Tuesday, December 10, 2013

ফোর্স কন্ট্রোলার

রাত দশটা । পূর্নিমা রাত হলেও চাদটা যথেষ্ঠ কাল দেখাচ্ছে । মনে হয় আকাশে মেঘ করেছে । তবে আকতার সাহেবের মন আজ যথেষ্ঠ ভাল। যদিও ভাল থাকার কথা ছিল না । আকতার সাহেব বিজ্ঞানী হলেও প্রকৃতির সাথে উনার মনের একটা সংযোগ আছে এবং উনার কাছে  মনে হয় এটাই স্বাভাবিক । তবে মনটা ভাল থাকার স্বাভাবিক একটা  কারন হল বিজ্ঞানের অন্যতম অজানা আগ্রহ চারটি বলের একীভূতক্ষেত্র নিয়ে তার গবেষনার অগ্রগতি প্রায় শেষের দিকে। অনেক দিনের সাধনা ও ত্যাগ তিতিক্ষার ফলসরূপ আজ তিনি অধরাকে ধরতে পেরেছেন। ডাটা উপাত্তের সবকাজ কর্ম শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন।

হঠাৎ তার চোখে পড়ল ল্যাবরেটারির লাইট জ্বলছে। তিনি ল্যাবে ঢুকলেন,

:কি খবর অমিত এখনো বাসায় যাও নি?

:না স্যার ।আমাদের ফোর্সকার্ব এর ৭১৯ ক্ষেত্রের মান বের করতে পারছি না?

:কেন?

:কারন স্যার ফিবোনাচি ধারার ২৭ তম পদের মানের জন্য গোল্ডেন রেশিওটা মনে করতে পারছি না।

আকতার সাহেব কিছুটা আশ্চর্য হলেন, এতোবড় একটা গবেষনা সামান্য একটা মানের জন্য সাময়িক বন্ধ হয়ে আছে। তিনি মনে মনে ভাবলেন জ্ঞান ও তথ্যের মধ্যে পার্থক্য আমদের সামনে অনেকটা প্রকট।

:আচ্ছা লিখ, ১.৬১৮০৩৩৯৮৯………

আকতার সাহেব মানটি বলে চলে গেলেন। ইদানিং তার ও বেশী মান টান মনে থাকে না। আজ ১৮ বৎসর ধরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে শিক্ষকতা করছেন। সবকিছুকে জয় করলেও বার্ধক্যকে মানুষ এখনো জয় করতে পারেনি।

অমিত ছেলেটি তার রির্চাস সহযোগী। দারুন বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী কিন্তু ভীতু।

বাসায় আসার পর খাওয়া দাওয়া করে ঘুমাতে যাবেন হঠাৎ আকতার সাহেবের মনে পড়ল তিনি তার রিচার্স ডাইরিটি তার অফিসে ফেলে এসেছেন।নিজের প্রতি নিজেরই রাগ উঠছে।এই ধরনের ভুলে কাউকে দোষারূপ করা যায় না। তাই আবার তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হলেন। টিচার্স কোয়ার্টারে থাকেন। প্রায়ই অনেক রাত করে বাসায় ফেরেন। তবে এত রাতে ক্যাম্পাসে আসা হয়নি কোনদিন। আশ্চর্য রকম নির্জনতা চারদিকে।

রাত প্রায় একটা বাজে।

ডিপার্টমেন্টে ঢুকে অফিস থেকে ডাইরি নিয়ে বের হওয়ার সময় হঠাৎ লক্ষ্য করলেন ল্যবরেটারি থেকে নীলাভ একটি ক্ষুদ্র তরঙ্গের আলোক রশ্নি নির্গত হচ্ছে। তিনি আরও অবাক হলেন কারন নির্গত আলোক তরঙ্গের  ধর্ম আমাদের এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তরঙ্গের সাথে  কোন মিল নেই।

