অনন্ত পথে যাত্রা
‘প্রতিদিন রাত হলেই ওগুলো আসে।’
‘হায় আল্লাহ্, আজকেও আসবে! আজ যে কি করবে!’
‘গতকাল তো ফারহানাকে নিয়ে গেলো।’
‘ও এখনো ফেরত আসেনি?’
‘ফেরত দেওয়ার জন্য নিয়ে গেছে নাকি?’
‘আল্লারে! আজ যে কাকে নিয়ে যাবে!’
‘সুমাইয়া কিন্তু ফেরত এসেছে’
‘সে কি আর সুমাইয়া, সে তো ওর চেহারার অন্য কিছু।’
‘তা জানি ....... ’
মেয়েদের উত্তেজিত স্বরের এসব কথা শুনতে শুনতে রুমে ঢুকলাম। এত বছর মেসে থেকে ভার্সিটি জীবনের শেষ বেলায় এসে ভার্সিটির হোস্টেলে এলাম। তাই এখানে অধিকাংশই আমার কাছে নতুন মুখ। এই হোস্টেলটা নতুন হয়েছে, ৩দিন ধরে নতুন নতুন মেয়ে আসছে। তাই আমাকে দেখে কারো ভ্রুক্ষেপ হলোনা, নিজেদের আলোচনা চালিয়ে গেলো। লাগেজ রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কি আসে?’
‘ভূত।’
‘ভূত বলে এতো হালকা করোনা ব্যাপারটাকে, এটা বা এগুলো ভূতের চেয়ে অনেক শক্তিশালী কিছু।’
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় মেয়েদের নতুন হোস্টেল করেছে। কাছাকাছি জায়গা পায়নি বলে শহর ও ক্যাম্পাস থেকে কিছুটা দূরে একটা জনবিরল এলাকায় হোস্টেলটা করতে হয়েছে। এরকম এলাকায় ভূতের উপদ্রব থাকুক বা না থাকুক, গুজব থাকাটাই স্বাভাবিক। চারদিক দেখতে দেখতে বললাম,
‘তোমরা আয়তুল কুরসী পারো? আয়তুল কুরসী পড়লে জ্বিন-ভূত চলে যায়। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
জানালা দেখিয়ে একজন বলল,
‘প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ওই দিক দিয়ে কিছু বা কারা এসে রুমে ঢুকে, ঘুরে বেড়ায়, জিনিসপত্র ঘিরে অনেক কিছু বদলে দেয়। আবার অদৃশ্যও করে দেয় ।
বিশাল জানালার সাথে লাগানো পাশাপাশি চারটা খাট। খাটের উপর মেয়েরা বসে আছে। কারো কারো কোলে ছোট্ট ছোট্ট লোমশ তুলতুলে ছানা, ওদের পোষা প্রাণী। একটা খরগোশ, আরেকটা বিড়াল ছানা। বাকী দুটো চিনতে পারলাম না। বিকাল হয়ে আসছে, আরেকটু পর সন্ধ্যা নামবে। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে জানালাগুলো শক্ত করে আটকাতে লাগলাম, বললাম, ‘আর কিছু এদিকে ঢুকতে পারবে না।’
‘না পারলে তো ভালই ’, খুব একটা ভরসা পায়নি মেয়েরা।
‘যে হারিয়ে গেল, তার বাসায় জানাবে না?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘কেউ তো হারিয়ে যায়নি, আমাদের চোখের সামনে ওগুলো ওকে অদৃশ্য করে দিয়েছে। ওর বাসায় এ কথা বললে বিশ্বাস করবে?’
