কম্পিউটার মনিটরের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সাকিব।গতিশীল লাল বিন্দুগুলো ত্রিকোণাকার সবুজ ত্রিভুজটার সর্বোচ্চ কাছাকাছি ধেয়ে আসছে দ্রুত।মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যে অস্বাভাবিক দ্রুততায় সর্বশেষ সাতটা ইউনিট মানুষ শূন্য হয়ে গেল।অনুমান করার চেষ্টা করলো সে-কতটা নির্মমভাবে মারা হয়েছে ওই বুদ্ধিদীপ্ত মানুষগুলোকে।বুকের বাঁ পাশে চিনচিনে একটা ব্যাথা অনুভব করলো সে।অজান্তেই লায়লার কোমল মুখটা ভেসে উঠলো চোখে।লায়লার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে।তাকে একটা ম্যাসেজ পাঠালো সাকিব-‘যা-ই ঘটুক না কেন,প্রবণতা অমর’।এক মুহূর্ত পরেই মাথার পেছন দিকে একটা ছোট্ট বিপ দিয়ে ফিরে এলো ম্যাসেজটা।লায়লার ইন্টার নিউরাল কমিউনিকেশান রিসিভার বন্ধ দেখাচ্ছে।ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয় সে।ইমারজেন্সী স্টিমুলেশান পাঠিয়ে তাকে জাগানোর ইচ্ছে হল না।মনে মনে মূল কম্পিউটারকে গাড় সবুজ পর্যায়ের সর্বোচ্চ সিকিউরিটি নিয়ে স্ট্যান্ডবাই থাকার নির্দেশ দিয়ে পরবর্তী করণীয় নিয়ে ভাবতে শুরু করলো সাকিব,ডুবে গেল একাগ্র চিন্তায়।
বিজ্ঞানময় হয়ে থাকা গত শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষতার ঝুলিতে অন্যতম সেরা সংযোজন ছিলো বায়োনিক মানুষ আবিষ্কার।প্রাকৃতিক এবং কৃত্তিম প্রত্যঙ্গের অদ্ভুত সুন্দর সমন্বয় ঘটিয়ে প্রথম বায়োনিক ম্যানকে এক দ্বৈত জীবন দান করে পুরো পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দিয়েছিলো তখনকার বিজ্ঞান।ভার্চুয়াল ইনফরমেশান ডেস্ক থেকে এব্যাপারে সব খুঁটিনাটি জেনে নিয়েছে সাকিব।এমনকি ক্যাজুয়াল টাইম রিজিউমিং করে সেই সময়ে ফিরে গিয়ে নিজের চোখেই প্রথম বায়োনিক ম্যানের গাঠনিক প্রক্রিয়া এবং কার্যকলাপের সীমা সংক্রান্ত সবগুলো ফিচার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে সে।রেক্সের প্রতি মানুষের ভালোবাসা এবং তার সীমাবদ্ধতাগুলোকে ঘুচিয়ে দেয়ার জন্য মানুষের অসামান্য পরিশ্রমের পর্যায় দেখে সে যারপরনাই অবাক হয়েছে। তখন ওই মানুষগুলো কি ভুলেও অনুমান করতে পেরেছিলো যে সত্তর-আশি বছরের ব্যবধানে এই বায়োনিক ম্যানের পরবর্তী সংস্করণই পৃথিবীকে মানুষশূন্য করার এক ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠবে অপ্রতিরোধ্যভাবে?
