সাদমান সৌমিক
সিইপি ৩/২
আমরা যারা বর্তমানে অল্পস্বল্প কম্পিউটার, মোবাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করি তারা সবাই ‘প্রসেসর’ নামক বস্তুটার সাথে পরিচিত। কারো ল্যাপটপ, ডেক্সটপ অথবা হাল আমলের স্মার্টফোন গুলো দেখলে প্রথমেই আমরা জিজ্ঞাসা করে নেই যে এর প্রসেসর কী? কোন মডেল? স্পীড কত? তো কী এই প্রসেসর? সহজ বাংলায় বলতে গেলে এটি এমন একটি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস যা প্রোগ্রাম করা যায়। একে কম্পিউটার বা মোবাইলের হৃদপিণ্ড বলা যেতে পারে। আমরা আমাদের চারপাশে তাকালেই এর প্রচন্ড প্রভাবশালী দিকটা দেখতে পারি। তবে শুরুর দিকে এর চলার রাস্তা এখনকার মত এত মসৃণ ছিল না। এখন প্রসেসর বলতে আমরা যা বুঝি তার যাত্রা শুরু হয় আজ থেকে প্রায় ৪২ বছর আগে ইন্টেলের হাত ধরে। ১৯৭১ সালে ইন্টেল সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক ভাবে বাজারে নিয়ে আসে মাইক্রোপ্রসেসর(প্রসেসর এর কেতাবি নাম) INTEL 4004. এটি ক্যালকুলেটরে ব্যাবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। সমসাময়িক সময় আরো বাজারে আসে টেক্সাস ইন্সট্রুমেন্টস এর TMS-1000. এই দুইটি মাইক্রোপ্রসেসরই ছিল 4-bit এর। এর ঠিক এক বছর পরে ইন্টেল বাজারে নিয়ে আসে 8-bit এর INTEL 8008 মাইক্রোপ্রসেসর। ১০ মাইক্রোমিটার আয়তনের এই ডিভাইসটির মধ্যে ৩,৫০০ টি ট্রানজিস্টর ছিল। এর ক্লক স্পীড ছিল 200Khz. এটি প্রতি সেকেন্ডে ৬০,০০০ টি নির্দেশনা সম্পাদন করতে পারত। 4004 ও 8008 মাইক্রোপ্রসেসর তৈরির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল ছোট ছোট কাজের জন্য বানানো ছোট ছোট ডিভাইস গুলো বাজার থেকে সরানো। তবে এগুলো তৈরির উদ্দেশ্য ছিল মূলত কিছু নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন। মজার বিষয় হল তখনকার সময় গ্যাজেট হিসেবে ইলেক্ট্রনিক ক্যালকুলেটর আমজনতার মাঝে খুব জনপ্রিয় ছিল এখন যেমন স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট। একটা ক্যালকুলেটর এর দাম তখনকার সময়ে ছিল ১০০ ডলারের মত। এভাবে মাইক্রোপ্রসেসরের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে। অনেক প্রতিষ্ঠান 4-bit এর এই মাইক্রোপ্রসেসর তৈরিতে লেগে পড়ে। এগুলো embedded applications(শুধু নির্দিষ্ট কিছু কাজের জন্য) এর জন্য অনেক লাভজনক প্রমাণিত হয়। প্রথম মাইক্রোপ্রসেসর দিয়ে তৈরি মাইক্রোকম্পিউটার হল Micral. এটি Intel 8008 মাইক্রোপ্রসেসর দিয়ে তৈরি হয়েছিল ফ্রান্সে। প্রথম দিকের মাইক্রোকম্পিউটার গুলোর মধ্যে আরেকটি হচ্ছে Scelbi-8H. এগুলো খুব একটা বাজার না পেলেও ইন্টেল এর ভবিষ্যৎ বুঝতে পারে। তখন ইন্টেল 4004 ও 8008 এর ত্রুটি সংশোধন করে এবং এর কিছু আপগ্রেডেশন করে বাজারে ছাড়ে Intel 8080. এই মাইক্রোপ্রসেসর এর উপর ভিত্তি করে