অবাক করা মত এতগুলো ঘটনা এত দ্রুত এক সাথে ঘটে যেতে পারে তা তিনি কোনদিন কল্পনাও করেননী।কোন ঘটনাই তার কাছে অবাক করার মত মনে হয় না। তবে এই মুহূর্তের ঘটনাগুলো শুধু চমকিত না রীতিমত ভয়াভয়। শিরা দিয়ে যেন অ্যড্রেনালিনের স্রোত বয়ে গেল। তিনি কম্পিত পদে ল্যাবরেটারিতে ঢুকলেন। তিনি ল্যাবরেটারির এককোণে জড়োসড়ো হয়ে বসা অমিত নামের ছেলেটিকে আবিষ্কার করলেন। চোখে মুখে স্পষ্ট ভয়ের চাপ। তার পর তিনি তার কম্পিউটারের দিকে তাকালেন সেখানে কিছু তরঙ্গকার লেখা ভেসে উঠছে।

:কি ব্যপার অমিত।

কোন একটা আওয়াজ শুনে ভয় যেন আরও দ্বিগুন বেড়ে গেল। পরে আকতার সাহেবকে দেখে কিছুটা ভরসা পেল। বুঝতে পারল মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে না।

:স্যার আমাদের গবেষনায় প্রাপ্ত ফলাফলগুলো সুপার কন্ডাক্ট্রর কেবলের মাধ্যমে কম্পিউটারে ইনপুট করার পর…

এক্ টানে এই কথাগুলো বলার পর যে কাউকেই থামতে হয়। কিন্তু অমিত ভয় ও ভরসার মধ্যবর্তী অবস্থানে আর কথা বলতে পারল না।

আকতার সাহেব ধীরে ধীরে কম্পিউটারের দিকে এগিয়ে গেলেন। সমস্ত ল্যবরেটারিটা যেন অন্য একটা জগত। কোন একটা অজানা কারনে তিনি নিজেকে এই মুহূর্তে এই জগতের বাসিন্দা ভাবতে পারছেন না।কিছু কিছু সময় মানুষের এই অদ্ভূত অনুভূতি গুলোর ব্যাখা পাওয়া যায় না। তারপর তিনি তার নিজের আবিস্কৃত ন্যানো ওয়েভ কনভার্টার দিয়ে মহাজাগতিক তরঙ্গগুলো বিশ্লেষন করতে লাগলেন। যতই বিশ্লেষন করছেন তার মুখ ততই নীলাভ হতে লাগল। আশ্চর্যের বিষয় হলেও সত্য এই মুহূর্তে তার মুখের রঙ লাল কিংবা ফ্যাকাসে সাদা হওয়ার কথা ছিল।

তিনি দেখতে পেলেন বিশ্বনিয়ন্ত্রক বল চারটি আসলে একটি সংকেত মাত্র। এটি বলের একীভূত ক্ষেত্র থেকেও বেশি কোন কিছু। যার জন্য তিনি নিজেও প্রস্তুত ছিলেন না। আকতার সাহেবের চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো পরাবাস্তব জগতের সেই বুদ্ধিমান প্রানিদের ক্রীয়াকলাপ। যারা চারটি বলের মাধ্যমে এতদিন ধরে আমাদের নিয়ন্ত্রন করে আসছে। যাদের অস্তিত্ত্ব খুজতে গিয়েই আমরা হয়েছি ধার্মিক কিংবা বিজ্ঞানী। তিনি আরও অবাক হলেন একটি তথ্য বিশ্লেষন করতে গিয়ে, সেই তথ্যে বলা হচ্ছে মানব জাতি আজ থেকে দুই হাজার বৎসর আগে ১৯৬৭ খ্রীঃ তাদের উপস্থিতি জানিয়ে মহাবিশ্বে যে তথ্য পাঠিয়েছে তা আমরা পেয়েছি যা আমাদের নিয়ন্ত্রিত তড়িৎ ও চৌম্বক বলের একীভবনের ফলে সম্বব হয়েছিল। যে দিন চারটি বলের একীভূত ক্ষেত্র তোমাদের জ্ঞানে ধরা পরবে সে দিন আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে।

আকতার সাহেব তার পকেটে থাকা ডাইরীতে হাত দিতে গিয়ে দেখলেন সেটি মাটিতে পড়ে আছে। তিনি তার শারীরিক অস্তিত্ব খুজে পেলেন না। তিনি খানিকটা ভয়পেয়ে গেলেন। আসলে খানিকটা না একজন মানুষের অস্তিত্ব নষ্ঠ হয়ে গেলে যতটা ভয় পাওয়া উচিত ঠিক ততটাই পেয়েছেন। নিজেকে কোনমতে সামাল দিলেন। তাকে প্রকৃত বিষয়টা জানতে হবে। তাই আবার কাজে মনোনিবেশ করলেন।