দুঃসহ সময়টার শুরু এখন থেকে বছর তিনেক আগে।সাকিবরা তখন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।ক্যাম্পাসে এসে জীবনটা হঠাৎ করেই পুরোপুরি পাল্টে গেল।চোখে বাঁধভাঙা স্বপ্নের জোয়ার-মানুষ হওয়া,পাশেই অদম্য আবেগের একনিষ্ঠ হাতছানি-লায়লা।ঘোরের মধ্যে কাটছিল সময়টা।মৃতপ্রায় মানুষহীন পৃথিবীটাকে আবারও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরিয়ে দিতে স্বদিচ্ছার কোন অভাব ছিলো না তাদের।এরও প্রায় একশ’বছর আগ থেকে চলতে থাকা স্নায়ুযুদ্ধ গত শতকের সত্তর দশকে বিধ্বংসী পারমানবিক যুদ্ধে পরিণত হলে ওই বিভীষিকার ফলস্বরুপ গোটা পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যাটা তখনকার সময়ের এক দশমাংশে পরিণত হয়। দুইশ’ বছরের ভূতুড়ে শাসন আর অভিশপ্ত ওই যুদ্ধটার ভয়াবহতা অতিক্রম করে তখনও যারা বেঁচে ছিলেন তারা অবশেষে নিজেদের মধ্যে তৈরি করে নিলেন এক ধরণের বৈশ্বিক ভালোবাসা,একসূত্রে গেঁথে গেল পৃথিবীটা।কিন্তু যে কোন প্রক্রিয়ার সমশক্তিসম্পন্ন বিপরীত প্রক্রিয়ার অবকাশ থাকাটা এই গ্রহের একটি মৌলিক নীতি এবং এর ফলেই দেখা দিল অবিশ্বাস্য আরেক বিপত্তি।পৃথিবী জুড়ে সংঘটিত ভয়াবহতম সেই পারমাণবিক যুদ্ধের কারণে প্রায় সামগ্রিকভাবে গোটা পৃথিবীতে বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয়,হাতে গোনা দু-একটি অঞ্চল ছাড়া গোটা পৃথিবীটা উদ্ভিদশূন্য হয়ে পড়ে।জীবনধারণের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের বিকল্প তখনও বের করা সম্ভব হয় নি বলে বেঁচে থাকার জন্য গাছপালাহীন পৃথিবীটাকে পরিণত করা হয় একটি বিশাল কৃত্তিম অক্সিজেন চেম্বারে।প্রক্রিয়ার নিরবিচ্ছিন্নতার জন্যই এই সেক্টরটিতে সম্পূর্ণ ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছিলো বায়োনিক ম্যানদের। তাছাড়া মানুষহীন পৃথিবীতে এই সেক্টরটায় বায়োনিক ব্যবহারের বিকল্পও ছিলো না। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিলো,কিন্তু হঠাত করে কোন এক বিচিত্র কারণে এই বায়োনিকরা মানুষ বিদ্বেষী হয়ে ওঠে।সম্ভবত ইতোমধ্যেই নিজেদের মধ্যে তারা কোন ধরণের পরিবর্তন ঘটিয়ে নিয়েছে এবং কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই এক রাতের মধ্যেই তারা মূল উৎপাদন স্থান থেকে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে অক্সিজেন চেম্বারের আওতাধীন সবগুলো অঞ্চলের মানুষকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।পরদিন মূল নেটওয়ার্কে তারা ঘোষণা করে যেহেতু তারা মানবিক দুর্বলতা এবং শারীরিক সীমাবদ্ধতায় মানুষের চাইতে যোগ্যতম তাই এই গ্রহে মানুষের আর কোন প্রয়োজন থাকতে পারে না,তদুপরি কিছু দিন পরপর ভয়াবহ সব যুদ্ধ বাঁধিয়ে নির্বোধ মানুষরা পৃথিবীর ক্ষতিই বেশি করে।এটা বলেই বায়োনিকরা পুরো পৃথিবী থেকে খুঁজে খুঁজে অবশিষ্ট মানুষগুলোকে হত্যা করতে শুরু করে।
