মোঃ তারেক বিন আবদুল্লাহ
পিএমই ১/২
কোন সন্দেহ নেই যে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাটির নাম ফুটবল। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বা রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনা এইসব ম্যাচে গোটা পৃথিবী দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। খেলাধুলার প্রাণ যেমন ফুটবল, তেমনি ফুটবলের প্রাণ গোল। একটি গোলে কপাল পুড়তে পারে একটি দলের আবার অন্য দলকে ভাসাতে পারে আর আনন্দের জোয়ারে। গোল নিয়ে যেমন মাতামাতি আছে, আছে বিতর্কও ।
২০০৫ সাল। টটেনহাম হটস্পার ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মধ্যকার খেলা চলছে। হঠাৎ ৫৫ গজ দূর ম্যানইউর গোলপোস্টে একটি শট নিলেন টটেনহামের মিডফিল্ডার মেনডেস- গোলকিপার রয় ক্যারোলের হাত ফসকে বলটি গোললাইন অতিক্রম করার পর তিনি বলটি তুলে নেন। কিন্তু রেফারি কিংবা লাইন্সম্যান কেউই এটি না দেখায় নিশ্চিত গোল থেকে বঞ্চিত হয় টটেনহাম। ফুটবল বিশ্ব এরকম বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছে বহুবার। ২০১০ বিশ্বকাপে জার্মানি-ইংল্যান্ডের খেলায়, ২০০৫ সালে চেলসি- টটেনহামের খেলায়,২০০০ সালের আফ্রিকান নেশন্স কাপে। রেফারির ভুলের জন্য বারবার চড়া মূল্য দিতে হয়েছে কোন একটি দলকে। সমালোচকরা মাথা চুলকে বলেছেন- ক্রিকেট, টেনিসে প্রযুক্তি ব্যবহার হয়, ফুটবলে কেন নয়? এসব বিতর্কের অবসান ঘটাতে অবশেষে গোললাইন টেকনোলজি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফিফা। ফিফা বলেছে- রেফারির ভুমিকা দূর করা নয়, রেফারিকে সাহায্য করাই এই প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্দেশ্য।
গোললাইন প্রযুক্তি কি ?
গোললাইন টেকনোলজি বা GLT এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেফারি জানতে পারবেন বল গোললাইন সম্পূর্ণ রুপে অতিক্রম করছে কিনা। ইলেকট্রিক ডিভাইস নির্ভর এই পদ্ধতির উদ্দেশ্য রেফারিকে নির্ভুল গোলের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা । GLT রেফারিকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেবে বল গোললাইন অতিক্রম করেছে কি করেনি, আর এটি অফিসিয়ালদের তাদের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। প্রাথমিকভাবে ৯ টি প্রযুক্তি পরীক্ষা করা হয়। এরপর- সেখান থেকে GoalRef, Hawk-Eye নামের দুটি প্রযুক্তিকে বেছে নেয়া হয়।
যেভাবে কাজ করে
GoalRef প্রযুক্তি-- এই প্রযুক্তি তড়িৎচৌম্বক আবেশের নীতিকে ব্যবহার করে। একটি ক্ষুদ্র কম্পাঙ্কের তড়িৎক্ষেত্র গোললাইনের চারদিকে স্থাপন করা হয়, এই চৌম্বকক্ষেত্রের ক্রিয়া নিয়ন্ত্রন করে ক্রসবারে এবং গোলপোস্টে স্থাপিত কয়েল। ফুটবলের বাইরের চামড়ার আবরণ এবং ভিতরের ফাঁপা বায়ুপূর্ণ স্তরের মাঝে একটি কম সক্রিয় তড়িৎ বর্তনী যুক্ত করা হয়। একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে গোললাইনে স্থাপিত চৌম্বকক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ করা হয়। যখন বলটি গোললাইন অতিক্রম করলে গোলপোস্টে স্থাপিত কয়েলে সংঘটিত পরিবর্তন সনাক্ত করে সফটওয়্যারটি এবং সাথে সাথেই রেফারির হাতে পরিহিত ঘড়িতে একটি রেডিও সিগন্যাল ও একটি মেসেজ পাঠায়। রেফারির ঘড়ি ভাইব্রেট করে এবং “গোল হয়েছে” বলে একটি মেসেজ পৌঁছে।
২০১২ সালের ফিফা ক্লাব কাপে GoalRef এর সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে।
Hawk-Eye প্রযুক্তি
বেশকিছুদিন ধরেই টেনিস, ক্রিকেটে এই Hawk-Eye প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। ১৯৯৯ সালে আবিষ্কৃত এই প্রযুক্তি Triangulation নীতিকে কাজে লাগায়। স্টেডিয়ামের ছাদে, গোলপোস্টের নিকটেসহ প্রায় ৬-৭ টি স্থানে শক্তিশালী ও দ্রুতগতিসম্পন্ন ক্যামেরা লাগানো থাকে। এই ক্যামেরা দ্রুতগতির বলের বিম্ব নিখুঁতভাবে গঠন করে ও টাইমিং ডাটা রেকর্ড করে। প্রত্যেকটি ক্যামেরায় বলের আলাদা আলাদা বিম্ব গঠিত হয়। বিম্বগুলোকে একত্রিত করে বলের একটি ত্রিমাত্রিক বিম্ব গঠন করা হয়। যেটিতে বলের অবস্থানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ভুলের পরিমাণ হতে পারে মাত্র .১৯ মিলিমিটার। ক্যামেরার মাধ্যমে বলের অবস্থান এবং Flight ট্র্যাক করে একটি সফটওয়্যার। বলের বর্তমান অবস্থান, টাইমিং ডাটা , Flight হতে সফটওয়্যারটি বলের পরবর্তী অবস্থানও বলে দিতে পারে (ক্রিকেটে LBW এর সিদ্ধান্ত নিতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।)
বলের Flight, অবস্থান ও টাইমিং রেকর্ড হতে ডাটাবেজে বলের গ্রাফিক্যাল পথ একে তা রেকর্ড করে। ফলে অফিসিয়ালরা সহজেই ডাটা হতে বলের অবস্থান জানতে পারেন।
Hawk-Eye system
ফুটবলে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে বলটি গোললাইন অতিক্রম করেছে কিনা সে বিতর্ক দূর করতে। ইতিমধ্যেই ইংল্যান্ড বনাম বেলজিয়ামের ম্যাচে এর পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হয়েছে।
ফুটবলে বিতর্কের অবসান ঘটাতে এবারের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে গোললাইন টেকনোলজির ব্যবহার শুরু করতে যাচ্ছে ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস ফুটবল ফেডারেশন। শুধু তাই নয়, ২০১৪ সালে বিশ্বকাপে গোললাইন টেকনোলোজি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফিফা।
প্রযুক্তির ব্যবহার বারবার খেলাধুলায় বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছে। টেনিস, ক্রিকেটের পাশাপাশি এবার ফুটবলেও বিতর্ক কমাবে প্রযুক্তি তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
No comments:
Post a Comment