Wednesday, December 11, 2013

আয়েশার দিনরাত্রী

এস এম মনির


পরিসংখ্যান ৩/২


 

২০০৫ সালের নভেম্বরের ০৬ তারিখ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে, ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা। ছাত্রী হিসেবে আয়েশা মন্দ না। বাবা মার স্বপ্ন একমাত্র সন্তান একদিন বড় ডাক্তার হবে। কিন্তু মেডিকেলে চান্স হলো না। অবশ্য আয়েশা কখনোই ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখেনি। ওর স্বপ্ন বড় লেখক হবে। হুমায়ুন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আমিনুল হকদের মতো বড় লেখক। মুহম্মদ জাফর ইকবাল ওর সবচেয়ে প্রিয় লেখক। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বিভাগীয় প্রধান, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। আর সেজন্যই হয়তো ওর স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় এটা। সাথে সাথে অবশ্যই সি. এস. ই ডিপার্টমেন্ট।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ না পেলেও সাস্ট আয়েশাকে আটকাতে পারে না। তবে সি.এস.ইতে ভর্তি হতে পারে না। শেষমেষ, বাধ্য হয়েই ভর্তি হয় জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনলটি (জি.ই.বি) বিভাগে। ২০০৬ সালের ২৮ জানুয়ারি, মুক্তমঞ্চে ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের পরিচিতি পর্ব অনুষ্ঠান। শিক্ষামন্ত্রী, সচিব সহ আরো অনেকেই এসেছেন আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে। সবাই নতুন ভর্তি হওয়া সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বক্তৃতা করলেন। সবশেষে আসলেন ড. জাফর ইকবাল। এই প্রথম আয়েশা তার প্রিয় লেখককে সামনা সামনি বসে দেখছে। তার উত্তেজনা যেন ধরে না। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ও স্যারের কথা শুনছে। ওর মনে হচ্ছে স্যারের সব কথাই যেন শুধুমাত্র তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা।

যথারীতি অনুষ্ঠান শেষে নতুনরা ছুটলো তাদের ডায়রীতে স্যারের অটোগ্রাফ নিতে। আয়েশাও সুযোগটা হাতছাড়া করলো না।

ক্লাস শুরু হয়ে গের ফেব্র“য়ারিরর প্রথম সপ্তাহ থেকেই। এখন সে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বা সাষ্টের প্রথম বর্ষ প্রথম সেমিষ্টারের (১/১) এর গর্বিত ছাত্রী। হোক না সেটা জিইবি ডিপার্টমেন্ট, তাতে কিছু আসে যায় না। সে তো আর এখানে ইঞ্জিনিয়ার হতে আসেনি, এসেছে বড় লেখক হতে। ওর উদাহারণ হিসেবে আছে আনিসুল হক, বুয়েট থেকে পাশ করা বড় লেখক।

নতুন জায়গা, নতুন জীবন, নতুন হল, নতুন বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে স্বপ্নের মতোই কাটছে আয়েশার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। আড্ডা, গান, গল্প, আবৃত্তি, নাটক এসব নিয়েই আয়েশার দিনরাত্রী। ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সংগঠনের একটার পর একটা আয়োজন যেন লেগেই আছে। হাতে একটুও সময় নেই বই নিয়ে বসার। অচিরেই ওর পরিচিতি হয়ে উঠলো ক্লাসের সবচেয়ে ফাকিবাজ আর অমনোযোগী ছাত্রী হিসেবে।
অবশ্য সে যে লেখক হবে তারও কোন লক্ষণ নেই। মাথা থেকে কোন শব্দই বেরোতে চায় না, লিখতে বসলে। অনেক চেষ্টা করে একটা গল্প লিখেছিল বটে কিন্তু কোথাও ছাপাতে পারেনি। আর এই দুঃখে সে লেখক হবার চিন্তা বাদ দিয়ে দিয়েছে, এক রকম। ছোট্র একটা ক্যাম্পাস, তার ওপর যত্রতত্র ধান ক্ষেত, এখানে সেখানে পাহাড় টিলা, টিলার ওপর একশ ধাপ পেরিয়ে শহীদ মিনার, অহেতুক লম্বা এককিলো মিটার লম্বা প্রবেশ পথ। এরকমই হয়তো মনে হবে প্রথমবার সাস্টে আসা যে কারোর। কিন্তু সেই প্রথমদিন থেকেই এগুলোই যে সাস্টের প্রধান আকর্ষন বুঝতে একটুও ভূল হয়নি আয়েশার। বিশেষ করে, এক কিলেতে শীতের সকালে হাটতে হাটতে রোদ পোহানো, আর রাতে লেডিস হলের জানালা দিয়ে সুদুর মেঘালয়ের মিটমিট করে জ্বলা পাহাড়ী জীবনের যেনো কোন তুলনাই চলে না। এদিকে প্রিয় বন্ধুরা আর বেস্টফ্রেন্ড তুহিনতো আছেই। সাস্টের ওর সময়গুলো যে কিভাবে পার হচ্ েআছেই। সাস্টের ওর সময়গুলো যে কিভাবে পার হচ্ছে ওযেন টেরই পাচ্ছিলনা।

