Tuesday, December 10, 2013

অন্তরালে



নীলা। অতি সাধারণ এবং ভাবুক প্রকৃতির একটা মেয়ে। নীলার চোখ দু’টি উজ্জ্বল নীল রঙের। এডভেঞ্চার তার খুবই পছন্দ। বিভিন্ন স্থানে সে ঘুরতে যায়। তাই কখনো সে সমুদ্রে, কখনো পাহাড় চূড়ায় আবার কখনোবা মহাশূণ্যে বেড়াতে যায়। তবে কল্পনার রাজ্যেই তার বিচরণ বেশি।

নীলা এস্ট্রোলজি,নিউমারোলজিতে বিশ্বাস করে। ওর হাতে একটি রক্তমুখী নীলা আছে। নীলা মানে হীরে।তবে, নীল হীরে। ওর ধারনা এতে দৈবশক্তি আছে। এটি কাছে থাকলে সে সবকিছুই করতে পারবে। আলাদীনের যেমন জাদুর প্রদীপে দৈত্য ছিল, ঠিক তেমনি নীলার রক্তমুখী নীলাতেও শক্তি আছে। তবে সেটা থেকে কোন দৈত্য বের হয় না, বের হয় রক্তবর্ণের রশ্মি। সেই রশ্মির এক আশ্চর্য আকর্ষণ ক্ষমতা আছে। নীলা যা চায় সেই রশ্মি তখনি চারদিক আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং নীলার ইচ্ছা পূরণ হয়।


একদিন নীলা চোখ বুজে ভাবছে, কী ভাবছে সে-ই জানে। দেখে মনে হচ্ছে সে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। সে যেন চোখ বন্ধ করে দেখার চেষ্টা করছে তার মস্তিষ্কটা কেমন প্যাঁচানো; সেখানে কী কী আছে। যত গভীরভাবে ভাবছে ততই যেন সে তার মস্তিষ্কে আলোকচ্ছটা দেখতে পাচ্ছে। হাল্কা লাল বর্ণ থেকে সেই আলোর কেন্দ্রে সাদা রং আর চারপাশে হলুদ রং ছড়াচ্ছে। নীলা একটা মূর্তি দেখতে পেল। সেই মূর্তি চলতে পারে। কিন্তু সেটাকে কোন মানুষের মূর্তির মতো মনে হচ্ছে না। অদ্ভূত প্রাণীর মতো মনে হচ্ছে। কিন্তু চেহারাটা ঠিক স্পষ্ট হচ্ছে না। নীলা ভয়ের সাথে সেই অদ্ভূত মূর্তিময় প্রাণীর সাথে কথা বলতে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। কিন্তু মূর্তিটি ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে। নীলার মূর্তিটির পিছু পিছু বেশি দূর যেতে পারল না। সেটি কোথায় যেন হারিয়ে গেল।


নীলার চোখ চঞ্চল হয়ে উঠছে। যখনই ওর চোখ চঞ্চল হয়ে উঠে, তখনই সে কল্পলোক থেকে বেরিয়ে আসে। নীলার চোখ লাল হয়ে আছে, রক্তের মতো লাল। মাঝে মাঝেই ওর এমন হয়; খেই হারিয়ে ফেলে। তখন এমন কিছু ঘটনা ওর কল্পনায় আসে যা সে কখনো ভাবে নি, কিন্তু ওর ইচ্ছে হয় যদি সেগুলো কল্পনা না হয়ে বাস্তব হত! কিন্তু নীলার সেই রক্তমুখী নীলা ওর এই ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে পারে না। রক্তমুখী নীলাটা এখনও নীলার কল্পনারাজ্যে প্রবেশ করে নি।


নীলা একবার পাহাড়ে বেড়াতে গেল। বরফে ঢাকা পাহাড়। পাহাড়ে এক-দুইটা মরা গাছ। হঠাৎ একটা গাছের দিকে ওর চোখ পড়ল। দেখতে পেল বরফাচ্ছাদিত এক বিরাট মানুষ। গড়নটা মানুষের মত হলেও চেহারাটা অদ্ভুত রকমের লোমশ। নীলা গাছের দিকে এগুচ্ছে। সেই অতিমানব ধীরে ধীরে নিচে নেমে এল,আর নীলার থেকে ক্রমশ দূরে যেতে লাগল। নীলা কিছুদূর তাকে লক্ষ্য করে এগুলো, কিন্তু সেই মূর্তির মত তাকেও আর দেখা গেল না। তবে এই ঘটনা বাস্তবেই ঘটল। নীলা বুঝতে পারল না কী হচ্ছে। কল্পনা আর বাস্তব যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে।