MITS নামক এক কোম্পানী বাজারে নিয়ে আসে মাইক্রোকম্পিউটার Altair 8800. এটি বাজারে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। Motorola মাইক্রোপ্রসেসরের বাজারে আসে ১৯৭৪ সালে 8-bit এর 6800 দিয়ে। এর মধ্যে 4000 ট্রানজিস্টর ছিল। এটি বানাতে ব্যবহৃত হয়েছিল NMOS টেকনোলজি। এটি মাত্র 5 volt ব্যাটারি সাপ্লাই তে কাজ করত। যদিও Intel 8080 এর থেকে এর অনেক সুবিধা ছিল তবু এটি মাইক্রোকম্পিউটার এর জগতে এর অবস্থান শক্ত করতে পারেনি। Motorola তখন প্রথমে General Motors ও পরে Ford এর জন্য 6800 দিয়ে গাড়ির জন্য embedded processor বানানোর বিশাল জগতে পা রাখে। তখন থেকে এখন পর্যন্ত Motorola এই জায়গায় প্রভাব বিস্তার করে আসছে। তবে সত্তরের দশকের শেষের দিকে এসে এই মাইক্রোপ্রসেসর গুলো গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। এদের বাজারও অনেক সংকুচিত হতে শুরু করে। Intel ও Motorola তখন 16-bit এর মাইক্রোপ্রসেসর বানানোর দিকে মনোযোগ দেয়। ইন্টেল বাজারে নিয়ে আসে 16-bit এর 8086 এবং মটোরোলা বাজারে নিয়ে আসে 16/32- bit এর Motorola 68000. এগুলো microcomputer এর জগতে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। embedded applications যেমন একটা ক্যালকুলেটর কেনার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের এর প্রসেসর সম্বন্ধে তথ্য না জানা থাকলেও কোন সমস্যা ছিল না। সে ক্ষেত্রে উচ্চ লাভের জন্য প্রস্তুতকারক সর্বনিম্ন দাম দিয়ে প্রসেসর কিনতে পারত। কিন্তু মাইক্রোকম্পিউটার এর জন্য সে সুযোগ আর থাকে না। কারণ ক্রেতারা তখন সফটওয়্যার কম্প্যাটিবিলিটি এর কথা মাথায় রেখে সেইরকম মানের প্রসেসর খোঁজেন।এতে করে মাইক্রোপ্রসেসর এর ব্যাবসা আলোর মুখ দেখে।আমরা এখন যেসব computer ব্যাবহার করি তার ভিত্তি গড়ে দেয় এই প্রসেসরগুলো। এই প্রসেসর এর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে microcomputer industry. ১৯৭৯ সালের দিকে প্রথম 16-bit এর মাইক্রোপ্রসেসর বাজারে আসে কিন্তু খুব কম ডেস্কটপ কম্পিউটারে এর ব্যাবহার দেখা যাচ্ছিল। অ্যাপল 6502 ব্যবহার করে বাজারে নিয়ে আসে Apple III কিন্তু এর দাম Apple II এর চেয়ে অনেক বেশি ছিল। হার্ডডিস্ক, মডেম, ফ্লপি ডিস্ক ড্রাইভের মত বহুল ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ গুলোও প্রথমবারের মত বাজারে আসে। এরই মধ্যে IBM, 8088 প্রসেসর ব্যাবহার করে PC নিয়ে আসে। এটির প্রসেসর স্পীড ছিল 4.77MHz, RAM 64KB, ROM 40KB, 5.25 inch floppy drive, PC-DOS 1.0(Microsoft’s MS-DOS) আর একটি monochrome monitor. ১৯৮২ সালের জুনের দিকে IBM এর প্রথম ক্লোন পিসি বাজারে নিয়ে আসে Columbia Data Products. এর কারণ IBM প্লাটফর্মের open nature. Open nature এর সুবিধা হল BIOS এর code এর সজলভ্যতা। এতে করে সবাই নিজেদের মত করে পিসি assemble করতে পারছিল।