সেমিস্টার সিস্টেমে চোখের পলকে কখন যে টার্মটেস্ট, ল্যাব, শেষ করে ১/১ এর সেমিস্টার ফাইনাল চলে আসলো আয়েশা বুঝতে পারে নি। আগে থেকেই সব পড়া গুছিয়ে না রাখার ফলাফল সে পরীক্ষার আগে হাড়ে হাড়ে টের পেলো। পরীক্ষার আগে রাতদিন পড়েও লাভ হচ্ছিল না। প্রত্যেক পরীক্ষাতেই চোখে সরষে ফুল দেখার জোগাড়! ইংরেজী, কেমেস্ট্রি, মাইক্রোরায়োলজি, প্লান্ট সায়েন্স আর অ্যানিমেল সায়েন্স কোন রকমে ভাল মন্দ কিছু গ্রেড পেয়ে উতরে গেলেও কনসেপ্ট অব জিইবিতে পাশই করতে পারলোনা। ফলাফল ড্রপ!

কোষ জীবদেহের সবচেয়ে ক্ষুদ্র একক। খালি চোখে দেখা যায় না। সেই কোষের মধ্যেই থাকে নিউক্রিয়াস। কোষের প্রাণ। সেই নিউক্লিয়াসেই থাকে সুতার মতো ক্লোমোসোম। আর ক্লোমোসোমেই নাকি থাকে জীবনের ব্লু প্রিন্ট ডিএনএ, দ্বিসূত্রক, হাইড্রোজের বন্ডসহ সাসাস কিছু। এসবই নাকি তাকে পড়ে হবে সারা জীবন। ভাবতেই আয়েশার গা গুলিয়ে আসে। সেকি আদৌ তার পড়ালেখা শেষ করতে পারবে? অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিস, থাইমিন কি সব বিদম্বটে নাম।

পড়াশুনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে নিজেকে প্রথম বর্ষ ২য় সিমিস্টরের ছাত্রী হিেিসব আবিস্খার করে। লেখক হবার চিন্তা বাদদিয়ে সে আপাতত ফটোগ্রাফার হবার স্বপ্নে বিভোর। থাকতো যদি সুমন ভাইয়ের মতো একটা উঝওজ ক্যামেরা। সুমন পরিসংখ্যান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। কি এক প্রতিযোগিতায় তার তোলা ছবি প্রথম হয় আর সে বছর টাইম ম্যাগাজিন সেই ছবি ব্যবহার করে আগস্ট ০৫ তারিখ সংখ্যার বাংলাদেশ শিরোনাম একটা প্রবন্ধ ছাপে। রাতারাতি সুমন তারকা বনে যায় শুধু সাস্ট ক্যাম্পাসে না সারা দেশ। হাতের কাছেই এমন উদাহরণ থাকলে কে না চাইবে ফটোগ্রাফার হতে। অনেক চেষ্টা করে বাবা থাকে রাজি করিয়ে একটা উঝখজ কেনে বটে। কিন্ত যন্ত্রটা কেনার পরই যেন ওর ছবি শখ মিটিয়ে যায়। কেন যানি আর ছবি তুলতে ভাল লাগে না।

এদিকে দেখতে দেখতে আবারো সেমিস্টার ফাইনাল। প্রথম বর্ষ ২য় সেমিস্টার। এবার একটা নয় দু’দুটা সাবজেক্ট ড্রপ চলে আসে। মেটাবলিজম আর ইনভ্নামেন্টাল বায়োটেকনোলজিতে। এই যখন অবস্থঅ তখন আয়েশা আবারো নিজেক আবিস্কার করে ২য় বর্ষে ১ম সেমিস্টারে ছাত্রী হিসেবে।  ২০০৭ সালের ফেব্র“য়ারী ০৩ তারিখে জিইবি এবং সিত্রসই বিভাগ মিলিত ভাবে একটা তিনদিন ব্যাপি সেমিহস্টার আয়োজন করে “ঝঊগওঘঅজ ঙঘ এঊঘঊঞওঈঝ অঘউ ঈঙগচটঞওঘএ”.বক্তারা দেশ বিদেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা। আয়েশা মূলত তুহিনের জোড়াজুড়িতেই সেমিনারের জন্য রিজিস্টেশন করে।