গাঢ় সবুজ পোশাকে আপাদমস্তক পরিহিত হয়ে ঘন ঝোপের আড়ালে বসে কঠোর দৃষ্টি নিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে চন্দ্রা চৌধুরী।এয়ার ওয়েভ কাউন্ট করে তথ্য আপডেট করা ইনিমি ডিটেক্টিভের মাধ্যমে একটু আগেই সে জানতে পেরেছে যে অন্তত বারোটি বায়োনিক ম্যানের ওই দলটি টের পেয়ে গেছে যে পৃথিবীর সর্বশেষ জীবিত মানুষগুলো এই অঞ্চলে বেঁচে আছে,অদম্য এই মানুষগুলোকে হত্যা করে পৃথিবীকে কলঙ্কমুক্ত করার জন্যই তারা এই অঞ্চলে তাদের সর্বশেষ অভিযান চালাবে আজ। হাতের ইলেকট্রিক ডিভাইসটির দিকে তাকালো চন্দ্রা,সেটি প্রতি মুহূর্তেই বলে যাচ্ছে যে পৃথিবীতে সে ছাড়া এখনো আরো দুজন মানুষ বেঁচে আছে এবং তারা আশেপাশেই কোথাও আছে। মনে মনে তৈরি হয়ে নিল সে,অপেক্ষা করতে লাগলো যন্ত্রমানবদের আগমনের জন্য,তাকে হত্যা করার জন্য তাদেরকে এখানেই আসতে হবে।
মাথার ভেতর খুব দ্রুত কম্পিউটারকে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে সাকিব।সিকিউরিটি লেভেল বারবার দুর্বল হয়ে যাওয়ায় কয়েক সেকেন্ড পরপরই তা পরিবর্তন করে গাঢ় সবুজ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে। বায়োনিকদের সার্ভার নেটওয়ার্ক ভেঙে ওখান থেকে রেডমার্ক তথ্যগুলো গায়েব করে দিতে হবে তাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সাথে ফরোয়ার্ড ডিফেন্স নিয়ে কাজ করা অবস্থায় সাকিবরা জানতে পেরেছে যে নিজেদের মধ্যে বিশেষ ধরণের পরিবর্তন করে নেয়া বায়োনিকদের একমাত্র দুর্বলতা হচ্ছে সবুজ রঙের ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোন ধারণা নেই,সবুজ বা সবুজাভ কোন কিছুর অস্তিত্ব তারা টেরই পায় না।পুরো পৃথিবী অসবুজ হয়ে যাওয়ায় দুএক জায়গায় এর সামান্যতম অস্তিত্ব নিয়ে বায়োনিকরা মোটেই ব্যস্ত নয়।তৃতীয় বিশ্বের অবহেলিত দেশ এবং শক্তিতে সর্বাপেক্ষা দুর্বলদের কাতারে থাকা বাংলাদেশ বিধ্বংসী পারমাণবিক যুদ্ধে অংশ নেয়ার যোগ্যতা না রাখায় এবং যুদ্ধের সময় কারো প্রতি আক্রমনাত্মক রক্তচক্ষু প্রদর্শন না করায় ভয়াবহ যুদ্ধটার মারাত্মক প্রভাব থেকে এখানকার কিছু অঞ্চল বেঁচে যায়।ফলে এই অঞ্চলগুলো পৃথিবীতে অবশিষ্ট একমাত্র প্রাকৃতিক অঞ্চলে পরিণত হয়। অন্য আর কোন উপায় না থাকায় অপ্রতিরোধ্য বায়োনিকদের প্রতিহত করার জন্য সবুজের দ্বারস্থ হওয়াটাকেই উপযুক্ত মনে করে সাকিব।তার ঠিক সোজাসুজি বিপরীত দিকে একই সিস্টেমের অর্ধেক অপারেশান স্ট্যাটাস নিয়ে অপেক্ষা করে আছে লায়লা। বায়োনিকরা আরো কাছাকাছি চলে আসায় ইন্টার নিউরাল কমিউনিকেশানে লায়লাকে আরো দুহাজার গজ পেছনে সরে যেতে বলল সাকিব।অক্সিজেনের গ্যাসীয় তরঙ্গ ব্যবহার করে বাতাসে অবমুক্ত শব্দ থেকে মানুষের পরিকল্পনা জেনে যাচ্ছে বলে বায়োনিকদের কাছ থেকে তথ্য সংরক্ষন করার জন্য এবং পরিকল্পনা গোপন রাখার জন্য মানুষে মানুষে এক ধরণের বিশেষ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তৈরি করে নেয়া হয় এই ইন্টার নিউরাল কমিউনিকেশান সিস্টেম,যা দিয়ে নির্দিষ্ট মানুষটার সাথে মাথার ভেতরেই কথা বলা যায়।
-আমাদের নেটওয়ার্ক রেঞ্জের ভেতর আসতে ওদের আরো কত বাকি,সাকিব?
-মনে হচ্ছে দুমিনিটের মত লাগবে।
-সংখ্যায় কত ওরা?
-সর্বমোট সংখ্যাটা বারো।তবে আপাতত এদিকে আসছে ছয়টা। বাকিরা পেছন দিকে গেছে। সম্ভবত ওদিকে জীবিত আরো কেউ থাকতে পারে।
-সত্যিই কি আরো কোন মানুষ বেঁচে আছে?
-আমার তো তা-ই মনে হচ্ছে।না হলে তো ওদের সেদিকে যাওয়ার কথা না।
-আমরা তাদের সাহায্য করতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা যেন বেঁচে থাকেন।
-হ্যাঁ,আমরা নিশ্চয়ই তাদের সাহায্য করতে যাব।
-যেতেই হবে আমাদের। ভালোবাসাটা আমাদের জন্য খুবই জরুরি, তাই না সাকিব?
