Tuesday, December 10, 2013

ষোলকড়াই কানা স্বপ্ন

শেখ শিব্বির হোসেন 


 

 

পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে লাফ দিল সবুজ। মনের আনন্দে সে এদিক ওদিক উড়তে থাকল। সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না কিভাবে সে বাড়ির আঙ্গিনায়, মাঠ-ঘাট সর্বত্র পাখির মতো মুক্ত বিহঙ্গে উড়তে থাকল। আবার মাঝে মাঝে ভয়ও হচ্ছে যদি সে পড়ে যায়। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। এতক্ষণ সে যা করছিল সবই স্বপ্ন!

সবে মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে সবুজ। আর্থিক অনটনের কারণে তার মা তাকে তার নানার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেখানেই পড়াশুনার হাতেখড়ি ঘটে তার। নানার বাড়িতে তাকে অনেক মানসিক নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হত। বিশেষ করে তার ছোট খালার রোষানলে পড়ে গিয়েছিল সে। নানার বাড়ির সকল অত্যাচার অবিচার মুখ বুঝে সহ্য করে নিত সবুজ। বাড়ির সকলের নিকট তাবিচ্ছল্লের স্বীকার হলেও নানা নানীর কাছে সে ছিল খুবই আদরের। ওর নানা জোরালি মাস্টর একজন অবসর প্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষক হিসেবে এলাকাতে বেশ ক্ষ্যাতি আছে উনার। তাছাড়া উনি ছিলেন বেশ দানবীর। একটি স্কুল, একটি মসজিদ ও একটি ঈদগাহ দান করেছেন। নানা-নাতি প্রায়ই একসঙ্গে ঘুরে বেড়াত। উনি যেখানেই যেতেন সবুজকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন।

সবুজ যখন তৃতীয় শ্রেণী পেরিয়ে ৪র্থ শ্রেণীতে উঠল তখন তার বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এমনিতেই টানা পোড়নের সংসার আবার বাবার মৃত্যু। ফলে সব ভার এসে পড়ল তার বড় ভাই আসাদের ঘাড়ে। আসাদ ৮ম শ্রেণীতে পড়ত। এখন সে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে দর্জির দোকানে কাজ নিয়েছে। অপর দিকেব সবুজের মা এলাকার ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়িয়ে থাকেন। সবুজের একটা ছোট বোন ছিল। নাম তার অল্পনা।

২য় শ্রেনীতে পড়ে সে। প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর অল্পনা লাকড়ি কুড়াতে যেত। যেখানে তার সহপাঠিরা স্কুল ছুটির পর খেলাধুলায় মেতে থাকত, সেখানে তাকে রান্নার ঝালানি হিসেবে লাকড়ি কুড়াতে হত। আসলে অভাবের কাছে সকল আনন্দই স্লান। এভাবেই চলতেথাকল সবুজদের সংসার। অন্যদিকের নানার বাড়িতেই বেড়ে উঠতে থাকল সবুজ।

নানা: নাতী স্বপ্ন দেখস না?
নাতী: হ্যা দেখি। অনেক ধরনের স্বপ্ন দেখি।
নানা: কী কী?
নাতী: বেশির ভাগ ভয়ের স্বপ্ন দেখি। মাঝে মাঝে দেখি সাংস, পোলাও, রস মালায় খাচ্ছি। আবার মাঝে মাঝে স্বপ্নে কান্নাকাটি করি।
নানা: দুর বোকা! এই স্বপ্ন না। বলছি তুই বড় হয়ে কি হতে চাস?
নাতী: বিজ্ঞানী।
নানা: বিজ্ঞানী মানে কি বুঝস?
নাতী : বুঝব না কেন। যার বেশি জ্ঞান আছে তাকেই তো বিজ্ঞানী বলে।

সাধারণত গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পড়া ছাত্র ছাত্রীদের বিজ্ঞানী সম্পর্কে এ ধরনেরই ধারণা থাকে।