উদ্বোধনী সেশনের পরেই প্রথম বক্তা হিসেবে আসেন আয়েশার প্রিয় জাফর স্যার। সেদিনের স্যারের প্রেজেন্টেশনই আয়েশার জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল। স্যারের প্রেজেন্টেশনের নামছিল “জীবনের নীল নকশ;উঘঅ”স্যারের শুরুটা ছিল এমন “বিজ্ঞানের কোন তত্ত্ব যদি তুমি তোমার কাজের লোককে বোঝাতে না পার তাহলে বুঝাতে হবে তুমি নিজেই সেই তত্ত্বটি বোঝেনি। প্রকৃতি জটিলতা পছন্দ করে না। তাইতো প্রকৃতির সবকিছুই সহজ সরল। তেমনি জীবিত প্রাণীর মুল ব্যাপারটিও অত্যন্ত সহজ সলে। একটি মানুষ ছেলে হবে না মেয় হবে বেট না লম্বা, ফর্সা না কালোপ, টাকমাথাওয়ালা না টাকবিহীন, রাগী না নরম স্বভাবের হবে খুটিনাটি সব তথ্যই থাকে উঘঅ নামক অঞএঈঈএঞঅঅঞ

.........সূত্রে................

প্রাজল উপস্থাপনার পাশাপাশি প্রজেক্টের ছবির মাধ্যমে সবকিছূ ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছিলেন। সেদিহন আয়েশার একটি কথাই বারবার মনে হচ্ছি কেন সে জিইবির মাত রোমাঞ্চকর বিষয়টাকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল এতোদিন। সবশেষে স্যার জেনেটিক্সের সাথে কম্পিউটিং কিভাবে জড়িত ব্যাখ্যা করেছিলেন। পরবর্তি দু’দিনে সে বেশ বড় ক্যানভাসে জেনেটিক্সের বিভিন্ন মজার এবং জটিল কিন্তু চমকপ্রদ বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে। সত্যি কথা বলতে কি, ব্যাপারগুলো একজন জিইবির ছাত্রী হিসেবে সে আগে থেকেই একটু আধটু জানতো কিন্তু কখনোই ব্যাপারগুলোকে অন্তর দিয়ে অনুভব করেনি। এই তিনদিনের সেমিনার তাকে জিইবি সম্পর্কে দারুনভাবে অনুপ্রাণিত করে। সে দেশী বিদেশী বড় বড় জিন বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে জানতে পারে। ড. মাকসুদুল আলম, বাংলাদেশের বড় জিন বিজ্ঞানী, জানতে পারেণ এখানে এসেই। একজন ভাল বিজ্ঞানীই যে পারেন তার কাজের মাধ্যমে সভ্যতাকে পরিবর্তন করতে পারে, সে অনুভব করে। এবার সে সত্যিকার অর্থেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বড় বিজ্ঞানী হবার।

সেমিনার শেষ। আয়েশা পড়াশুনায় মনযোগ দেয়। সেমিনার করার আগের আয়েশা এবং পরে আয়েশার মাঝে যে রাতদিন তফাত বন্ধুরা সবাই বুঝতে পারে। আস্তে আস্তে নিজেকে গুছিয়ে নেয় সে। নিয়মিত পড়াশুনা, ল্যাবের কাজ, লাইব্রেরীতে পড়াশুনা সবই চলতে থাকে সমান তালে। সেকেন্ড ইয়ার ফাস্ট সেমিস্টার অনেক ভাল ফলাফল করে। আর সে বছর ২য় সেমিস্টারে আয়েশা ফাস্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়। তবে তুহিনের সাথে পেরে ওঠে না, বরাবরের মতো সেবারও তুহিন ফাস্ট হয়, অবশ্য ৩/১ এ গিয়েই নাকি আয়েশা তুহিনকে ২টিয়ে প্রথম হবে একথাও তুহিনকে তখনই জানিয়ে রাখে।