-হ্যাঁ,তাই।
একটানা বিপ বিপ শব্দ করে যেন আর্তনাদ করেই যাচ্ছে ইলেকট্রিক ডিভাইসটা।ওটা আপাতত বন্ধ করে রাখলো চন্দ্রা।সে যেখানে বসে আছে তার এক কিলোর মধ্যে এসে তাকে কেন্দ্র করে তিনে তিনে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে এদিকে আসা বায়োনিকগুলো। ডিরেকশন ওরা চেইঞ্জ করতে পারে না,পুরো চক্রটা ঘুরেই আবার একত্রিত হতে হবে ওদের। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে,সর্বোচ্চ তিনজনকেই তার প্রয়োজন ছিলো। সবুজ সানগ্লাসটা পরে উঠে দাঁড়ালো সে। কাছাকাছি থাকা তিনজনের দিকে এগিয়ে গেল দ্রুতপায়ে।একটু পরেই সামনাসামনি পেয়ে গেল ওগুলোকে। আরো কাছাকাছি এসে হামাগুড়ি দেয়ার ভঙ্গিতে বসে পড়লো সে। সামনে থাকা তিনটা বায়োনিককে পুরোপুরি বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। জিপিএস ট্রেকারের মাধ্যমে অবজেক্ট তাদের খুব কাছাকাছি আছে এটা বুঝতে পারলেও গাঢ় সবুজ হয়ে থাকার কারণে চন্দ্রাকে মোটেই দেখতে পাচ্ছে না ওগুলো। তার স্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে ঘুরপাক খেতে শুরু করলো ওগুলো,লক্ষ্যহীন হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করতে লাগলো এদিক ওদিক। কাঙ্ক্ষিত সুযোগটা দ্রুত কাজে লাগালো চন্দ্রা। ওগুলোর পিঠের কাছাকাছি থাকা মূল প্রোগ্রাম ফোল্ডারগুলো খুলে নিল সে,একইসাথে বন্ধ করে দিল ওগুলোর লোকেশান রেইঞ্জ আপডেট সিগন্যাল।প্রায় সাথে সাথেই অথর্বের মত দাঁড়িয়ে পড়লো বায়োনিকগুলো। এবার চটপট ব্যাকপ্যাক থেকে তার বাবার ডেভোলপ করা তিনটি প্রোগ্রাম ফোল্ডার বের করলো সে। সেগুলো বায়োনিকদের অপারেটিং মডিউলে সেট করার আগে সে তাদের শ্বাসনালী থেকে স্পঞ্জের স্ট্র্যাপটা খুলে নিল,কৃত্তিম রক্তপ্রবাহ চালনাকারী সিস্টেম অন করে দিল। এরপর মূল প্রোগ্রাম ফোল্ডারগুলো জায়গামতো সেট করে দেয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই যেন রিস্টার্ট নিল বায়োনিকগুলো। প্রথম শ্বাস নেয়ার আশ্চর্যজনক অভিজ্ঞতার কারণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ওরা। তাদের প্রাকৃতিক হৃদপিণ্ড ডিবডিব শব্দ করতে লাগলো এবং কৃত্তিম রক্ত শ্বসনের টানে পৌঁছে যেতে লাগলো সর্বত্র। এতে প্রাকৃতিক প্রত্যঙ্গ সংশ্লিষ্ট প্রাকৃতিক বোধগুলো তাদের মধ্যে দেখা দিতে শুরু করে একটু একটু করে। তাদের দিকে তাকিয়ে এবার বলতে শুরু করলো চন্দ্রাঃ
আমার নাম চন্দ্রা,আমি একজন মানুষ,একারণে অন্য সব মানুষকে ভালোবাসি আমি,ভালোবাসা মানে হচ্ছে কাউকে অতি আপন ভাবা;তার সবকিছুকে গুরুত্ব দেয়া;সবসময় তার পাশে থাকা;বিপদে তাকে সাহায্য করা;নিজেকে তার জন্য নিরাপদ করে তোলা,আমি মনে করি পৃথিবীটা মানুষের জন্যই আর এই মানুষের পৃথিবীতে তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি,তোমাদের নাম হচ্ছে পাই,থিটা এবং আলফা।