যদিও IBM ব্যাবসায়ীদের মধ্যে PC কে জনপ্রিয় করেছিল কিন্তু Commodore ঘরোয়া ব্যাবহারকারী দের মধ্যে একচেটিয়া ভাবে ব্যবসা করছিল। Commodore ১৯৮১ সালে VIC-20 নিয়ে আসে। এর মধ্য ছিল একটা সম্পূর্ণ কীবোর্ড, 5KB RAM এবং একটি 6502A CPU. এবং এটি টেলিভিশন সেটকে মনিটর হিসেবে ব্যবহার করত। এর দাম ছিল ৩০০ ডলার। এটি খুবই জনপ্রিয়তা পায়। এরপর ১৯৮৩ সালে Apple নিয়ে আসে Apple Lisa. এটিতে ছিল 5Mhz 68000, 1MB RAM, 2MB ROM, একটি সাদা কালো মনিটর, দুইটা 5.25 inch floppy drive আর একটি 5 MB এর হার্ডড্রাইভ। এর দাম ছিল 10,000 ডলার। Lisa সর্বপ্রথম গ্রাফিকাল ইউজার ইন্টারফেস নিয়ে আসে। Apple প্রথম তার বিখ্যাত Macintosh computer বাজারে নিয়ে আসে ১৯৮৪ সালে। এতে ছিল 8MHz এর 68000 প্রসেসর, RAM 128KB, 400KB এর 3.5 inch এর floppy drive এবং একটা মাউস। আশির দশকের মাঝামাঝি তে কম্পিউটার সবার ডেস্কে পৌঁছে যায়। এরপরের ঘটনাবলী শুধু মাইক্রোপ্রসেসরের এগিয়ে যাওয়ার। পৃথিবীকে প্রথম true 32-bit প্রসেসরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় AT&T Bell Labs ১৯৮০ সালে. এটি বাজারে নিয়ে আসে BELLMAC-32A ১৯৮১ সালে ইন্টেল এরপর বাজারে আনে 32-bit এর মাইক্রোপ্রসেসর iAPX 432. কিন্তু এটা ততটা ব্যবসাসফল হয়নি। ARM প্রথমবারের মত বাজারে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৮৫ সালে। এটি এসেই সেলুলার ফোনের মার্কেট ধরে ফেলে। আমরা একটু খেয়াল করলেই দেখতে পারব যে এখনকার সময়ের সেলুলার ফোনের প্রসেসর গুলোর সিংহভাগ ARM এর দখলে। ১৯৮৫ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত এই 32-bit প্রসেসর গুলো বাজার দখল করে রাখে। ইন্টেল Pentium ছাড়া তাদের বাকি প্রসেসর গুলোর আর্কিটেকচার লাইসেন্স অন্যান্য কোম্পানী কে দিয়ে দেয় এইজন্য AMD ও Cyrix কে পরবর্তীতে নিজস্ব আর্কিটেকচারে মাইক্রোপ্রসেসর বানাতে হয়েছিল। 2003 সালের সেপ্টেম্বর এর দিকে Intel ও AMD বাজারে নিয়ে আসে 64-bit এর প্রসেসর। এটিতে 32-bit এর সফটওয়্যার সাপোর্ট করে। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরের হিসেব অনুযায়ী ইন্টেল মাইক্রোপ্রসেসরের বাজারের ৫৭.১ শতাংশ দখল করে শীর্ষে আছে। কাছাকাছি রয়েছে STmicro. এটি বাজার দখল করে রেখেছে ৯ শতাংশ। মাইক্রোপ্রসেসর চাহিদা বর্তমানে আকাশচুম্বী। এটি এর কার্যক্ষমতায় প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নিত্যনতুন গ্যাজেট উদ্ভাবনের ফলে মাইক্রোপ্রসেসরের বাজার দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। এটি ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে থামবে তার উত্তর শুধুমাত্র সময়ই ভাল বলতে পারবে।
No comments:
Post a Comment