২০০৮ সালের জানুয়ারিতেই যথারীতি তৃতীয় বর্ষ প্রথম সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হয়ে যায়। বলা নেই কওয়ানেই প্রিয়বন্ধু তুহিন হঠাৎ খুব অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। হাতের কাছেই ওসমানী মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। ধরা পড়ে তুহিনের ব্লাড ক্যান্সার। ব্যাপার গুলো এতো দ্রুত ঘটতে থাকে যে বন্ধুরা কেউ কিছু বুঝে ওঠারই সময় পায় না। সে সময় রোগটা ধরা পড়লো তখন আর সেটা ডাক্তারদের আয়ত্বের মাঝে নেই। নিয়মিত ব্লাড পরিবর্তন করলে হয়তো আরো একমাস বাঁচানো যাবে, ডাক্তারদের অভিমত। চোখের সামনে বন্ধুকে এভাবে মরতে দেখে আয়েশা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। সবাই মিলে অনেক চেষ্টা করেও বি নেগেটিভ রক্ত জোগাড় করতে হিমসিম খায়। তারা দেখতে পায় সাস্টের শিক্ষার্থীদের কোন কেন্দ্রিয় ব্লাডের তথ্য নেই কারো কাছে। বলতে গেলে তুহিন আরো যে কিছুদিন বাঁচতে পারতো সেটাও সম্ভব হয় না রক্তের অভাবে। তুহিন সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যায় ফেব্র“য়ারির ১৮ তারিখ। তুহিন চলে গেলে আয়েশা বুঝতে পারে, সে তুহিনকে শুধুই বন্ধু হিসেবে দেখেনি মনের অজান্তে ভালবেসে ফেলেছিল ! সে ভাবতেই পারেনা, একুশে ফেব্র“য়ারিতে যখন সবাই শহীদ মিনারে প্রভাতফেরী করে ফুল দিতে যাবে, সেই সকালে তুহিন থাকবে না।

তুহিনের মৃত্যুতে আয়েশা জীবনে সবচেয়ে বড় আঘাত পায়। তবে আয়েশা ভেঙ্গে পড়ে না, যে প্রতিজ্ঞা করে রক্তের অভাবে সে কাউকে মরতে দিবে না। অন্তত সাস্টের কাউকে নয়।  পরবর্তি একমাসে আয়েশা আর বাকি বন্ধুরা মিলে সাস্টের সকল ব্যাচের সকল ছাত্র-ছাত্রীদের ব্লাড গ্র“প সংগ্রহ করে। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে তারা সেই তালিকা বড় সাইন বোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথে টানিয়ে দেয়। এই ভেবে তারা আনন্দিত হয় যে, তাদের মতো আর কাউকে ব্লাডের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না। তালিকা দেখে অতি সহজেই সে তার প্রয়োজনীয় ব্লাড জোনারকে খুঁজে নেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনও অনেক সাহায্য করে, প্রতি বছর নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের তথ্য হালনাগাদ করে। পাশাপাশি চলতে থাকে পড়াশুনা ৩/১, ৩/২ তেও ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট।  ২০০৯ সালে তখন চতুর্থ বর্ষে আয়েশা ৪/১ অনেক ভাল ভাবে শেষ করে আর ৪/২ তে গিয়ে সকল কোর্সে সিজিপ্রিত ৪.০০ পায়। এভাবেই শেষ হয় আয়েশার বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া। এবার থিসিসের পালা।

২০১০ সালে আয়েশা ডিপার্টমেন্টের প্রিয় মাহবুবল হক স্যারের তত্ত্বাবধানে শুরু করে থিসিসের কাজ। থিসিসের বিষয় ‘মেটা-জিনোমিক্স’ সেপ্টেম্বর নাগাদ সে তার থিসিস পেপার সাবমিট করে। এতো সুন্দর থিসিস দেখে স্যাররা চমৎকৃত হয়। একই সময় বাংলাদেশী জিন বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম পার্টের জীবন-রহস্য উৎঘাটন করে সারা দেশকে আনন্দের জোয়ারে ভাসায় আয়েশা অনুপ্রাণিত হয়। ২০১০ সালের আগস্ট মাস, পৃথিবীর অপর প্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানী ‘লস অ্যালামস জৈব গবেষণাগারে’ প্রথেকট ম্যানেজার ক্রিস ডেটার নেতৃত্বে ‘মেটা জিনোমিক্সের’ ওপর ভিত্তি করে, শুরু করে কৃত্রিম অঙ্গ-প্রতঙ্গ তৈরী মহাযজ্ঞ। ব্যাপারটা জানতে পেরে আয়েশা তার থিসিস ক্রিস ডেটার কাছে ই-মেইলে পাঠায়। ২০১১ সালে। আয়েশা পাড়ি জমায় যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যালামস শহরে। ইউনির্ভাসিটি অব নিউ মেক্সিকোর ন্যিানোসায়েন্স অ্যান্ড মাইক্সোসিস্টেমস বিভাগে ভর্তি হয় ‘অপটোজেনেটিক্সের’ ওপর পিএইডি ডিগ্রী নিতে। পাশাপাশি চলতে থাকে জৈব গবেষণাগারে কৃত্রিম অঙ্গ-প্রতঙ্গ তৈরীর গবেষণার কাজ। লস অ্যালামস হলো পুরো বিশ্বের একটি ছোট সংস্কারণ। প্রায় সবদেশের জ্ঞানীগুণী মানুষের বাস এই শহরে। পৃথিবীর প্রতি বর্গমাইলে সবচেয়ে বেশি ডক্টরেটধারী থাকেন সেই শহরে।
অবশেষে ২০১৩ সালে আয়েশারা প্রথমবারের মতো কৃত্রিম ফুসফুস তৈরীতে সাফল্য লাভ করে। সারা পৃথিবীতে সারা পড়ে যায় এই আবিষ্কার।  ২০১৩ সালেই আয়েশা তার পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করে। যোগদান করে বিশ্বখ্যাত হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডিপার্টমেন্ট অব মাইক্রোবায়োলজিতে’, অধ্যাপক হিসেবে।  হাভার্ডে থাকাকালীন সময়েই সে শুরু করে কৃত্রিম ব্লাড সেল তৈরীর গবেষণা। পাঁচবছর মেয়াদী। মাত্র চার বছরের মাথায়ই সে তার কাজ শেষ করে।

২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস, আয়েশা এখন বাংলাদেশে। উঠেছে তার প্রিয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবনে। এক কিলেতে হাটতে হাটতে এক সকালে সূর্যোদয় দেখছে। জীবনটাকে তার কাছে সত্যিই এক রূপকথার মতো মনে হয়। সে এখন পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম।

জানুয়ারির ১৭ তারিখে সাস্টের সমাবর্তনের প্রধান অতিথি সে। কিন্তু তার আগেই যথাক্রমে ০৮ তারিখে ‘ন্যাশনাল বিওগ্রাফি এবং ১৬ তারিখে ‘সায়েন্স’ ম্যাগাজিন তাঁর কৃত্রিম ব্লাড সেল তৈরীর সাফল্যের গবেষণাটি প্রকাশ করে। সারা বিশ্বের মানুষের অভিনন্দনে সিক্ত হয় আয়েশা। ১৭ তারিখের সেই সমাবর্তনে সে তার জীবনের গল্পটিই বলে সবার নতুন গ্রাজুয়েটদের কাছে এবং সেদিনই তার শ্রদ্ধেয় মাবহুবল হক স্যার আয়েশাকে সাস্টের জিইবি ডিপার্টমেন্টের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদানের আমন্ত্রণ জানায়।
ড. আয়েশা আরেফিনের এখন প্রচণ্ড ব্যাস্ততা। ডিপার্টমেন্টের নানা কাজ, পরীক্ষা, গবেষণা ইত্যাদি নিয়ে তার দম ফেলার সময় নেই, বিভাগীয় প্রধান হিসেবে, সাস্টের জিইবি ডির্পাটর্মেন্টে।

২০১৮ সালের ৭ অক্টোবর, ক্যারোলিনস্কা ইনিস্টিটিউট, সুইডেন। ঘোষণা করে পৃথিবীর সর্বকনিষ্ট চিকিৎসা সাস্ত্রে নোবেল বিজয়ীর নাম। কৃত্রিম ব্লাড সেল তৈরীর সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ সেই পুরস্কার এককভাবে লাভ করেন বাংলাদেশের ড. আয়েশা আরেফিন, মাত্র ৩১ বছর বয়সে।

আজ ২০৩০ সালের একদিন। এখণ পৃথিবীতে এমন একজন কেও খুঁজে পাওয়া যাবে না সে কিনা রক্তের অভাবে মারা যায়। কৃত্রিম ব্লাড অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে পৃথিবীর সর্বত্র পাওয়া যায়। এবং এর কৃতিত্ব দেওয়া হয় বিশ্বখ্যাত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত অধ্যাপক, প্রখ্যাত জীন বিজ্ঞানী ড. আয়েশা আরেফিনকে।

অনুপ্রেরণায়: আয়েশার আলো।
০৬ অক্টোবর ২০১৩, স্বপ্ননিয়ে,
প্রথম আলো।

2 comments:

  1. আমরাও এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি যেখানে, কোন মানুষ আর চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে না।

    ReplyDelete