Tuesday, December 10, 2013

গণিতের প্রতিদিন

কিভাবে কাটে গণিতের প্রতিদিন? মানে, গণিত কিভাবে এগিয়ে যায়? কিংবা কিভাবে এগিয়ে এসেছে এই পর্যন্ত?

 

সাধারণত আমাদেরকে গণিত শিখানো হয় এমনভাবে, যেন গণিত সকল সত্যগুলি নিষ্প্রাণ-পাষাণ পাথরে খোদাই করা ছিল। গণিতের বইগুলিতেও সাধারণত বিভিন্ন উপপাদ্য (Theorem) ও সেগুলির প্রমাণ (Proof) একটা নিছক আনুষ্ঠানিক আবহে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে।

 

কিন্তু এই ঢংয়ের উপস্থাপনা কখনোই গণিতের বিভিন্ন তত্ত্বের আবিষ্কারের মনোহর প্রক্রিয়ার ছবি ফুটিয়ে তুলে না আদৌ।

 

এই প্রক্রিয়া শুরু হয় বিভিন্ন ধারণা ও উদাহরণ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি হতে, তারপর প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুঁড়াছুড়ি, এরপর অনুমান (Conjecture) তৈরি করা, এবং সবশেষে প্রমাণ (Proof) কিংবা বিরুদ্ধ-উদাহরণ(Counter-example) কোন একটা খুঁজে বের করে সেই Conjecture-এর একটা গতি করে দেওয়া।

 

হুম, খুব সহজেই বলে ফেললাম প্রক্রিয়াটা কেমন। কিন্তু একটু ভাবলেই বুঝা যাবে যে, এই প্রক্রিয়ার একেকটা ধাপ মানে একেকজন গণিতবিদের দিনের পর দিন খাটুনির গল্পের শিরোনাম।

 

 

বিশ্বাস করুন কিংবা নাই করুন, আজকের দুনিয়ার সকল গণিত বইয়ের সকল তত্ত্ব, ধারণা এভাবেই গড়ে উঠেছে।

 

গণিতবিদরা প্রথমে বিভিন্ন বিশেষ বিশেষ উদাহরণ ঘেঁটে দেখেন। এই সকল বিশেষ উদাহরণ নিয়ে ঘাঁটাঘাটি কিংবা বিভিন্ন প্যাটার্নের পারষ্পরিক সামঞ্জস্যতার আবিষ্কার ইতি টানে একটি Conjecture বা কনজেকচারের দিকে।

 

আবার কোন একটা প্রমাণিত উপপাদ্যের স্বীকার্যকে সিদ্ধান্ত ও সিদ্ধান্তকে স্বীকার্য ধরে নিয়ে আরেকটি শক্তিশালী কিংবা অন্তত শোভন কনজেকচারের জন্ম দেওয়া যেতে পারে।

 

আবার কখনো কখনো কনজেকচার আসে একজন গণিতবিদের অন্তর্চেতনা হতে, মানে গণিতবিদের মন হঠাৎ বলে উঠে যে, এমন এমন ক্ষেত্রে তো, এমন হবে বলে ‘মনে হয়’; হুম এই ‘মনে হয়’ হতে আরেকটি কনজেকচার।

 

যাই হোক, একটি কনজেকচার যখন গঠিত হয়েই যায়, তখন কিভাবে গঠিত হলো---সেটা আর কোন নজর দেবার মত জিনিসই থাকে না; তখন সবটুকু মনযোগ চলে যায় সেটিকে প্রমাণ করার দিকে।

 

একটি কনজেকচার কি বলছে বা দাবি করছে, একজন গণিতবিদ প্রথমে সেটা পড়েন-বুঝেন ও অনুভব করেন; উনার যদি মনে হয় যে, এটা সত্য, তবে তিনি এটাকে সত্য বলে প্রমাণ করতে বসে যান। কিংবা উনার যদি কনজেকচারের দাবির সত্যতা নিয়ে খটকা লাগে, তবে তিনি সেটাকে মিথ্যা বলে প্রমাণ করতে বসে যান। মিথ্যা প্রমাণ করতে তিনি হয় অন্তত একটি উদাহরণ খুঁজতে বসেন , যা কিনা কনজেকচারের দাবির পরিপন্থী, গণিতের ভাষায় যার নাম Counter-example, অথবা তিনি সাধারণভাবেই এগুতে থাকেন।

