Tuesday, December 10, 2013

সৃষ্টির যত কথা

বিশাল এই মহাবিশ্বের ছোট এই পৃথিবীর বাসিন্দা আমরা। এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণী আমারই। প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে সৃষ্টি আমাদের এই নিবাসের। আর মা্নুষ সর্বদা তার এই শেকড়ের সন্ধান করেছে চলেছে। কিভাবে সৃষ্টি হল এই পৃথিবী নামের গ্রহটির? যুগে যুগে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেরিয়ে নানান সময়ে তৈরি হয়েছে নানান মতবাদ। পুরাতন একটি মতবাদের উপর ভিত্তি করে কিংবা বাতিল করে তৈরি করা হয়েছে নতুন মতবাদ। তারপরেও সন্তুষ্ট হয়নি মানুষ। আবার এসেছে নতুন মতবাদ। এখনও এসব নিয়ে চলছে বিতর্ক। আমি আমার এই লেখায় দুই পর্বের মাধ্যমে আমাদের এই পৃথিবী সৃষ্টির ব্যাপারে কিছু জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য মতবাদ নিয়ে বলার চেষ্টা করব।

জেমস জিন্সের মতবাদ বা জোয়ার মতবাদঃ
নানান সময়ে পৃথিবী সৃষ্টির পিছনে নানান মতবাদ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও একটি ব্যাপারে কিন্তু বিজ্ঞানীরা একমত যে,পৃথিবী সৃষ্টির পিছনে রয়েছে সূর্যের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আর তাই আধুনিক বলি বা আদিই বলি সকল মতবাদই কিন্তু ঐ সূর্যের উপর ভিত্তি করেই। যেমন এই জেমস জিন্সের মতবাদটি। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেমস জিন্স ১৯১৭ সালে এই মতবাদটি উপস্থাপন করেন। এটি অনেকটা এইরকম -

আমাদের বিশাল এই মহাবিশ্বে রয়েছে গ্রহ,নক্ষত্র,ছায়াপথের মত আরও নানান মহাজাগতিক বস্তু। এখানে নক্ষত্রসহ অন্যান্য বস্তুর অবস্থান পরিবর্তনের ঘটনা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। এই মতবাদ অনুসারে ধারণা করা হয় যে এক সময় চলতে চলতে বিশাল এক নক্ষত্র সূর্যের সামনে এসে পড়েছিল। আর নক্ষত্রটির আকার সূর্যের চেয়ে বড় হওয়ায় তার আকর্ষণী ক্ষমতাও ছিল সূর্যের চেয়ে বেশি। আবার সূর্যের ভিতরেও কিন্তু চলছে এক ধরণের আকর্ষণী ক্ষমতা যা কিনা সূর্যের ভিতরকার বস্তুগুলোকে ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট। আমরা জানি সূর্যের ভিতরে প্রতিনিয়তই চলছে বিস্ফোরণ যার ফলে সূর্যপৃষ্ঠে সৃষ্টি হয় জোয়ারের মত একটা পরিবেশ। সেই বিশাল নক্ষত্রের ফলে এই জোয়ারের মাত্রা যায় আরও বেড়ে। যদিও সূর্যের নিজস্ব আকর্ষণী ক্ষমতার কারণে ভিতরকার বস্তু সৌরপৃষ্ঠ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে না। কিন্তু সেই দানবাকৃতির সেই নক্ষত্রের কারণে সৌরপৃষ্ঠ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বেশ খানিকটা অংশ। কি ভয়ানক কথা!! তবে এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সূর্য থেকে কিছুটা অংশ বিচ্ছিন্ন করলেও নক্ষত্রটি কিন্তু তা সাথে করে নিয়ে যেতে পারেনি। এর কারণটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক।যেহেতু নক্ষত্রটি ক্রমান্বয়ে সূর্যের নিকটতর হয়েছিল তাই তার আকর্ষণী ক্ষমতাও বেড়ে গিয়েছিল এবং উভয়ের আনুপাতিক গতিবেগও বেড়েছিল। সৌরপৃষ্ঠ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার সময় কিন্তু বিচ্ছিন্ন অংশটির উপর দ্বিমুখী বল কাজ করছিল। একটি ছিল সেই আগন্তুক নক্ষত্রটির টান এবং অপরটি সূর্যের নিজস্ব টান।এইসব ক্রিয়ার ফলে সেই বিচ্ছিন্ন অংশটির অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। তার আকার হয়ে গিয়েছিল অনেকটা মাকুর মত অর্থাৎ মাথা ও লেজের অংশ চিকন এবং মধ্যে মোটা। তো, সেই বিচ্ছিন্ন অংশটি সূর্যের টান ছেড়ে নক্ষত্রের দিকে আগালেও নক্ষত্রটি কিন্তু রাগ করে আপন গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ফলে নক্ষত্রের গতির সাথে তাল মেলানো সম্ভব হয়নি সেই বিচ্ছিন্ন অংশটির। কিন্তু বিচ্ছিন্ন আর আকারে ছোটো হলে কি হবে সেই বা কম যায় কিসে? তাই নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য সে ইতোমধ্যেই অর্জন করে নিজস্ব একটা গতিবেগ। এদিকে নক্ষত্রটি বেশ দূরে সরে গেলেও তার আদিনিবাস সূর্য কিন্তু বেশি দূরে যেতে না পারার কারণে তার আকর্ষনও অগ্রাহ্য করতে পারেনি। কিন্তু এর মাঝে যে সূর্য ব্যাটারও মাথা খারাপ। সে আর আগের মত কাছে টেনে নেয় না সেই অংশটিকে। আবার দূরেও ঠেলে দিতে পারে না। তাই সূর্য তার চারপাশে ঘোরার অনুমতি দেয় সেই বিচ্ছিন্ন অংশটিকে। সূর্যের প্রচন্ড তাপে সেই বিচ্ছিন্ন অংশটির পুরোটাই ছিল প্রথমে গ্যাসীয় আর আকার ছিল সেই মাকুর মত। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে প্রান্তের চিকন অংশ ঠান্ডা হয়ে আসে এবং তরলে পরিণত হতে থাকে। যেহেতু তরল আর গ্যাসীয় অবস্থা দুটি একসাথে থাকতে পারেনি তাই দুই প্রান্তের তরল অংশদুটি আলাদা হয়ে যায়। অবশ্য তরল হলেও এদের তাপমাত্রা ছিল প্রচন্ড। একই প্রক্রিয়ায় বিচ্ছিন্ন বাকি অংশগুলোও তাপ বিকিরণের মাধ্যমে খন্ডে খন্ডে ভাগ হতে থাকে। আর এই খন্ডগুলোর একটিই হল এক একটি গ্রহ। যাদের একজন আমাদের এই পৃথিবী। আবার গ্রহগুলোর ভিতরেও সূর্যের আকর্ষণে সৃষ্ট জোয়ারের কারণে বেশ কিছু অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে উপগ্রহের সৃষ্টি হয়। ঠিক এমনি ভাবেই সৃষ্টি হয় পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদ।

