ছোটবেলা থেকে কার্টুনে ভিনগ্রহবাসী প্রাণী দ্বারা আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী আক্রান্ত হওয়ার দৃশ্য কতবার যে দেখেছি তার হিসেব নেই! বিপন্ন পৃথিবীবাসীদের রক্ষার জন্য তখন আসে অনন্য ক্ষমতাশালী মানুষ। তাদের সাথে লড়াই করে রক্ষা করে এই ধরণীকে, আরো কত কি!
তখন ভয় লাগত, কী হবে যদি সত্যি সত্যিই সেই ভিনগ্রহবাসীরা আমাদের আক্রমন করে! এইসব ক্ষমতাশালীরা তো বাস্তবে নেই, তাহলে আমাদের রক্ষা করবে কে? যদিও আমাদের কাছে superman, batman, Spiderman নেই, তবুও আমাদের আছে এক অনন্য শক্তি, বিজ্ঞান ও অপরিসীম চিন্তাশক্তি। এই অনন্য শক্তি আমাদের এমন ক্ষমতা দিয়েছে যে আমরা এখন সবকিছুর জন্যই প্রস্তুত।
যাই হোক, এখন প্রশ্ন হল আসলে কি এলিয়েন বা ভিনগ্রহবাসী প্রাণী আছে? বিজ্ঞান কী বলে? বিজ্ঞান বলে, হ্যাঁ থাকতে পারে!
হ্যাঁ, কল্পকাহিনীর সেই ভয়ংকর দেখতে ভিনগ্রহী প্রাণী থাকার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
কীভাবে? বিজ্ঞানীদের কি ওরা বার্তা মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে নাকি ওদের অস্তিত্বের কথা? না, এখনো আমরা ওদের থাকার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাইনি। কিন্তু আমাদের, মানে এই পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা এটা মানতে নারাজ যে, আমাদের এই বিশাল মহাবিশ্বে শুধু আমরাই একমাত্র জীবিত প্রাণী । আর কোথাও কোনো জীবের অস্তিত্ব নেই।
ব্যাপারটা একটু খোলাসা করা যাক যে, কেন বিজ্ঞানীরা এমনটা ভাবেন। প্রথমে প্রশ্ন আসে আমাদের পৃথিবীর কি এমন বৈশিষ্ট্য আছে যার জন্য পৃথিবীতেই জীবনের সূচনা হতে পেরেছে?
মূলত কার্বন(carbon) ভিত্তিক প্রাণ ব্যবস্থায় (অর্থ্যাৎ পৃথিবীর প্রাণিদের মত প্রাণী) সৃষ্টি ও বিকাশে চাই পানি, অক্সিজেন, উপযোগী তাপমান, গ্রহে টেকটনিক সক্রিয়তা, প্রয়োজনীয় জৈব যৌগ, উপযুক্ত পরিবেশ, উপগ্রহ ইত্যাদি।
পৃথিবীতে কেন প্রাণ সৃষ্টি হল? প্রথম কথা হল পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির অন্যতম উপাদান পানি আছে। তাহলে, পৃথিবীতে পানি কী করে এসেছে এটা বের করলেই কিন্তু অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যায় । পানি কি পৃথিবীর মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে, নাকি বাইরের কোনো কিছু দিয়ে পরিবাহিত হয়ে এসেছে এটা জানতে পারলে বোঝা যাবে পানি কি আমাদের এই পৃথিবীরই তৈরীকৃত নিজস্ব সম্পদ, নাকি মহাবিশ্বেরই অসংখ্য কেরামতির একটি? এখন পর্যন্ত সবচেয়ে পরিচিত ও প্রচলিত মতবাদ অনুসারে এর জন্য দায়ী ধুমকেতু ও গ্রহাণুপঞ্জ এবং ধুমকেতুতে কিভাবে পানি এসেছে তা জানতে হলে চাই এটা জানা যে, গ্রহাণুপঞ্জ এবং ধুমকেতু কিভাবে তৈরী হয়েছে? দেখা যাক এটা বিশ্লেষণ করে কি পাই? তারার নোভা বা সুপারনোভার পর বিস্ফোরিত বহিঃখোলকের ছড়িয়ে যাওয়া অংশ থেকে নক্ষত্র ও তার গ্রহমণ্ডল তৈরীর পর বাকি থাকা কিছু হালকা গ্যাস ও ধূলিকণা বিভিন্ন ধুমকেতুতে ও গ্রহাণুতে পরিণত হয় এবং এদের তাপমান কম থাকায় এদের মধ্যে থাকা জলীয়বাষ্প ঘণীভূত হয়ে পানিতে পরিণত হয় (এই জলীয়বাষ্প নোভা ও সুপারনোভার সময় ঘটা অসংখ্য মিথস্ক্রিয়ার ফলেই তৈরী হয় বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন)। তাহলে আমাদের এই মহাবিশ্বে পানির এত উৎস আছে, কিন্তু শুধু পৃথিবীতেই কেন প্রাণ সৃষ্টি হল? যদি উক্ত প্রক্রিয়ার পৃথিবীতে পানি এসে থাকে তাহলে এটা নিশ্চিত যে, একই কারণে অন্য নক্ষত্রের গ্রহেও পানি পরিবাহিত হতে পারে!