 

যিনি সত্য বলে প্রমাণ করতে বসেছিলেন, তিনি যদি সত্য বলে প্রমাণ করতে পেরে যান, তাহলে তো গেলেনই; আর না পারলে চিন্তার টেবিলই উলটে ফেলেন, মানে ‘মিথ্যা নাতো আবার’ সেদিকে নজর দেন। এরপরও কোন সুরাহা না হলে, চিন্তার টেবিল আবারও উলটে ফেলেন। একইভাবে, যিনি মিথ্যা প্রমাণ করতে বসেছিলেন, তিনিও প্রয়োজনে চিন্তার টেবিল উল্টান, যতবার দরকার।

 

যদিও গণিতের ইতিহাসে অনেক কনজেকচারেরই অনেক দ্রুত মীমাংসা ঘটেছে, কিন্তু কিছু কনজেকচার গণিতবিদদের অনেক-অনেক দিন-বছর নাকে দঁড়ি বেঁধে ঘুরিয়েছে, কিছু এখনও ঘুরাচ্ছে।

 

অবশ্য ‘নাকে দঁড়ি বেঁধে ঘুরাচ্ছে’ --- এভাবে বলাটা নিতান্ত অভিযোগ করার মত হয়ে গেল। কিন্তু ‘অভিযোগ’ আসলে সাজে না, বরঞ্চ মোটেও ন্যায়নিষ্ঠ নয়; আমরা বড়জোড় ‘অভিমান’ করতে পারি। কারণ, এই যাদের কথা বলছি, যারা নাকি আমাদের ‘নাকে দঁড়ি বেঁধে’ ঘুরিয়েছে কিংবা ঘুরাচ্ছে বলে বললাম, তাদের নিয়ে ভাবতে গিয়ে গণিতের জগতে এসেছে অনেক নতুন দিগন্ত, উৎপত্তি হয়েছে গণিতের বেশ কিছু শাখার, যদিও কনজেকচারগুলি নিজে অধরা থেকে গিয়েছে।

 

অধরা থেকে যাওয়া অনেক কনজেকচারই অনেক সহজ কিছু কথা, কিন্তু প্রমাণ করা বড্ড কঠিন, হয়তোবা অসম্ভবও হতে পারে।

 

এবার একটু ব্যাখ্যা করা যাক Conjecture জিনিসটাকে।

 

জ্যামিতিসহ (Geometry) বিজ্ঞানের অনেক শাখাই উৎকর্ষ লাভ করেছে তখন থেকে, যখন থেকে মানুষ বিন্যাস-সামঞ্জস্যতা তথা প্যাটার্ন (Pattern) অনুধাবন কিংবা আবিষ্কার এবং প্রকাশ করতে শিখেছে।

 

জ্যামিতির অধিকাংশ যুক্তি-তর্কের সংঘটন হয় তিনটি ধাপে—

 

1) অনেক অনেক উদাহরণ কিংবা বিশেষ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়। অনেক অনেক চিত্রের সহায়তা নেওয়া হয় ও উপাত্ত টেবিল তৈরি করা হয়।

2) তারপর ঐসব উদাহরণ ও উপাত্ত টেবিল হতে একটি সাধারণ ‘অনুমান’ (Conjecture) টানা হয়।

3) তারপর গাণিতিক যুক্তিপ্রয়োগ করে গৃহীত অনুমান দাবিকৃত সকল ক্ষেত্রে সঠিক কি না, তা যাচাইয়ের চেষ্টা করা হয়।

 

গণিতের পরিভাষায়, ১ম ও ২য় ধাপকে একসাথে বলে আরোহী যুক্তিপদ্ধতি (Inductive Reasoning)। আরোহী যুক্তিপদ্ধতি হলো কিছু বিশেষ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তা হতে একটি সাধারণ রূপরেখার অনুমান টানা। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।

 

ধরা যাক, আপনি বিজোড় সংখ্যা নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করছেন।