বড়শি দিয়ে মাছ ধরছিল আর নানা-নাতী একে অপরের সাথে এসব কথা বলতে ছিল। বড়শি দিয় মাছ ধরাটা তাদের পেশা বলব না, অভ্যাস বা শকছিল। তাই প্রতিদিন দুপুরবেলা নানা নাতী একসঙ্গে বসে মাছ ধরত। যদিও বিজ্ঞানী কী বা বিজ্ঞানী কিভাবে হতে হয়এ সম্পর্কে সবুজের কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না তথাপি বিজ্ঞানী হবার বোধ তার মাথায় চেপে বসল।

এদিকে ৫ম শ্রেণীর ফলাফল বের হল। সবুজ প্রথম স্থান অধিকার করতে সক্ষম হল। তার ফলাফল ভাল হয়েছে। তাই সে ঠিক করল মামার বাসায় বেড়াতে যাবে। মামা চা বাগানে চাকরি করেন। অপরদিকে সবুজের মা তার ভাইয়ের কাছে আবদার করলো যেন তার ছেলেটাকে সেখানেই একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত মামার কাছে থেকে সে তার ৬ষ্ট শ্রেণীর পড়া শুনা শুরু কর। প্রথম একটি বছর সবুজ খুব আনন্দ উল্লাসে কাটাল। কিন্তু সপ্তম শ্রেণীতে উঠতে না উঠতেই সে তার মামী ও মামাত ভাইবোনদের রোষানলে পরিণত হ। খেলাধুলা বিনোদন সবকিছু থেকেই তাকে তারা বিরত রাখত। বলতে গেলে সেখানে তার বন্দি জীবনের শুরু হল। এমনকি তাকে খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রেই কষ্ট দেওয়া হত। তাছাড়া তাকে ক্ষীণ আলোতে পড়তে হত। এসব কিছুরপরেও সব কিছু সে মুখ বুজে সহ্য করত। কারণ তার বাবা নেই, ভরণ পোষণের মত কেউ নেই। এভাবেই তার দিনকাল চলতেছিল।

ওরা মামার বাসার মধ্যে ফুলের বাগান ও সবজি বাগান ছিল। প্রতিদিন সে ফুলের বাগান ও সবজির বাগানের পরিচর্যা করত। মাঝে মাঝে ফুলের বাগানে নীরবে বসে সে চিন্তা করত আমি যদি বিজ্ঞানী হতাম তাহলে ক্যান্সার রোগের ঔষধ তৈরি করতাম। সে চিন্তা করল প্রতিটি সমস্যারসমাধান প্রকৃতিতে ছড়ি ছিটিয়ে আছে। তাই সে প্রকৃতির সাহায্য নিয় ক্যান্সার রোগের ঔষধ তৈরি করতে চাই। ঔষধ তৈরি করা যে কঠিন বিষয় সেটা সে ভুলে গিয়াছিল। সে একটা বোতলের মধ্যে বিভিন্ন বনজ লতাপাতা, চা পাতা, পানি, সরিষার তেল এক সঙ্গে মিশিয়ে ঢুকিয়ে রাখল। এ জিনিসটা ওর মামাত বোন দেখে ফেলল। এবং বলতে শুরু করল কিরেতুই কি আমাদের মারার জন্য বিষ তৈরি করতেছস। ঐদিন বাসার সবাই মিলে সবুজকে মারাতœকভাবে প্রহার করে। তাই সবুজ ভাবল সে আর এখানে থাসবেনা, বাড়ি চলে যাবে। এবং সত্যি সত্যিই বাড়ি চজলে গেল। বাড়ি যাবার পর সেই একই ঘটনা মা ও বড় ভাইয়ের প্রহারের স্বীকার। মা বলতে শুরু করলেন ওরা যা করে তোর মঙ্গলের জন্যই করে তুকে মেরে যদি নদীতে ভাসিয়ে দেয় তবুও বঝবে যে এটা তোর মঙ্গলের জন্যই করেছে । তাই আবারও মামার বাসাতে ফিরতে হল সবুজকে।

