়াকে মিউটেশন বলে। জীবের প্রজননে মিয়োসিস কোষ বিভাজন ঘটে। এতে সমগোত্রীয় ক্রোমসোমের মধ্যে তথ্য বিনিময় ঘটে। বিভিন্ন ডিএনের মধ্যে জিনের মিশ্রণ ঘটে। এর মাধ্যমেও জিনের নতুন সজ্জাক্রম পাওয়া সম্ভব। এভাবে পরিবর্তিত জিন বংশানুক্রমে প্রবাহিত হয় এক জনু থেকে আরেক জনুতে যেখানে তারা জীবের গঠনকে নতুনরূপ দিতে সক্ষম। এটি অবশ্যই একটি দীর্ঘ এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এ সকল জীবের পরিবর্তিত সব গঠনই কি প্রকৃতিতে টিকে থাকে কিনা । এ বিষয়টি বুঝতে হলে ডারউইনের পর্যবেক্ষণের দিকে ভালোভাবে দৃষ্টি দেয়া জরুরী। যেখানে তিনি মতামত দেন যে প্রকৃতিতে শুধুমাত্র টিকে থাকে স্থানীও অঞ্চলের জন্য সবচেয়ে উপযোগী গঠন যারা একই খাদ্য-শৃঙ্খলের অন্যান্য সদস্যদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকে। একেই তিনি নাম দেন প্রাকৃতিক নির্বাচন।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে তবে কেন প্রকৃতিতে কোন অর্ধবিকশিত বা অসম্পূর্ণ প্রাণী দেখা যায়না যেখানে জীনগত বিবর্তন যেকোনো দিকে ঘটা সম্ভব। উত্তর হচ্ছে অর্ধবিকশিত মানেই কিন্তু অসম্পূর্ণ নয়। যে কোন প্রজাতি তার তথাকথিত ‘অসম্পূর্ণতা’ নিয়েই তার মত করে বিকশিত হতে পারে।  যেমন,  আমাদের চোখ পূর্ণ বিকশিত এবং সয়ংসম্পূর্ণ ভাবা হলেও  মানুষের চোখ ঈগলের চোখের মত এত দূর থেকে শিকার খুঁজে নিতে পারে না, প্যাঁচা বা বিড়ালের চোখের মতো রাতে দেখতে পায় না, বহু মাছের চোখের মত রঙের প্রতিসরণ সনাক্ত করতে পারে না,  কিংবা মৌমাছির মত অতিবেগুনী আলোতে সংবেদনশীল নয়।  তাহলে কিভাবে দাবী করা যাবে যে আমাদের চোখ পূর্ণবিকশিত এবং সয়ংসম্পূর্ণ?

একই যুক্তি খাটে পাখার ক্ষেত্রেও, আমরা  চারপাশে আংশিক পাখাসহ প্রচুর প্রাণী দেখতে পাই। টিকটিকি, ব্যাঙ, শামুক জাতীয় গ্লাইড করে চলে এমন অনেক প্রাণীর মধ্যেও আংশিক পাখার মত অংশ দেখতে পাওয়া যায়। কাঠবিড়ালি সহ কিছু প্রাণীতে আংশিক পাখার অস্তিত্ব আছে যা পূর্ণ বিকশিত না হওয়া সত্ত্বেও টিকে থাকতে বাড়তি সাহায্য করে।

বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী এবং আধুনিক বিবর্তনবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা থিওডসিয়াসডাবঝানস্কি বলেছিলে- “বিবর্তনের আলোকে না দেখলে জীববিজ্ঞানের কোন কিছুরই আর অর্থ থাকে না।”

বিবর্তনকে জীববিজ্ঞানে ‘থিওরি অব এভ্রিথিং’ বলে গণ্য করা যায়। বিবর্তনের পক্ষে অন্যতম জোরালো প্রমাণ হল - কোন ফসিলই 'ভুল স্তরে' পাওয়া যায়নি। একবার বিজ্ঞানী জেবি এস হালডেনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কিভাবে বিবর্তনকে ভুলপ্রমাণ করা যায়? উত্তরে হালডেন বলেছিলেন,

“প্রিক্যাম্বিয়ান যুগে কোন খরগোশের ফসিল খুঁজে পাওয়াই যথেষ্ট”।

অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স  এবং জেরি কয়েন তাদের একটি প্রবন্ধে বলেছেন -