নীলা রাতে শুতে গেল। কিন্তু তার ঘুম আসছে না। শুধুই ওই ঘটনাগুলো মনে আসছে। অন্ধকার রাতে আকাশে তারার মেলা বসেছে। হঠাৎ সে সেই মূর্তিকে দেখতে পেল, যেটা সে কল্পনায় দেখেছিল। মূর্তিটা ধীরে ধীরে নীলার দিকে এগিয়ে আসছে। মূর্তিটি নীলার হাত ধরে মহাশূণ্যের দিকে যেতে লাগল। যখনই সে নীলাকে স্পর্শ করল তখনই রক্তমুখী নীলা থেকে রক্তিমাভা বের হয়েছিল। কিন্তু নীলা সেটা খেয়াল করে নি। মূর্তিটি নীলাকে তার দেশে নিয়ে গেল। সেখানে লক্ষ তারার মেলা,গ্রহ, গ্রহাণু,উল্কা, ধূমকেতু সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওরা একটা গ্রহাণুর উপর দাঁড়াল। নীলা দেখতে পেল সূর্যের অতি কাছে একটি ধূমকেতুর উপরে সেই বরফাচ্ছাদিত অতিমানব দাঁড়িয়ে আছে। নীলা অবাক হয়ে গেল। ওর কল্পনা আর বাস্তব সত্যি মিলে গেছে। তাহলে নীলা সেদিন ভুল দেখেনি! ধূমকেতু একটি ক্ষুদ্র বরফাবৃত সৌরজাগতিক বস্তু। সেটি সূর্যের খুব কাছে আসার ফলে বরফ গলতে শুরু করেছে। এও কি সম্ভব? (!) নীলা নিচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল বরফ তুষার হয়ে সেই বরফের পাহাড়ে আছড়ে পরছে। কী সুন্দর লাগছে দেখতে! নীলা বুঝতে পারল এরা পৃথিবীর কেউ নয়; এরা এলিয়েন। নীলা ভাবতে পারছে না, সে সত্যি সত্যি এলিয়েন দেখছে! এটা এলিয়েনদের রাজ্য। এলিয়েনদের যাকে পছন্দ হয়, ব্লু মার্বেল থেকে ওরা মানুষদের তাদের রাজ্যে নিয়ে যায় ইচ্ছে পূরণ করার জন্য। ব্লু মার্বেল মানে পৃথিবী। নীলার সেই সৌভাগ্য হয়েছে। সে যদি এলিয়েনদের কাছে কোন ইচ্ছে প্রকাশ করে, তাহলে এলিয়েনরা তা পূরণ করবে। নীলার তখন ওর দেশের কথা মনে পড়ল। সে যে দেশে থাকে সেই দেশ আর তার পার্শ্ববর্তী দেশে কিছুদিন পর পরই জল নিয়ে ঝগড়া বাঁধে। ঐ দেশ নদীতে বাঁধ দিয়ে দিলে ওর দেশের বেশ কিছু অংশ জল পায় না, কৃষিকাজ ভালভাবে হয় না। নীলা ভাবল যদি এলিয়েনরা জলের এমন কোন ব্যবস্থা করে দেয় যাতে তার দেশের আর কোন জলের ভাবনা থাকবে না। নীলা ভাবছে ওদের কথাটা বলবে, কিন্তু তাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে হল না। এলিয়েনরা বলার আগেই বুঝে গেল, নীলা কী ভাবছিল। ওরা বলল, “ আমাদের এখানে আকাশ গঙ্গায় বিশাল জলের ট্যাঙ্ক আছে, সেই জল কখনোই ফুরোবার নয়। আমরা তোমার দেশে জল সরবরাহ করব। কিন্তু সেটা তুমি ছাড়া পৃথিবীর অন্য কেউ দেখতে পাবে না।’’ নীলা অনেক খুশি হল। কিন্তু কিঞ্চিৎ দুঃখও পেল। কারণ সে ছাড়া আর কেউ জানতে পারবে না, এলিয়েনরা তাদের কত উপকার করছে।