 

তো আপনি দেখলেন যে, প্রথম বিজোড় সংখ্যাটি (Odd Number) হল 1। আবার দেখলেন যে, প্রথম দুইটি বিজোড় সংখ্যা হল 1 ও 3, যাদের সমষ্টি 4। আরেকটু এগুলেন, দেখলেন যে, প্রথম তিনটি বিজোড় সংখ্যা 1, 3 ও 5-এর সমষ্টি 9!!! হাঁ, 9 বলেই খটকা লাগল; মনে পড়ল যে, প্রথম 2 টার সমষ্টি ছিলো 4।

 

4 ও 9 দু’টোই যে বর্গসংখ্যা (Perfect Square), যথাক্রমে 2 ও 3-এর বর্গ; আবার এদেরকে পেয়েছেন যথাক্রমে প্রথম 2টা ও 3টা বিজোড় সংখ্যার সমষ্টি হিসেবে। আবার একটু গোড়ায় ফিরে গেলেন, “প্রথম বিজোড় সংখ্যাটি 1” এই কথাটিকেও তো একই রকমে বলা যায় যে, “প্রথম 1টি বিজোড় সংখ্যার সমষ্টি 1”, যাও কিনা একটি বর্গসংখ্যা এবং প্রথম 1টি বিজোড় সংখ্যার সমষ্টি হিসেবে পাওয়া।

 

ফলে আপনার মনে একটা আবছা ধারণা তৈরি হলো— প্রথম n সংখ্যক বিজোড় সংখ্যার সমষ্টি ‘মনে হয়’ n2। এই ‘মনে হওয়া’-টাকে আরেকটু শক্তিশালী করতে আপনি প্রথম 4টা, 5টা, 6টা বা 7টা বিজোড় সংখ্যার জন্য চেক করে দেখলেন যে, প্রত্যেকটি যাচাইই আপনার ‘মনে হয়’-এর পক্ষে কথা বলছে। মানে, আপনার অনুমান আরো শক্তিশালী হচ্ছে। এই অনুমানটাই Conjecture। এবং হাঁ, আপনি একটি Conjecture তৈরি করে ফেলেছেন।

 

আর শুরু হতে এই Conjecture-এ পৌঁছানো পর্যন্ত আপনি এতক্ষণ যা করলেন, এটাই আরোহী যুক্তিপদ্ধতি (Inductive Reasoning), এমনকি এর ভেতরে ভুল কিছুও করে থাকলে কিংবা ভেবে থাকলে, তাও আরোহী যুক্তিপদ্ধতির অংশ।

 

ঘটনাক্রমে এই Conjecture-টা সত্য; কিন্তু সকল Inductive Reasoning থেকে আসা সকল Conjecture সত্য নাও হতে পারে।

 

খেয়াল করুন, আপনি এই যে প্রথম 1টি, 2টি, 3টি……. 6টি কিংবা 7টি বিজোড় সংখ্যার সমষ্টি নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করলেন, গণিত বলে যে, আপনি ৭টি বিশেষ ক্ষেত্রে (Special Case) কাজ করেছেন; তারপর আপনি যখন এই সাতটি বিশেষ ক্ষেত্র হতে Pattern বের করে প্রথম n সংখ্যক বিজোড় সংখ্যার মানে যেকোন সংখ্যক বিজোড় সংখ্যার সমষ্টির চিন্তায় চলে এসেছেন, তখন গণিত বলে যে, আপনি সাধারণ ক্ষেত্রে (General Case) চলে এসেছেন।

 

এই বিশেষ ক্ষেত্র হতে সাধারণ ক্ষেত্রে উঠে আসাটা হল আরোহ যুক্তিপদ্ধতি(Inductive Logic); এই Induction-এর মাধ্যমে যখন কোন গাণিতিক ব্যাপার অনুমান করা হয়, তখন সেই গাণিতিক অনুমানটাই Conjecture।

 

আজকে এ পর্যন্তই। সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

 

মুহাম্মদ রাসেল পারভেজ

কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল

১ম বর্ষ, ২য় সেমিস্টার

No comments:

Post a Comment