প্রাণ সৃষ্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর তালিকায় এরপর আসছে উপযুক্ত তাপমাত্রার কথা যা প্রাণ সৃষ্টির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এই মহাবিশ্বে কোথাও অকল্পনীয় উষ্ণ আবার কোথাও হিমশীতল ঠাণ্ডা। প্রাণ সৃষ্টির জন্য এই দুটোর কোনোটিই উপযোগী নয়। চাই নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু এবং জলবায়ুর ভারসাম্য। বিজ্ঞানীরা প্রাণ সৃষ্টির উপযুক্ত তাপমাত্রা নির্ণয় করেন নক্ষত্র থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব নির্ণয়ের মাধ্যমে। এই দূরত্বের মধ্যে তাপমাত্রা মোটামুটি প্রাণ সৃষ্টির উপযোগী। তাই নক্ষত্রকে ঘিরে এই দূরত্ব পর্যন্ত অঞ্চলকে বলে “প্রাণমণ্ডল”। ক্ষুদ্র নক্ষত্রের (বিশেষ করে K,G,F গোত্রের নক্ষত্রগুলো) প্রাণমণ্ডল অপেক্ষাকৃত ছোট কিন্তু এদের সংখ্যা বেশী বলে এইসব নক্ষত্রে প্রাণ সৃষ্টির সম্ভাবনা বেশী ( আমাদের সূ্র্য(sun) G গোত্রের একটি নক্ষত্র)। এসব গ্রহে প্রাণ সৃষ্টির সম্ভাবনা আরেকটি কারণে বেশী, তা হল, এইসব গোত্রে থাকা নক্ষত্রসমূহের আয়ু অন্যান্য গোত্রের চেয়ে অনেক অনেক বেশী। এই কারণে এইসব নক্ষত্রের প্রাণমণ্ডলে থাকা গ্রহসমুহ প্রাণ সৃষ্টি ও বিকাশে প্রচুর সময় পায়।
শুধু উপযুক্ত তাপমান দিয়ে তো আর প্রাণ সৃষ্টি সম্ভব নয়, প্রাণ বিকাশে চাই মোটামুটি পৃথিবীর মত বায়ুমন্ডল যাতে অক্সিজেন থাকবে এবং অন্যান্য উপাদান সমুহ নির্দিষ্ট অনুপাতে থাকবে। এই জটিল, রহস্য ও বৈচিত্রময় মহাবিশ্বে পৃথিবীর ন্যায় বায়ুমন্ডল পাওয়া একেবারেই অসম্ভব নয় এই কথা তো সবাই মানবেন তাই না?