‘তাই বলে জানাবো না?’ একটু দিশেহারা কণ্ঠে বললাম।
‘লাভ নেই। কারণ ওকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তাছাড়া ওর চেহারার আরেকজন ফেরত আসবে।’
ওদের কথা বিশ্বাসযোগ্য না হলেও আর তর্ক করলাম না। কারণ এখানে সবাই বিজ্ঞানের ছাত্র, সুতরাং কেউই ভূতে বিশ্বাস করে না। কী ঘটছে বুঝতে না পারলেও, কেউই যে মিথ্যা বলছে না সেটা বোঝা যাচ্ছে।
‘সুমাইয়া কী করছে এখন?’ উত্তেজিত স্বরে কথা বলতে বলতে মেয়েরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এতক্ষণ খুব একটা পাত্তা না দিলেও ঘরটা খালি হয়ে যেতেই ভয় পেতে শুরু করলাম। কিছু ঘটবে কি না তার চেয়ে বেশি ভয় কী ঘটবে তা জানিনা বলে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে দেখে আরো ভয় পেয়ে গেলাম, ভাবলাম মাগরিবের নামাজ পড়ি। ওযু করতে গিয়ে শুনতে পেলাম ঘরের দরজা দিয়ে মানুষ ঢুকছে। তাড়াতাড়ি ওযু শেষ করে এসে দেখি হল কর্তৃপক্ষের কয়েকটা লোক আর আমার স্থানীয় অভিভাবক। নতুন জায়গায় আমার কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা দেখতে এসেছেন।
ভাবছি, সবাইকে জানানোর এটাই সুযোগ। কিন্তু কী বলবো ? সবাইকে বোঝাতে হলে আগে নিজ চোখে ঘটনা দেখতে হবে। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে, নিজ চোখে দেখা মানেই নিজে সেটার শিকার হয়ে যাওয়া; যা হওয়ার আজ রাতেই ঘটে যাবে; আমার আর মুক্তি নেই; এখনিই আমার শেষ সুযোগ। শেষ পর্যন্ত যুক্তির কাছে মন হার মানল। হাসিমুখে সবার সাথে কথা বললাম। ওনারা আমার অস্থিরতা টের পেলেন না, বা টের পেলেও সেটাকে নতুন জায়গায় আসার কারণে মনে করলেন। সবকিছু ঠিকঠাক দেখে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় জানিয়ে গেলেন যে কিছুক্ষণ পর আব্বু-আম্মু আমাকে দেখতে আসবেন।
এতক্ষণে বাইরে পুরো অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। আমি রুমের লাইট জ্বালাতে গেলাম, হঠাৎ জানালা দিয়ে একটা সাদা আলো ধীরে ধীরে রুমের ভিতরে ঢুকলো। ভীষণ তীব্র আলো; কিন্তু ছড়ানো নয়, অনেকটা লেজারের মত। আলোটার একপাশ ঘরের ভিতর, অন্যদিক জানালা দিয়ে বাইরে দূরে কোথাও, যেন সেখানে থেকে আলোটা দিয়ে কেউ সবকিছু দেখছে, স্পর্শ করছে, অনুভব করছে। আলো যে এভাবে ধীরে ধীরে আঁকা-বাঁকা হয়ে নড়াচড়া করতে পারে, দেখে তাজ্জব হয়ে গেলাম।
মেয়েরা তাদের পোষা প্রাণী গুলোকে খাটের উপর জানালার কাছে রেখে গেছে। আলোটা সবকিছু দেখে-শুনে খরগোশটার উপর গিয়ে স্থির হল। তারপর আলোর তীব্রতা এত বেড়ে গেলো যে আলোর চোটে খরগোশটা আর দেখা যাচ্ছে না। একটু পর আলোটার প্রখরতা কমে আগের তীব্রতায় ফিরে গেলো। আর আমি ভয়ঙ্কর আতঙ্ক আবিষ্কার করলাম .............
খরগোশটা মারা গেছে ? না, আরো ভয়ঙ্কর কিছু ।
খরগোশটা নেই ? না, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু ।
খরগোশটার তুলতুলে পশমি চামড়াটা সুন্দর করে বিছানো।
কী করব চিন্তা করার আগেই আলোটা জানালা দিয়ে বের হয়ে চলে গেলো ।
শান্তি পাওয়ার বদলে আরো ভয় পেয়ে গেলাম। কেননা আমার মনে হচ্ছে আলোটার মূল লক্ষ্য আমি। ঐ আলোর নিয়ন্ত্রকেরা তাদের গবেষণাগারে মানুষ তৈরি করতে চায়। যেহেতু আমি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রী, তাই তারা গবেষক হিসেবে আমাকে চায়। খরগোশের ঘটনাটা প্রমাণ করে দিয়েছে যে ওদের অমানবিক কাজ থামানোর ক্ষমতা পৃথিবীর মানুষের নেই। কিন্তু অন্তত নিজেকে তো এই জঘন্য ষড়যন্ত্র থেকে বিরত রাখতে পারি ?