ইমানুয়েল কান্টের এর মতবাদঃ
বৈজ্ঞানিক যুক্তি নির্ভর মতবাদের মধ্যে ইমানুয়েল কান্টের এর এই মতবাদটিকে প্রাচীনতম বলে গণ্য করা হয়। এটি নীহারিকা প্রকল্প নামে পরিচিত।সুইডিশ বিজ্ঞানী সুইডেনবার্গের সহায়তায় ১৭৫৫ সালে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট গ্রহ-উপগ্রহের সৃষ্টি সম্পর্কে একটি মতবাদ প্রদান করেন। এই মতবাদ অনুযায়ী সূর্যসহ সৌরজগতের সকল গ্রহ-উপগ্রহ সমূহ এককালে একটি প্রসারিত নীহারিকা ছিল। ঘূর্ণায়মান এই নীহারিকার ভিতরে বিভিন্ন বস্তুর অবস্থান ছিল। এই বস্তুসমূহের মধ্যে আলাদা আলাদা আকর্ষণী শক্তিও ছিল। পারস্পরিক এই আকর্ষণের ফলে এসকল বস্তুসমূহের মাঝে সৃষ্টি হয় সংঘাতের। ফলে সৃষ্টি হয় প্রচন্ড উত্তাপের। একসময় “নিশ্চল” বস্তুকণার সমন্বয়ে গঠিত এই নীহারিকার মাঝে উত্তাপ,ঘূর্ণনবেগ ও গতির সঞ্চার হয়। এরই ফলে নীহারিকা থেকে আংটির আকারের কিছু বস্তু নীহারিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।এভাবে গ্রহের জন্ম হয় এবং তা থেকে উপগ্রহের পরবর্তীতে জন্ম হয়।

বলয় মতবাদঃ
নীহারিকা প্রকল্পে কিছু পরিবর্তন এনে ১৭৯৬ সামে সাইমন দ্যা লাপ্লাস একটি মতবাদ দেন। এই মতবাদ ইমানুয়েল কান্টের মতবাদে বর্ণিত নীহারিকাটিকে কান্টের মত নিশ্চল ও ঠান্ডা মানতে নারাজ। লাপ্লাস দাবি করেন যে,নীহারিকাটি সূচনাকালেও ঘূর্ণায়মান গতি সম্পন্ন এবং উত্তপ্ত ছিল।কালক্রমে তা বিকিরণ প্রক্রিয়ায় তাপ হারায় ও সংকুচিত হয়।এসময় তার কৌনিক ভরবেগের সমতা রক্ষার প্রয়োজনে এর ঘূর্ণনবেগ বাড়ে।ফলে সংকোচন দশায় এর উত্তাপ বাড়ে।এইসকল প্রতিক্রিয়ার ফলে নীহারিকাটি এক সময় দৈর্ঘ্যের চেয়ে প্রস্থে বেশি প্রসারিত হয়ে চাকার মত আকার ধারণ করে।যতই দিন বাড়তে থাকে ততোই চওড়া অংশটির আকার বাড়তে থাকে।ফলে এক সময় বলয়ের আকার বিশিষ্ট একটি অংশ নীহারিকাটি থেকে আলাদা হয়ে যায়।আলাদা হয়ে যাওয়া অংশ থেকে সৃষ্টি হয় গ্রহ-উপগ্রহের আর যে অংশটি মূল নীহারিকার সাথে থেকে গিয়েছিল তা পরিণত হয়য় সূর্যে।

অদ্বৈত মতবাদঃ
তুলনামূলক পরবর্তীতে এই মতবাদটি দেওয়া হয়েছে। আলফভেন নামক একজন বিজ্ঞানী এ মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি দাবি করেন যে, সমস্ত সৌরজগতের সৃষ্টি একটি মাত্র নক্ষত্র থেকে হয়েছে এবং একাধিক নক্ষত্রের মাঝে আকর্ষণ-বিকর্ষণ বা সংঘর্ষের কোনো প্রভাব এতে নেই। বরং এক বিশেষ ধরণের চুম্বকীয় শক্তির প্রভাবেই সৃষ্টি হয়েছে সৌরজগতের।

এছাড়া অন্যান্য মতবাদের মাঝে চেম্বারলেন ও মুলটনের মতবাদ,লিটলটনের মতবাদ,উইজ স্যাকারের মতবাদ এবং রাসেলের মতবাদ উল্লেখযোগ্য।

No comments:

Post a Comment