কথাগুলো শুনে খানিকক্ষন হতভম্ব হয়ে রইলো বায়োনিগুলো। নিজেকে মানুষ দাবি করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রাণীটাকে তারা চেনে না কিন্তু কোন এক বিচিত্র কারণে তার প্রতি তাদের ভালোবাসা তৈরি হয়ে গেছে,মনে হচ্ছে এই প্রাণীটাকে বাঁচিয়ে রাখা তাদের দায়িত্ব। এইবার তারা বলে উঠল-'তোমার বলে দেয়া ভালোবাসার বৈশিষ্ট্যের আওতায় আমাদের মনে হচ্ছে আমরা তোমাকে ভালোবাসি'। কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থাকার পর হঠাত করে খুব কান্না পেয়ে গেল চন্দ্রার,বাবার কথা খুব মনে পড়লো,প্রোগ্রামগুলো বাবার অনেক পরিশ্রমের ফল,কিন্তু তাদের জন্য ক্রমাগত হুমকি হয়ে উঠছিলেন বলে তাকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেছে বায়োনিকগুলো। তবে মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসার ফলাফলটা শেষ পর্যন্ত মুছে যায় নি। সবুজ রঙের বাড়তি পোশাকটা খুলে নিয়ে হাতের ইলেকট্রিক ডিভাইসটা আবারও অন করলো চন্দ্রা। বাকি তিনটা বায়োনিককে লোকেট করে সেই দিকে এগিয়ে চললো সে। বৃহত্তর স্বার্থে নিজের জীবন উৎসর্গ করার অনেক মানবীয় ইতিহাস সে জানে,আজ তার সুযোগ এসেছে সেই ইতিহাসের অংশ হওয়ার। তার প্রতি পাই,থিটা এবং আলফার এক ধরণের ভালোবাসা তৈরি হয়েছে,তাই খুনি বায়োনিকগুলোর দ্বারা তাকে খুন হতে দেখলে ওগুলোকে তারা নিশ্চিত ধ্বংস করে দেবে। আর কোন বিকল্প নেই। বাকি দুজন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে চলার গতি দ্রুত হতে থাকলো চন্দ্রার,আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে সে তারপরও চেহারায় ছড়িয়ে পড়লো তৃপ্তির হাসি,সদ্য জন্ম নেয়া শিশুর মত তাকে অনুসরণ করলো পাই,থিটা এবং আলফা।
ছয়টা বায়োনিক সাকিব এবং লায়লার মাঝামাঝি জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর দুদিক থেকে দুটো সিগন্যাল আসছে বুঝে তিনে তিনে ভাগ হয়ে তাদের দুজনের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো দুটি দলে। নিজেদের কাজ শুরু করে দিল সাকিবরা। প্রথমে দুদিক থেকে দুটো ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ পাঠিয়ে বায়োনিকগুলোকে ঘিরে এক ধরণের বলয় তৈরি করে নিল তারা। তারপর দুটো ভিন্ন মাত্রার সার্চ ওয়েভ দিয়ে ওই বলয়ের সর্বত্রই তাদের মূল কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম খুঁজতে লাগলো তারা।নিজেদের রক্তকণিকার ক্ষরণ থেকে উৎপন্ন শক্তির মাধ্যমে স্থির থেকেও সার্চ ওয়েভগুলোর সাথে নিজেরাও ঘুরতে পারছে ওরা। সময় খুবই কম,শরীরে রক্তের পরিমাণ ধীরেধীরে কমে যাচ্ছে যা শুষে নিচ্ছে ওয়েভগুলো,আবার এগিয়ে আসছে বায়োনিকগুলোও। বায়োনিকদের কম্পিউটার নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণকারী বায়োনিকটা ছিল লায়লার দিকে এগিয়ে যাওয়া সর্বশেষটা,তাকে পেয়ে গেল লায়লা,জানালো সাকিবকে,সাথে সাথে তাকে অনুসরণ করলো সাকিব। প্রথম মোড়টা ঘুরতেই বাধার মুখে পড়লো তারা,অবৈধ অনুপ্রবেশ প্রতিরোধকারী মারাত্মক প্রবাহের ইলেকট্রিক শক খেতে লাগলো। রক্তের পরিমাণ দ্রুত কমে আসছে তারপরও ইলেকট্রিক শকের বিপরীতে রক্তপ্রবাহ আরো বাড়িয়ে তা প্রতিহত করে এগিয়ে গেল তারা। কেন্দ্রের কাছাকাছি গিয়ে দুটো ওয়েভ একত্রিত করে সবুজের সর্বোচ্চ গাঢ়ত্বের পর্যায়ে নিয়ে বায়োনিকদের মূল নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়ে তারা। সাথে সাথে নিজের সার্চ ওয়েভকে স্পার্ক