এদিকে ৮ম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার ফল ভের হল। সবুজ ঠিকই তার ১ম স্থানটা ধরে রাখল। তখনসবুজের মামাতভাই মিল্টন এসে বলল বুঝলে আমরা কেন তোর সাথে এরকম ক।ি সবুজের একটা ভাল অভ্যাস ছিল সে কারো সাথে অযথা তর্ক করত ন। তাই প্রতি উত্তরে সে কিছুই বলল না। নতুন করে অরেকটি সমস্যার সম্মুখীন হল সবুজ। ৯ম শ্রেণীতে বিজ্ঞান নিয়ে নাকি মানবিক অথবা ব্যবসায় শিক্ষা নিয়ে পড়বে। তার ইচ্ছা সে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে একদিন বড় একজন বিজ্ঞানী হবে। অপরদিকে তার মামাত ভাইবোনরা বললোনা বিজ্ঞন নেওয়া যাবে না মানবিক শাখা নিয়ে পড়তে হবে। তার মামাত ভাই বোনরা তাকে ভয় দেখাতে লাগল যে দেখ আমরা কেউই বিজ্ঞান নিয়ে পড়ি নাই। এ এলাকাতে বিজ্ঞানের ভাল মাস্টার নাইআর আমাদের স্কুলে তো নাই। বিজ্ঞান নেবার কোন দরকার নেই মানবিক শিক্ষা নিয়ে পড়াশুনা কর। সবুজ বুঝতে পারল যে তার ইচ্ছা আছে স্বপ্ন আছে কিন্তু সামর্থ্য নেই। তাই বাধ্য হয়েই সে মানবিকে ভর্তি হল ।

ফলে ফলাফল যা দাড়াল মাধ্যমিক পরীক্ষায় সে বরাবর সেকেন্ড ক্লাশ পেয়ে পাস করল।

এবারসে ঠিক করল মামার বাসায় আর না নিজের এলাকার কলেজে ভর্তি হবে। আর বাকী জীবনের পড়াশুনাটা টিউশনিকরে চালাবে। ঠিক তাই করল। এদিকে পরিবারের ভরণপোষনের বুঝা তার উপর এসে পড়তে থাকল। এখন সে পরিবার ও পড়াশুনা দুটো এক সঙ্গে চালাতে থাকল। কিছুদিন পর তার মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল বের হল। এবারও সে সেকেন্ড ক্লাসে উত্তীর্ণ হল। উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশুনার সময় তার ইচ্ছে ছিল যে সে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। তাই এখন সে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাইল। কিন্তু ফলাফল ভালহল না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই তাকে সন্তুষ্ট থাকতেহল। তার স্বপ্নগুলো মরিচীকায় পরিণত হতে থাকল।

এখন সে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে অনার্স করতেছে। ইদানিং সে একটা মেয়ের প্রেমে বাহু ডুবু খাচ্ছে। মেয়েটির নাম শিমুল। দেখতে ভারি সুন্দর। শেষ পর্যন্ত বন্ধুদের সাথে পরামর্শ করে সে শিমুলকে তার মনের কথা বলল। কিন্তু যা ঘটল শিমুল তার মুখের উপর বলে ছিল যে তুমিতো স্মার্ট না, আমি স্মার্ট ছেলে ছাড়া প্রেম করব না। সবুজ বুঝতে পারল স্মার্ট হবার মত সামর্থ্য তার নেই। তাই এ ব্যাপার বহুদিন সে মন কষ্টে ভুগল।
সবুজের বন্ধু নাজমুল খুবই ভাল একটা ছেলে। সবক্ষেত্রেই সবুজকে সে সহায়তা করে। একদিন দুজন একসঙ্গে বসে একটি ডিজেস্টার ফিকশন মুভি দেখছিল। তারা দেখতে পেলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পর্বত সমান বিশাল বিশাল টেড ধেয়ে আসছে লোকালয়ের দিকে, আর তার আঘাতে দ্রুতই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দিল্লি থেকে ওয়াশিংটন পর্যন্ত বড় বড় শহর। কেবল চীনারাই এই প্রলয়ংকারী ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাঁচার চেষ্টা হিসেবে তিনটি বৃহদাকার নৌযান প্রস্তুত রেখেছে। যাতে ঠাঁই হয়েছে প্রভাবশালী কিছু দেশের রাজবর্গের। সঙ্গে অন্য কিছু দেশের অল্প সংখ্যক ভাগ্যবান সাধারণ লোকেরও জায়গা মেলে। সবুজের মনে প্রশ্ন জাগে সত্যি সত্যিই যদি বিক্ষুব্ধ জলবায়ু কবে না ফুঁসে উঠে ঘটিয়ে দিয়ে যায় জাপানের সুনামি ও ভূমিকম্পের মতো আরও কোন ট্রাজেডি! নাজমুল সজিবকে বললো অস্তিত্ব তথা সভ্যতার জন্য প্রধানতম হুমকি। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১০০ বছরে দশমিক ৭৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়েছে বলে আইস্পিসির সমীক্ষায় দেখা যায়। সাগরের জলরাশির উচ্চতা যেভাবে বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে সমুদ্র উপকূলবর্তী দ্বীপরাষ্ট্রগুলো ২০৫০ সালের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্টদেশ বাংলাদেশ হারাবে তার উপকূলবর্তী ভূমির ১৭ থেকে ২০ শতাংশ।
একথাগুলো শুনে সবুজ নাজমুল কে প্রশ্ন করল আচ্ছা এর জন্য দায়ী কারা? নিঃসন্দেহে শিল্পোন্নত দেশগুলো, নাজমুল। শিল্পোন্নত দেশগুলোর কলকারখানা থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রধান দায়ী।

সবুজ : আচ্ছা এর কোন সমাধান নাই?
নামজুল: সমাধান আর কি। তাদের উপর কেউ কথা বলতে যায় নাকি।
সবুজ: দোস্ত, আমার মাথায় একটি পরিকল্পনা আছে।
নাজমুল: কি সে পরিকল্পনা ?
সবুজ : চল আমরা দুজন মিলে কার্বন শোষণ যন্ত্র তৈরি করে ফেলি।
নজমুল : এটা সম্ভব নাকি?
সবুজ: সম্ভব না মানে, কার্বন নির্গমন যন্ত্র তৈরি হতে পেরেছে তাহলে কার্বন শোষণ যন্ত্র তৈরি করা যাবে না কেন?
নজমুল: কিভাবে?
সবুজ: এর জন্য আমরা গাছকে আদর্শ হিসেবে বেছে নিতে পারি। গাছ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নেয় এবং আমাদেরকে অক্সিজেন দেয়। ঠিক গাছের মত একটাযন্ত্র তৈরি করে ফেললে কেমন হয়।
নাজমুল: বোকা তুই যা ভাবছিস তা কখনো সম্ভব না। তোর আর আমার এই সামর্থ্য নাই।

সবুজ আর কিছু হতে চাই না, বিজ্ঞানী হবার স্বাদটা তার মধ্য থেকে ধীরে ধীরে দূরে চলে গেছে। কারণ তার প্রতিটি স্বপ্নই অন্ধকার। বছর দুয়েক হল সবুজ এখন একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সেলস্ ম্যানের কাজ করে। যদিও সে এখণ আর কোন স্বপ্ন দেখে না। তবুও তার মধ্যে একটা প্রশ্ন রয়ে গেল-
আমার মতই কি হাজার হাজার বাঙালীর স্বপ্ন গুলো অংকুরে বিনষ্ট হয়ে যায়?

No comments:

Post a Comment