সত্যি কথা বলতে কি, একটি খাঁটি ফসিলও এখন পর্যন্ত কোন ‘ভুল’ জায়গায় পাওয়া যায়নি - যা বিবর্তনের ধারাবাহিকতাকে ক্ষুন্ন করতে পারে। যদি এমন কোন ‘বেমানান’ ফসিল কখনও পাওয়া যেত, তাহলে এক নিমেষেই বিবর্তনতত্ত্বের সলিল সমাধি ঘটতো।

আধুনিক জীববিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ববিজ্ঞান, জেনেটিক্স, জিনোমিক্স এবং আনবিক জীববিদ্যার সকল শাখাতেই বিবর্তনের পক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিছু  সাক্ষ্য এখানে উল্লেখ করা হল –

**  প্রকৃতিতে ৩২০ রকমের এমাইনো এসিড পাওয়া গেলেও দেখা গেছে প্রতিটি জীব গঠিত হয়েছে মাত্র ২০টি এমাইনো এসিডের রকমফেরে। সকল জীবের ডিএনএ অনুর গঠন একক বেসও একই ধরনের। মাত্র চার প্রকার বেস (এডেনিন, গুয়ানিন, থাইমিন ও সাইটোসিন) দিয়ে সকল জীবের ডিএনএ গঠিত। আসলে সকল জীবের উৎপত্তি যদি একই উৎস থেকে বিবর্তিত না হয়ে থাকে তবে আধুনিক জীববিদ্যার এ সমস্ত তথ্য অর্থহীন হয়ে পড়ে।

 

** সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতি উদ্ভুত হলে প্রজাতিগুলোর মধ্যে একটা সম্পর্ক থাকবে, এ সমস্ত কিছুকে জাতিজনি বৃক্ষ (Phylogenetic tree) আকারে সাজানো যাবে। সেটাই বাস্তবে দৃশ্যমান।

 

 

** রক্তরস বিজ্ঞান থেকেও বিবর্তনের পক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে । রক্তকে জমাটবদ্ধ হতে দিলে যে তরল পদার্থ পৃথক হয়ে আসে তার নাম সিরাম। এতে থাকে এন্টিজেন। এ সিরাম এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে প্রবেশ করালে উৎপন্ন হয় এন্টিবডি। যেমন মানুষের সিরাম খরগোশের দেহে প্রবেশ করালে উৎপন্ন হয় এন্টি হিউম্যান সিরাম। এতে থাকে এন্টি হিউম্যান এন্টিজেন। এ এন্টিহিউম্যান সিরাম অন্য মানুষের সিরামের সাথে মেশালে এন্টিজেন এবং এন্টিবডি বিক্রিয়া করে অধঃক্ষেপ বা তলানি উৎপন্ন হয়। এই অ্যান্টি হিউম্যান সিরাম নরবানর, ‘পুরনো পৃথিবীর’ বানর, লেমুর প্রভৃতির সিরামের সাথে বিক্রিয়া করালে দেখা যাবে, যে প্রাণীগুলোর সাথে মানুষের সম্পর্কের নৈকট্য যত বেশি তলানির পরিমাণ তত বেশি হয়। পুর্বোক্ত প্রাণীগুলোর মধ্যে বিক্রিয়ার অনুক্রম হল :

 

মানুষ   নরবানর   পুরোন পৃথিবীর বানর   লেমুর

এন্টিজেন-এন্টিবডি বিক্রিয়া বিবর্তনের ধারাবাহিকতা সমর্থন করে।

 

 

** স্বতন্ত্র ভাবে কিংবা সমান্তরাল পথে ঘটা বিবর্তনও পরীক্ষিত। যেমন, পাখি, বাদুড় কিংবা পতঙ্গের পাখা উড়তে সহায়তা করলেও এদের গঠন এবং উদ্ভব ভিন্নভাবে হয়েছে।

 

বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে বিবর্তনবাদ ভবিষ্যৎবাণী করতে পারে।  কিন্তু কয়েক কোটি বছর পর কোন একটি প্রজাতিতে ঠিক কিরূপ পরিবর্তন ঘটবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়না। বিজ্ঞানের অংশ হতে হলে নিশ্চয়তাবাদী দর্শন প্রচার করার বাধ্যবাধকতা নেই।কোয়ান্টাম বলবিদ্যা খুব সার্থকভাবেই বিজ্ঞানের অংশ হয়ে টিকে আছে, নিশ্চয়তাবাদী ধর্ম না থাকা সত্ত্বেও।