এইবার আসি প্রাণ সৃষ্টির উপযুক্ত গ্রহের কিছু অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যের কথায়। প্রথমে বলে রাখি, প্রাণ সৃষ্টির উপযোগী গ্রহে টেকটনিক সক্রিয়তা থাকতে হবে। এছাড়াও, আগ্নেয়গিরির উদগীরনও প্রাণ সৃষ্টির জন্য এক অতি প্রয়োজনীয় শর্ত। এছাড়াও গ্রহের থাকতে হবে নির্দিষ্ট সংখ্যক উপগ্রহ (গ্রহের আকারের সাপেক্ষে) কারণ উপগ্রহ গ্রহের পরিবেশের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে আছে এক অনন্য সমীকরণ যা ড্রেক সমীকরণ নামে খ্যাত। এই সমীকরণ নির্দেশ করে আমাদের ছায়াপথে (আকাশ গঙ্গায়) বুদ্ধিমান সভ্যতার সংখ্যা যাদের সাথে বেতার যোগাযোগ সম্ভব। নিম্নে সমীকরণটি দেখানো হলোঃ
N = R x fp x Np x fe x fl x fi x fc x L
N = আমাদের ছায়াপথে (আকাশ গঙ্গায়) বুদ্ধিমান সভ্যতার সংখ্যা যাদের সাথে বেতার যোগাযোগ সম্ভব;
R* = আমাদের ছায়াপথে তারা তৈরীর হার (যা প্রতিবছরে ২০ টি করে);
fp = গ্রহ আছে এমন তারার সংখ্যা;
Np = প্রতিটি নক্ষত্রের গড় গ্রহ সংখ্যা;
fe = পৃ্থিবীর গ্রহ থাকা সম্ভাবনা (প্রাণমন্ডলের গ্রহ);
fl = উক্ত fe সংখ্যক গ্রহে প্রাণের সম্ভাবনা;
fi = উক্ত fl সংখ্যক গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণী সৃষ্টির সম্ভাবনা;
fc = fi উক্ত সংখ্যক গ্রহে প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সম্ভাবনা;
L = সভ্যতার আয়ুস্কাল (বছরে);
ড্রেক সমীকরণের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :
• আমাদের ছায়াপথের বয়স প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর। প্রতি বছর মোটামোটি গড়ে ২০ টি করে নতুন তারা তৈরী হয় বলে মোট তারার সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার কোটি।
• বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন নিঃসঙ্গ তারাদের গ্রহব্যবস্থা থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী।(কারণ এসব তারা অন্য তারা দিয়ে খুব কমই প্রভাবিত হয় যার কারণে গ্রহ ব্যাবস্থা হয় অনেকটা স্থায়ী ও প্রাণ তৈরীর উপযোগী )
• তারার চারপাশে থাকা গ্রহের গড় সংখ্যা ৫-১০ টি ধরা হয়।
• সম্ভাব্য পাথুরে গ্রহে প্রাণ সৃষ্টির সম্ভাবনা বিজ্ঞানী কার্ল সেগানের মতে ১ (মানে সম্ভাবনা ১০০%) আর সবচেয়ে সন্দেহবাতিকের মতে 10^(-6)।
• মানুষের প্রাযুক্তিক সভ্যতার আয়ুষ্কাল ৫৫০০ বছর।
এই ড্রেক সমীকরণ শুধু একটি গাণিতিক রূপ যা কিছু তথ্যের ভিত্তিতে প্রাণ সৃষ্টির সম্ভাবনা প্রকাশ করে।
আর, প্রাণী যে সবসময় অক্সিজেন-গ্রাহী হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যেমন, বিজ্ঞানীরা বলেন, শনির গ্রহ টাইটানে মিথেন খেকো এককোষী জীব থাকতে পারে!
আসলে প্রাণ সৃষ্টি ও বিকাশ অত্যন্ত জটিল বিষয়। সবকিছুর প্রেক্ষিতে বিচার করলে মানুষের মত উন্নত ধরণের প্রাণী সৃষ্টির সম্ভাবনা অনেকটা কম, কিন্তু একেবারে অসম্ভব নয়। যেমন, হয়তো এমন অনেক গ্রহ আছে এই মহাবিশ্বে যাতে এককোষী বা সরল বহুকোষী প্রাণী সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু এখনো মানুষের মত চিন্তা শক্তিসম্পন্ন প্রাণী সৃষ্টি হয়নি, বা তাদের প্রাযুক্তিক সভ্যতার বিকাশ এমন হয়নি যে তারা আমাদের প্রেরিত বেতার উপলোব্ধি করে তার উত্তর দিতে পারে " এবং হয়ত এই কারণে আমরা এখন পর্যন্ত তাদের উদ্ভবের বা অস্তিত্বের খবর পাইনি অথবা হয়তো তারা এতই দূরে যে, আমাদের প্রেরিত রেডিও বার্তা এখনো তাদের কাছে পৌছায়ইনি। যেমন, সদ্য আবিষ্কৃত গ্রহ কেপলার-২২বি তে যদি বুদ্ধিমান প্রাণী থেকে থাকে তাহলে তাদের আমাদের প্রেরিত বার্তা পেতে ৬০০ বছর লেগে যাবে, আর তারা যদি বার্তা পাবার সাথে সাথেও উত্তর দেয় তাহলেও তা আমাদের কাছে আসতে লাগবে আরোও ৬০০ বছর!
উপরে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্য মোটামুটিভাবে বিদ্যমান এমন গ্রহ(এক্সোপ্ল্যানেট) এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে ৬১৬ টি! তাহলে চিন্তা করে দেখুন, আগামিকাল আপনি ঘুম থেকে উঠে এলিয়েন দেখতে পাবেন না এর কোনো নিশ্চয়তা আছে ?
No comments:
Post a Comment