লেভেলে উন্নীত তা নেটওয়ার্কের চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিয়ে পাহারায় বসে লায়লা আর সাকিব খুব সাবধানতার সাথে একটি একটি করে মুছে দিতে থাকে ওই নেটওয়ার্কের সবগুলো তথ্য। কাজটা করে ফেলার সাথে সাথেই মূল কম্পিউটার থেকে কোন প্রকার নির্দেশ আসছে না বলে বায়োনিকগুলো একটা করে ঝাঁকি খেয়ে জড় পদার্থের মত দাঁড়িয়ে পড়লো যে যার জায়গায়। এবার সাকিব প্রয়োজনমত নির্দেশ পাঠাতে লাগলো স্থির হয়ে থাকা বায়োনিকগুলোর মূল নেটওয়ার্কে। পূর্বনির্ধারিত এই তথ্যগুলো সমন্বিতভাবে আসলে একটি মূল নির্দেশের আওতায় কাজ করবে আর তা হলো নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে দেয়া। সময় যেন থেমে আছে,নিঃশেষ হয়ে আসছে লায়লার চেতনা,অসহায়ের মত সাকিবের দিকে তাকিয়ে আছে সে,ধীরে পৌঁছে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে। জেগে থাকো লায়লা,আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড জেগে থাকো,প্লিজ-বলেই কাঁপা হাতে এন্টার বাটনটায় চাপ দিল সাকিব,কাজটা শেষ করে অচেতন লায়লাকে নিয়ে নিজেদেরকে ওই নেটওয়ার্ক রেঞ্জ থেকে বের করে নিয়ে এলো। এর কয়েক সেকেন্ড পরেই আকস্মিক ভাবে সচেতন হয়ে উঠল এতক্ষণ নির্জীব হয়ে থাকা বায়োনিকগুলো। সম্মোহিতের মত কয়েক সেকেন্ড থেমে থেকেই তারা ফিরে গেল তাদের আগের জায়গায় এবং একটি একটি করে নষ্ট করতে শুরু করলো নিজেদের প্রত্যঙ্গগুলোকে।একটু পরেই ওই জায়গাটায় কিছু বিচ্ছিন্ন ধাতব প্রত্যঙ্গের মাঝে হলদে রঙের তরলে মাখা কয়েকটি মানুষের হৃদপিন্ড পড়ে থাকতে দেখা গেল।
ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো লায়লা। একটি মুখ উদ্বিগ্নভাবে তার উপর ঝুঁকে আছে। তখনও পুরোপুরি চেতনা আসেনি তবুও ওই মুখের দিকে একবার তাকিয়েই লায়লার মনে হলো তার আর কোন চিন্তা নেই,নিশ্চয়ই সব ঠিক হয়ে গেছে,নিশ্চয়ই সব ঠিক হয়ে যাবে।'লায়লা,আমাকে শুনতে পাচ্ছো? আমি সাকিব'। হ্যাঁ,সাকিব,আমি জানি তুমি কে,এভাবে বোকার মত নিজের নাম বলছো কেন?-হাসিমুখে প্রতিউত্তর দিল লায়লা,সাকিবের হাত ধরে প্রবল আত্মবিশ্বাসে উঠে দাঁড়ালো সে।শরীরে বিন্দু পরিমাণ শক্তি অবশিষ্ট নেই তবুও অন্য জীবিত মানুষগুলোকে সাহায্য করার জন্য অদম্যভাবে সামনে এগিয়ে গেল ওরা। একটু পরেই আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে তিনটা বায়োনিক একজন মৃত মানুষকে কোলে তুলে ধরে এগিয়ে এল ওদের দিকে-একটি মেয়ে। কাছে এসে ওই বায়োনিকগুলো নিজেদের পরিচয় দিল পাই,থিটা এবং আলফা বলে। তারা বলল-'আমরা জানি ভালোবাসা কি,আমরা জানি পৃথিবীটা মানুষেরই জন্য,আমরা মানুষকে ভালোবাসি। এই মানুষটি আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে ভালবাসতে হয়'। মেয়েটিকে চেনে না সাকিব-লায়লা তারপরও অনেকটা কষ্ট নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে তারা। সামনে একটি নতুন পৃথিবী গড়ার হাতছানি তাদের। ভালোবাসা দিয়ে আবারও পৃথিবীটাকে সাজিয়ে তুলবে তারা,মানুষেরই জন্য।
নামঃ ইমরান হোসাইন
ডিপার্টমেন্টঃ সমাজবিজ্ঞান,২\২
মোবাইল নংঃ ০১৯৬০৩৫৮৩৫৬
No comments:
Post a Comment