এ্যনশিয়েন্ট এস্ট্রনট থিওরি বা প্রাচীন মহাকাশচারী তত্ত্বের একজন গবেষক হিসেবে আমি আন্দাজ করতে পারছি, এরা পৃথিবীর বাইরে নিজেদের মহাকাশযানে বসে তাদের বিশেষ প্রযুক্তির এই আলো পাঠিয়ে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা কে, কী বা কেমন, কেউ জানেনা। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ এই তত্ত্ব¡কে ভুয়া মনে করে, ফলে আমার পক্ষে এদের কথা কাউকে বিশ্বাস করানো সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।
আমি হোস্টেল থেকে বেরিয়ে ছুটতে লাগলাম। অদূরে আমার দাদু-বাড়ি। আমি দৌড়ায় দৌড়ায় সেখানে চলে এলাম, দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। এখন সবাই শহরে চলে গেছে, তাই এই বাড়িতে কেউ থাকেনা। মাঝে মাঝে পরিবারের সবাই একত্রিত হয়ে চাইলে এখানে আসে, তাই সামান্য কিছু আসবাবপত্র এখনো রয়ে গেছে। আমি দাদুর রাইফেলটা খুঁজে বের করলাম, যেটা দিয়ে দাদু মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন ।
এমন সময় আব্বু-আম্মু এসে ঢুকল। তাদের দেখে আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘এক্ষুনি আঙ্কেলের রিভলবারটা বের কর।’ আব্বু পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুমান করে তাড়াতাড়ি আলমারি থেকে রিভলবারটা বের করল। আম্মু আমার কাছে ছুটে এলো, ‘ কী ? কী হয়েছে ?’
হোস্টেলের পিছন থেকে কিছু মানুষ বেরিয়ে এসেছে। তারা এদিকে এগিয়ে আসছে। তাদের গায়ের রঙ ধবধবে সাদা, আবার কিছু কিছু জায়গায় কালো। ভালোভাবে লক্ষ করলে বোঝা যায় এদের মধ্যে মানুষের চেয়ে যন্ত্র- যন্ত্র ভাবটাই বেশি। এসবের কারণ, এরা এখনো মানুষ তৈরিতে ১০০ভাগ সফল হতে পারেনি। এদের দেখে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যেতে আসছে।’
আব্বু-আম্মু মনে করলো এরা বিদেশী লোক। আম্মু বলল, ‘আমাদের সাথে ওদের কথা হয়েছে। ওরা তোমাকে গবেষক হিসেবে চায়, ধরে নিয়ে যেতে চায় না।’
‘না, আমি যাব না ’, বলে তাদের দিকে রাইফেল তাক করলাম ।
‘ঠিক আছে, কথা বলো ওদের সাথে। কথা বলতে তো দোষ নেই ’, আব্বু পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করল।
‘আমি যাব না। ওরা জোর করে ধরে নিয়ে যেতে চাইলে তুমি গুলি করবে ’, আব্বুকে বললাম।
‘ঠিক আছে ’, বলে আব্বু রিভলবার রেডি রাখল।
ওরা ততক্ষণে দরজার কাছে চলে এসেছে। আমি রাইফেল কক করলাম। ওরা নরম স্বরে এমন ভঙ্গিতে আমার সাথে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাবে কথা বলা শুরু করল, যেন তারা নিরীহ মানুষ, ভিনদেশে এসে বিপদে পড়ে গেছে। কিন্তু আমি শোনামাত্র বুঝতে পারলাম এটা সত্যিকার মানবকন্ঠ নয়, যন্ত্রের মাধ্যমে আমার ভাষা ব্যবহার করে আমাদের সাথে যোগাযোগ করছে। আমি রাইফেল হাতে দূর থেকেই জবাব দিলাম যে আমি কোনো সহযোগিতা করতে অনিচ্ছুক।
তখন হঠাৎ ওদের থেকে একটা বাচ্চা মেয়ে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। বলতে লাগল, ‘ প্লিজ, তুমি চলো না আমাদের সাথে। তুমি গেলে অনেক মজা হবে।’