 

এরকম একটি মজার ভবিষৎবাণীর উল্লেখ করা যায়। ডারউইন লন্ডনের এক গ্রীন হাউসে মাদাগাস্কারের বিশেষ একটা অর্কিড দেখেন যার মধু রাখার পুষ্পাধারটি ১১ ইঞ্চি লম্বা। তিনি তা দেখে মন্তব্য করেন যে, মাদাগাস্কারের যে জায়গায় এই অর্কিডটা দেখা যায়, সেখানে এমন এক ধরনের মথ জাতীয় কোন পোকা থাকতেই হবে যাদের শুর বা হুল হবে একই রকমের লম্বা। কারণ এই লম্বা মধুর পুষ্পাধারের ভিতর শুর ঢুকিয়ে মধু খাওয়ার সময়ই মথগুলো অর্কিডটার পরগায়ন ঘটাবে। এবং তাইই হলো - কয়েক দশক পরে বিজ্ঞানীরা ঠিকই খুঁজে  পেলেন সেই মাদাগাস্কার স্ফিংস মথ   (Xanthopan morganii praedicta )।

বিবর্তন সংক্রান্ত এরকম অনেক ভবিষ্যদ্বানীই সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। যেমন,

** ডারউইন সমসংস্থার (homologies) উপর ভিত্তি করে  ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন যে, মানুষের আদি উৎস আফ্রিকা থেকে বিবর্তিত হয়েছে। পরবর্তীতে ফসিল রেকর্ড এবং বংশগতিবিদ্যা থেকে পাওয়া সাক্ষ্যের সাথে এই ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যায়।

 

** বিবর্তন তত্ত্ব থেকে  ভবিষ্যদ্বানী করা হয়েছিলো যে, আমরা বিভিন্ন সময়ের স্তর অনুসারে  বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য ফসিল খুঁজে পাব। তাই পাওয়া গেছে।

 

** ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী, সীমিত সম্পদ আহরণের জন্য প্রজাতিদের মধ্যে আন্তঃপ্রজাতি (inter-species) এবং প্রতি প্রজাতির মধ্যে জীবে জীবে (intra-species) প্রতিযোগিতা হয়। বিবর্তন তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বানী অনুযায়ী, প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বেশিরভাগ প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে যাবে, টিকে থাকবে খুব ক্ষুদ্র একটা অংশ। বিজ্ঞানীরা বলেন ঠিক তাই ঘটেছে -  পৃথিবীতে যত প্রাণের অভ্যুদয় ঘটেছিলো, তার প্রায় শতকরা ৯৯ ভাগই আসলে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফসিল রেকর্ড থেকেও এই দাবীর সত্যতা মেলে।

 

** বিবর্তন তত্ত্ব থেকে ভবিষ্যদ্বানী করা হয়েছিলো যে,  যে সমস্ত বিষম-সত্ত্বাবিশিষ্ট (heterogeneous) জীবেরা দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিবেশে বাস করে তাদের মিউটেশন বা পরিব্যক্তির হার অনেক বেশি পাওয়া যাবে। ক্রনিক সিস্টিক ফাইব্রোসিস রোগির ফুসফুসে  ব্যক্টেরিয়া সংক্রমণ থেকে এই ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা পাওয়া গেছে।

** ১৯৫৪ সালে বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী আর্নেস্ট মায়ার ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন যে দ্রুত বংশগতীয় বিবর্তন প্রজাতিকরণে ভুমিকা রাখবে। পরবর্তীকালের জাতিজনি বিশ্লেষণ (phylogenetic analysis) এই ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা তুলে ধরেছিলেন।

** বহু গবেষক ক্রানিয়েটদের (craniates) পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট নিয়ে পূর্বে ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন। পরবর্তী সমীক্ষায় বিজ্ঞানীরা Haikouella -এর সন্ধান পান যা পূর্বপুরুষ সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে অবিকল মিলে যায়।