নীলা অভিমানে অন্য দিকে তাকাল। সে একজন ঢিলেঢালা পোশাক পরিহিত রোগা লোককে দেখতে পেল। কিন্তু উনাকে এলিয়েন বলে মনে হচ্ছে না। উনাকে মানুষই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এলিয়েনদের উনাকেও পছন্দ হয়েছিল। তাই এখানে নিয়ে এসেছে। নীলা লোকটাকে ভালভাবে দেখতে চেষ্টা করল। উনাকে ওর পরিচিত মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ইনি নীলার পাড়াতেই থাকতেন। বিখ্যাত বিজ্ঞানী। কিন্তু উনি তো বেশ কয়েক বছর হল মারা গেছেন। এলিয়েনরা তাহলে উনাকে মৃত্যুর পর এখানে এনেছে। নামটা নীলা ঠিক মনে করতে পারছে না। কিছুক্ষণ সে নাম মনে করার চেষ্টা করল। ও, হ্যাঁ, নীলার নাম মনে পড়েছে। ইনি নীরু মহাশয়। মহাশয়। পুরো নাম নীরুপতি যাজ্ঞবল্ক্য তর্কালঙ্কার ভবেশ। নীরুপতি নামটা যিনি দিয়েছেন তিনিই জানেন কেন এমন নামকরণ করলেন। কস্মিনকালেও এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি। বাকী শব্দের যা অর্থ মনে হল ওগুলো সম্ভবত উনার ভবিষ্যতের কথা আগেই টের পেয়ে নামকরণ হয়েছিল। মহাশূণ্যে বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন সর্বদা। সেখানে গ্রহ, নক্ষত্র, উল্কা সবই জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড। যজ্ঞের আগুনের তাপও বুঝি সেরকমই হয়। সেজন্য যাজ্ঞবল্ক্য। তর্কালঙ্কার উনার বংশের উপাধি। তর্ক করা উনাদের অলংকারস্বরূপ। আর সর্বক্ষণই ভেবে চলেছেন তাই মনে হয় নাম হয়েছে ভবেশ। মাঝে মাঝে নীলা এমনই উদ্ভট মশকরা করে বটে! কিন্তু উনি করছেনটা কী? সন্দিগ্ধ নয়নে নীলা চেয়ে রইল। নীলা দেখল, আয়নায়... না, ওটা ঠিক আয়না নয়। মনে হচ্ছে ‘DG - 5’, যেখানে নিজেকে কীভাবে যেন দেখা যাচ্ছে। ‘DG - 5’ মানে হচ্ছে Dream Glass 5. দু’টোতেই ৫টি করে বর্ণ, তাই ৫ । লোকটার মস্তিষ্কের ছবিওখানে ভেসে উঠছে। ক্ষণিকের জন্য সেখানে বিভিন্ন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, আবার লোকটাকে দেখা যাচ্ছে। নীলা যেমন কল্পরাজ্যে আর বাস্তবে ঘুরে বেড়ায় DG-5 এর ছবিগুলোও ঠিক তেমনটি মনে হচ্ছে। নীলা ভাবছে সে কী নীরুবাবুকে বলবে উনার মত নীলা যা কল্পনা করে সেগুলো DG - 5 এ দেখাতে। বললে নীরুবাবু অবশ্যই দেখাবেন। কারণ এইটা এলিয়েনদের দেশ। নীলার ইচ্ছাপূরণের জন্যই ওরা এখানে ওকে এনেছে। নীলার ভিতর উত্তেজনার সাথে কিছুটা ভীতিও কাজ করছে। ও আগে যা কল্পনা করত, তা এখন বহির্দৃষ্টিতে দেখতে পাবে।


নীরুপতি, নীলাকে ওর কল্পনার জগৎ দেখালেন। নীলার সেই মূর্তি এখন স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে। নীলার ভীষণ আনন্দ হল। এখন যদি সে কিছু ভুলেও যায়, DG-5  তা আবার দেখাতে পারবে।