আব্বু-আম্মু এতক্ষণ গুরুত্ব দিয়ে বিপদ ঠেকাতে প্রস্তুত থাকলেও এখন আমার উপর বিরক্ত হয়ে গেলো।
‘একটা বাচ্চা ডাকছে, আর তুমি কিনা কথা বলতেও ভয় পাচ্ছ। ছি!’ দু’জনে বিরক্ত স্বরে বলল ।
এরা মানুষের আবেগও বুঝে ফেলেছে। শিশুর চেহারা ব্যবহার করে এরা মানুষকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করছে। কিন্তু আমি জানি যে এই বাচ্চাটিও মানুষ নয়।
মেয়েটি আমাকে ধরার পর আমার শারীরিক ও মানসিক প্রতিরোধের শক্তি হারিয়ে গেল, হাত থেকে রাইফেল খসে পড়ল। মেয়েটি আমার হাত ধরে সামনে নিয়ে গেলো ।
কি বোকা আমি! অকল্পনীয় অপার্থিব এই শক্তিকে কিনা আমি পৃথিবীর রাইফেল দিয়ে মোকাবেলা করতে চেয়েছিলাম! অথচ মেয়েটা শুধু স্পর্শ করেই আমার মন ও শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে।
আমরা সবাই সামনের রুমে সোফায় বসলাম। লোকগুলো ওদের গবেষণা ও আমার প্রয়োজনীয়তা, কাজ ইত্যাদি নিয়ে কথা শুরু করল। আমি রাজি নই, কিন্তু নাও করতে পারলাম না। তারা এখন আমার কথাও নিয়ন্ত্রণ করছে।
বাচ্চা মেয়েটির হাতে একটা টর্চ ছিল। সে দুষ্টুমির ছলে টর্চ থেকে আমার উপর আলো ফেলল। সেই তীব্র সাদা আলো, যা আমার রুমে ঢুকেছিল। আমি অনুভব করছি, আলোটা আমাকে শিকলের মত বেঁধে ফেলছে।
আব্বু-আম্মুর চোখের সামনে আমাকে আটকে ফেলল, কিন্তু উনারা টেরও পেলেন না। আমি উনাদের সাথে কথা বলতে চাইলাম, কিন্তু সবাই মিলে কথা বলতে বলতে দূরে চলে গিয়েছে। আমি একা খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ বুঝতে পারলাম, ওদের আমার মত গবেষক প্রয়োজন নেই। কারণ ওরা মানুষ ইতোমধ্যে তৈরি করে ফেলেছে। ওদের এখন প্রয়োজন সেই মানুষকে নিখুঁত করা। তাই তাদের প্রয়োজন মানুষের জ্যান্ত মস্তিষ্ক, যেটা কেটে-কুটে গবেষণা করে ওরা দেখতে ও বুঝতে চায় মানুষের আবেগ ও আচার-আচরণ। সে জন্যে আমাকে নিয়ে, চিরকাল বাঁচিয়ে রেখে আমার মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করবে।
ভয়ঙ্কর এই পরিণতির চেয়ে মৃত্যু অনেক আরামদায়ক। কাছেই রিভলবারটা পড়ে আছে। সেটার দিকে তাকালাম, কিন্তু সেটা নিতে পারলাম না; অদৃশ্য আলোর শিকলটা আমাকে রিভলবার নিতে দিল না। বুঝলাম, তারা আমাকে কখনোই মরতে দেবেনা। ধীর পায়ে বের হয়ে এলাম। ইচ্ছে হচ্ছে সবাইকে গিয়ে বলি যে আমি চলে যাচ্ছি, চিরকালের জন্যে, বিদায়। মৃদু পায়ে হোস্টেলে গিয়ে ঢুকলাম। মেয়েরা হইচই করছে। কয়েকজন আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দিল। কেউ দেখতে পেলোনা আমার বন্দিত্ব। টের পেল না আমার হৃদয় বিদারক কষ্ট। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে প্রিয় বন্ধুদের জড়িয়ে ধরি। পারলাম না।
আবার বের হয়ে এলাম। শেষবারের মত পৃথিবীকে দেখলাম। সময়ের সাথে এগিয়ে গেলাম অনন্ত মৃত্যুর দিকে।
লেখক: সাবিহা তাসনীম (জেসি)।
রেজি: ন : ২০১২১২২০০৩
বর্ষ : এম-২
বিভাগ : পদার্থবিজ্ঞান
মোবাইল নং : ০১৭৪৬১৪৯৪২৬
No comments:
Post a Comment