কম্পিউটার স্ক্রিন এর নিচের দিকের একটি অপশন বিশ্লেষন করে দেখলেন সেখানে লেখা তুমি কি আমাদের সাথে যোগযোগ করতে চাও “ঊড্রো আমান রয়”।

“এই নামে কি আমকে সম্বোধন করা হল” মনে মনে ভাবলেন আকতার সাহেব।

“তাহলে কি পরাবাস্তব জগতে সবারই আলাদা আলাদা নাম আছে এবং আমরা কি ওই জগতের প্রানিদের অস্তিত্ব মাত্র। ঠিক যেমন ফেসবুকে আমাদের এক আলাদা অস্তিত্ব আছে ওই অস্তিত্বের আবার আলাদা নাম থাকে, আলাদা জগত থাকে, হয়তোবা আলাদা সমাজও তাকে, যেটা আমারা নিয়ন্ত্রন করি। আমাদের এই অস্তিত্ব বিলিনের সাথে সাথে ওই অস্তিত্ব বিলিন হয়ে যায়। হয়তোবা আমাদের পরাবাস্তবের অস্তিত্ব বিলিন হওয়ার সাথে সাথে আমরাও বিলিন হয়ে যাই। এই ভাবেই চলতে তাকে প্যারালাল ইউনিভার্স”।

এত দ্রুত এত গুলো চিন্তা মাথায় আসে কিভাবে এর ব্যখা আপাতত জানা নেই। এই ব্যখার প্রয়োজন কিংবা সময় দুটুই এখন নেই।  এইসব হাবিজিবি চিন্তা করতে করতে হঠাৎ তিনি একটি নীলাভ সবুজ তরঙ্গ লক্ষ্য করলেন। সেটি বিশ্লেষন করার সাথে সাথে আকতার সাহেব চিৎকার করে উঠলেন। সেখানে লিখা ছিল “রয় তুমি এতক্ষন যা চিন্তা করেছিলে তা ছিল এই জগতের প্রধান ও প্রকৃত জ্ঞান তুমি তা অর্জন করে ফেলেছ তাই তোমাকে জ্ঞানের উন্নত জগতে যেতে হবে”। এই প্রথম তিনি ওয়েভ কলাপ্স থিওরী এর ব্যবহারিক প্রমান পেলেন।

এই অন্তিম মুহূর্তেও আকতার সাহেবের খুব হাসি পাচ্ছিল কারন ফেসবুকে তার এক বন্ধুর নাম ছিল “আমি ভালা মানুষ”।

 

সকালের সূর্য প্রতিদিনের মতো আজও প্রখর তেজ নিয়ে পূর্ব আকাশে উঠেছে। প্রথমেই শিশিরের ফোটায় সে তার নিজের চেয়ারাটা দেখে নিয়ে যাত্রা শুরূ করে অন্তিমের উদ্দ্যেশে। আজ খবরের কাগজের প্রধান শিরোনাম “শাবিপ্রবির পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও বিশিষ্ঠ পদার্থ বিজ্ঞানী ডাঃ মুহম্মদ আকতারুল আলমের রহস্যময় মৃত্যু, তার সহযোগী বাক প্রতিবন্ধি ও পাগলপ্রায় অবস্থা”।

কিন্তু ইতি মধ্যে আকতার সাহেবের নির্দেশ মতো তার সহযোগী অমিতের হাতে লেখা পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ডাইরী বাংলাদেশ বিজ্ঞান সংস্থার হাতে গিয়ে পৌছেছে।

ডাইরীর শেষ লাইন পড়ে একজন বিজ্ঞানীর কপালে কয়েকটা ভাজ দেখা দেয়, লাইনটি ছিল

“সৃষ্ঠির আদিতে যেমন শূন্য থেকে পদার্থ ও প্রতিপদার্থের সৃষ্ঠি হয়েছিল তেমনি মহাজাগতিক প্রতিপদার্থের স্পর্শে আমার দেহ নষ্ট হয়ে যায়, পর্দাথ আবার শক্তিতে রূপান্তরিত হয়(ওয়েভ কলাপ্স)”

বিজ্ঞানীটির কপালের ভাজে যে কথাটি ফুটে উঠেছিল “তাহলে কি মৃত্যুর পরও…”

2 comments: