Tuesday, December 10, 2013

প্রাযুক্তিক সভ্যতা কোটি গ্রহে

৩০ বছর আগের কথা। ফ্রাঙ্ক ড্রেক উদ্ভাবন করার একটি সমীকরণ বা সূত্র। এই সূত্রের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা একটি উত্তেজক ভবিষ্যদ্বাণী করলেন। তা হলো মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে এক লাখ ত্রিশ হাজার কোটি গ্রহ আছে। তা যদি থাকে তাহলে ১০ হাজার কোটি গ্রহে অন্তত একবারের জন্য প্রাণের উদ্ভব হয়েছিল। শুধু তাই নয়, সেই হিসাবে এক কোটি গ্রহে প্রযুক্তির ক্ষমতাসম্পন্ন সভ্যতার অস্তিত্ব থাকতে পারে। সম্প্রতি কেপলারের অভিযান সেই কথাগুলোকেই প্রমাণ করে চলেছে। কেপলারের পাঠানো তথ্য-উপাত্ত থেকে বিজ্ঞানীরা বলছেন, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে এত গ্রহ না থাকলেও ১ হাজার ৭০০ কোটির ব্যাপারে তারা আগের চেয়ে অনেক শক্ত অবস্থানে আছেন। তবে সূর্যের মতো প্রধান ধারার নক্ষত্রে গ্রহমণ্ডল তৈরি হওয়া একটি স্বাভাবিক প্রবণতা। বলা যায় মহাজাগতিক সত্য। তাই বিজ্ঞানীরা বলছেন, 'আমরা আগের ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর কাছাকাছি পেঁৗছেছি।

মহাকাশে ঘুরে বেড়ানো শুধু কেপলার নয়, পল্গাঙ্ক, হারশেল, হাবল টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণ বলছে নক্ষত্রের সংখ্যা ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার কোটি হবে।'
হার্ভার্ড-স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের গবেষকরা কেপলারের পাঠানো তথ্য-উপাত্ত থেকে এও বলেছেন যে, সব নক্ষত্রের গ্রহম ল আছে। তাদের মধ্যে অন্তত ১৭ শতাংশ নক্ষত্র আছে যাদের পৃথিবীর মতো আকৃতির গ্রহগুলো প্রদক্ষিণ করে চলেছে। বিজ্ঞানীরা আরও জানান, তারা নতুন ৪৬১টি সম্ভাব্য গ্রহ খুঁজে পেয়েছেন। এতে সম্ভাব্য নতুন গ্রহের সংখ্যা দাঁড়াল ২৭৪০-এ। সম্প্রতি ৭ জানুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়ার লংবিচে অনুষ্ঠিত আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির ২২১তম সম্মেলনে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এসব তথ্য গণমাধ্যমকে জানান।

কেপলার মহাকাশযান এ পর্যবেক্ষণে ডপলারের ক্রিয়া ও ট্রানজিশন মেথড ব্যবহার করেছে। প্রথম ১৬ মাসের পর্যবেক্ষণে এ প্রক্রিয়ায় প্রায় ২,৪০০-এর মতো ট্রানজিশন শনাক্ত করেছে। এ ট্রানিজশনগুলোকে সৌরজগতে শুক্রের গ্রহণ বা সূর্যগ্রহণের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এ পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত উপাত্তগুলোর সাপেক্ষে বলা যায়, এ ২৪০০-এর মধ্যে ১৭ শতাংশ পৃথিবী সদৃশ, ২১ শতাংশ সুপার আর্থ অর্থাৎ পৃথিবীর দ্বিগুণ আকৃতির, ২০ শতাংশ সৌরজগতের নেপচুনের গ্রহের ক্ষুদ্র সংস্করণ, ৫ শতাংশ নেপচুনের চেয়েও বড়। বাকি ৫ শতাংশ গ্যাস দানব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

কেপলার হলো নাসার পাঠানো প্রথম মহাকাশ অভিযান যা নক্ষত্রের পাশ দিয়ে প্রদক্ষিণরত গ্রহগুলোকে পর্যবেক্ষণে সক্ষম। বিশেষত নক্ষত্রের প্রাণোপযোগী অঞ্চলের গ্রহ শনাক্তে সক্ষম। গ্রহাণুসন্ধানী মহাকাশযান কেপলার তার যাত্রা শুরু করে ফ্লোরিডার কোকা সমুদ্র উপকূল থেকে ৬ মার্চ ২০০৯ সালে, প্রায় ৪ বছর ধরে ছুটে চলেছে। গ্রহাণুসন্ধানী মহাকাশযান কেপলার যে পথ ধরে ছুটে চলেছে তার বৈজ্ঞানিক সূত্র কেপলারের হাতেই তৈরি। আলোর ঝড় তুলে সে এগিয়ে যাচ্ছে ৬শ' আলোকবর্ষ দূরে সিগনাস ও লিরা নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে। অনুসন্ধান চালাবে ১০ লাখ গ্রহে। এখনও মাত্র ২৭৪০ গ্রহকে শনাক্তের ব্যাপারে তার কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন। তবে সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রাকোঁয়েস ফ্রেসিন বলেছেন, কেপলার মহাকাশযানের এ অভিযাত্রায় এত অল্প সময়ে যে পরিমাণ গ্রহ আবিষ্কার করেছে, তাতে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণসম্পন্ন গ্রহের সম্ভাবনার ব্যাপারে তাদের আশাবাদ আরও জোরালো হয়ে উঠেছে।

ফ্রাঙ্ক ড্রেক উদ্ভাবিত ড্রেক সমীকরণ হলো এমন একটি সমীকরণ যা দিয়ে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে প্রাযুক্তিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণের সংখ্যা নিরুপণের চেষ্টা করা যেতে পারে। এটা করতে হলে জানতে হবে, জ্যোতির্বিদ্যা, জৈবরসায়ন ও বিবর্তন জীববিদ্যা এবং অ্যাবনরমাল সাইকোলজি। জানতে হবে অর্থনীতি, রাজনীতি এবং আরেকটি ব্যাপার যাকে আমরা মানব প্রকৃতি বলি। সায়েন্স ফিকশনের কিংবদন্তি আইজ্যাক আসিমভ বলেছেন, এ মানব প্রকৃতি বা আচরণ সম্পর্কে আমাদের ধারণা এখনও খুব স্পষ্ট নয়। এটার ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে মানব সভ্যতার গতি-প্রকৃতি।

ড্রেক সমীকরণের সাহায্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগান আশির দশকে জানিয়েছিলেন, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক মতামতের মাঝামাঝি অবস্থান নিলে বলা যায় যে, প্রাণের উদ্ভবের সম্ভাবনাসম্পন্ন ১০০টি গ্রহের মধ্যে মাত্র একটিতে প্রাযুক্তিক সভ্যতার বিকাশ ঘটতে পারে। এ হিসাবে বলা যায়, ১০০ কোটি গ্রহে অন্তত একবার প্রযুক্তিসম্পন্ন সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। যদি সভ্যতাগুলোর ১০০টির মধ্যে একটিও তাদের প্রাযুক্তিক বিকাশের বয়ঃসন্ধিকাল অতিক্রম করতে পারে, বা আমরা যে ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে সঠিক পথটি বেছে নিতে এবং পরিপকস্ফ অর্জন করতে পারে তাহলে অন্তত এক কোটি গ্রহে একই সময়ে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত সভ্যতার টিকে থাকা সম্ভব এ গ্যালাক্সিতে। এতে আশা করা যায়, আত্মধ্বংসের ব্যাপারটি খুব ব্যাপক না হলে নক্ষত্রগুলো থেকে আসা বেতারবার্তায় আকাশ হবে সুরময় গুঞ্জনে মুখরিত। হার্ভার্ড-স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের ফ্রাসোয়া ফ্রেসিন ও গুইলার্মো বলেছেন, কেপলার ইতিমধ্যে আমাদের যে ফলাফল দিয়েছে তাতে প্রাণঅধ্যুষিত গ্রহের সম্ভাবনা জোরালো হয়ে উঠছে।

No comments:

Post a Comment