** জীবজগতের 'হারানো যোগসূত্রের' (missing link) বিভিন্ন  বৈশিষ্টের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো পরবর্তীতে জাতিজনি বৃক্ষের সাথে খাপ খেয়ে যায়, এটা বহুবার বহুভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

 

** মাছ এবং উভচরের মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্যযুক্ত ফসিল টিকট্যালিকের সন্ধানপ্রাপ্তি বিবর্তনের ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা তুলে ধরে। বিবর্তন যেহেতু সাধারণত ধীর গতিতে ঘটে নির্দিষ্ট একটা সময় জুড়ে এমন কিছু মাছের ফসিল অবশ্যই পাওয়া যাবে যাদের মধ্যে পাখনা এবং পায়ের মধ্যবর্তী গঠন দেখা যাবে। কানাডার উত্তর মেরু অঞ্চলে এলস্মিয়ার দ্বীপে ২০০৪ সালে দেখা পাওয়া গেল বিখ্যাত ফসিল টিকট্যালিকের।

 

 

এইডস রোগের জন্য দায়ী HIV ভাইরাসের কথা আমরা জানি। কিন্তু কেন এই ভয়াবহ রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে হাজার হাজার গবেষককে নাকানি চুবানি খেতে হচ্ছে তা হয়তো অনেকেই জানি না। HIV ভাইরাসের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মিউটেশন এবং ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের’ মাধ্যমে গঠনগত বৈচিত্র্য তৈরি করা। যখনই HIV নিরাময়ে কোন প্রতিষেধক ব্যাবহার করা হয় তখন তার ডিএনএ তে মিউটেশন ঘটে যায় এবং নতুন জেনেটিক কোড প্রতিষেধকের কার্যকারিতা নস্যাৎ করে দেয়।

 

ইভুলিউশনের ধারনার পাশাপাশি যে বিষয়টি আলোচনায় আসে তা হল কিভাবে পৃথিবীর প্রাথমিক সময়ে গ্যাসীয় পরমানু থেকে জৈব অনু যেমন প্রোটিনের উদ্ভব ঘটে। ১৯৫৩ সালে মিলার একটি ল্যাবরেটরি পরীক্ষার ব্যাবস্থা করেন যেখানে তিনি পৃথিবীর প্রাথমিক অবস্থায় ছিল এমন কিছু অনু যেমন মিথেন, পানি ,অ্যামোনিয়া,হাইড্রোজেন নেন। এরপর তিনি পৃথিবীর প্রাথমিক আবহাওয়া তৈরির চেষ্টা করেন যেখানে অণুগুলোর মিশ্রণকে উচ্চ তাপে ফুটাতে থাকেন এবং পুনরায় ঘনীভূত করেন। এভাবে তিনি প্রাথমিক প্রাণঅণু অ্যামাইনো এসিড তৈরি করতে সমর্থ হন। মিলারের পরীক্ষার পর এ পরীক্ষাটি বিভিন্নভাবে বিভিন্ন বিজ্ঞানী করেন এবং জীবের প্রোটিন অণু তৈরীতে ব্যবহৃত ২০ টি অ্যামাইনো এসিডের মধ্যে ১৭ টি তৈরি করতে সমর্থ হন।

 

১৯৬৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ার মারকিশনে একটি বৃহৎ উল্কাপাত ঘটে যার মধ্যে বিভিন্ন জৈব অণু যেমন পিউরিন এবং পাইরিমিডিনের সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়া মঙ্গল হতে বিচ্যুত ALH84001 উল্কার মধ্যেও বেশকিছু জৈবঅনুর সন্ধান পাওয়া যায় যার থেকে আরেকটি সম্ভাবনার উদ্ভব ঘটে যে প্রান অনুর আগমন মহাশূন্য থেকেও হতে পারে। মহাশূন্যে তীব্র রেডিয়েশনের মধ্যে জৈব অনুর উদ্ভব ঘটতে পারে।

 

জীনগত পরিব্যাপ্তি এবং বিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া। একটি প্রজাতি থেকে আরেকটি প্রজাতির উদ্ভব কোটি কোটি বছরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীনগত পরিবর্তনের ফল। সরল ভাইরাস থেকে অত্যন্ত জটিল শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার অধিকারী মানুষের মধ্যেও যা ঘটে যাচ্ছে নিরলস ভাবে, নিরবিচ্ছিন্ন সময় ধরে।

No comments:

Post a Comment