নীলা ভাবল, এটা এলিয়েনদের দেশ বলেই DG-5 এ সবকিছু দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু এলিয়েনরা যখন তাকে আবার ব্লু মার্বেলে পাঠিয়ে দেবে তখন তো সে আর DG-5 পাবে না। তাহলে কীভাবে দেখবে? তাছাড়া, নীলার আর একটি বিষয়ে খটকা লেগেছিল। সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না কীভাবে বলার আগেই এলিয়েনরা সব বুঝে যায়। একজন এলিয়েন তখন বলল, ওদের মস্তিষ্কে এমন এক ধরনের স্ক্যানার আছে যা অন্যরা কী ভাবছে তাই স্ক্যান করতে পারে। আর সেটা দেখানোর জন্যই ওদের আছে DG-5 । এলিয়েনদের সবার এই ক্ষমতা আছে, তাই ওরা সবাই সমান। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ওদের মধ্যে নেই। নীলার ইচ্ছে, ওর মস্তিষ্ক যদি এমন হত তাহলে সে বুঝতে পারত কে কী ভাবছে। সবার মনের কথা সে বুঝতে পারত। কিন্তু নীলা সেটা এলিয়েনদের বলতে পারল না। আর কিছু সে চাইতে পারছে না ওদের কাছে। এলিয়ানরা নীলার ইচ্ছে বুঝতে পারল। ওরা শুধু বলল, “ তোমার এই রক্তমুখী নীলার যে স্পর্শ করবে সে এলিয়েনদের ক্ষমতা পাবে।” এই বলে একটা এলিয়েন নীলাকে আবার ব্লু মার্বেলে পৌঁছে দিয়ে গেল। তখনো নীলা রাতের আকাশের তারা দেখছে। আচমকা সে সম্বিৎ ফিরে পেল। দেখল, চাঁদের আলো ওর রক্তমুখী নীলাতে এসে পড়েছে। নীলা লক্ষ্য করল রক্তমুখী নীলা থেকে উজ্জ্বল লাল বর্ণ বেরুচ্ছে। আর এতক্ষণ যে সে এলিয়েনদের দেশে ছিল সেটা স্পষ্ট দেখতে পেল নীল হীরেটিতে। নীলা এবার বুঝতে পারল এলিয়েনরা তার নীল হীরেটিতে DG-5 এর ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছে।


নীলা অনেক খুশি হল। সে তার মস্তিষ্কের স্ক্যানিং ক্ষমতা পরীক্ষা করতে চাইল।


নীলা তার বান্ধবীর কাছে গেল। ওর নাম চন্দ্রিমা। চন্দ্রিমার দিকে তাকিয়েই সে রক্তমুখী নীলার দিকে তাকাল। চন্দ্রিমা কী ভাবছে সবই নীলা হীরেটিতে দেখতে পাচ্ছে। এলিয়েনরা সত্যি নীলাকে তাদের ক্ষমতা দিয়েছে। এখন নীলা যদি চন্দ্রিমাকে হীরেটি স্পর্শ করায় তাহলে চন্দ্রিমাও সেই ক্ষমতা পাবে। সত্যি তাই হল। চন্দ্রিমাও বলতে পারছে নীলা কী ভাবছে। এভাবে যদি পৃথিবীর সবাই সমান ক্ষমতা পায় তাহলে আর ক্ষমতার লড়াই থাকবে না।  যেই নীলা এই কথাটা ভাবল, ওর নীল হীরা থেকে রক্তিমাভা বের হল। নীলা বুঝতে পারল, রক্তমুখী নীলাটি এবার থেকে ওর কল্পনা জগতের সব ইচ্ছেই পূরণ করবে। তবে সে কিছুতেই কোন খারাপ ইচ্ছে মনে আনতে পারবে না। কারণ, এর অপপ্রয়োগ করলেই সেই শক্তি এলিয়েনরা ফিরিয়ে নেবে। নীলার ইচ্ছেতে ব্লু মার্বেলে সবাই শান্তিতে থাকে।এখন ওদের কোন কিছুরই অভাব নেই, ক্ষমতারও লড়াই নেই। কিন্তু নীলা ছাড়া এলিয়েনদের কথা আর কেউ জানতে পারল না। এলিয়েনরা আড়ালেই থেকে গেল।



লেখিকাঃ


সুস্মিতা দত্ত

বিভাগঃ অর্থনীতি

১ম বর্ষ, ২য় সেমিস্টার

No comments:

Post a Comment